৪ঠা আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

রাতারাতি বদলাচ্ছে না বাংলাদেশ

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সৌন্দর্য ছিল, পুরো জাতি এক স্বৈরাচারী সরকার ও মাফিয়া ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। যেহেতু আওয়ামী লীগের সমর্থনকারীদেরও অনেকে ছাত্র-জনতা হত্যাকাণ্ড সইতে না পেরে, বিলম্বে হলেও আন্দোলনে যোগ দেন, তাই একে ‘পুরো জাতির ঐক্য’ বলাই যায়।

কিন্তু স্বৈরাচারের পলায়নের পর সেই ঐক্য এক দিনও অটুট থাকেনি, সেটা হলো এক হতাশাজনক বাস্তবতা।

সুযোগসন্ধানী অনেকে দাবি করা শুরু করে, তারাই নাকি আন্দোলনের মূল দাবিদার। অথচ সবাই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন কোনো ব্যানার ছাড়া। আন্দোলনকালে সৃষ্ট ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ছিল একমাত্র ব্যানার, যাদের ডাকে সারা দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, জীবন দিয়েছিলেন প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষ।

আমরা স্মরণ করতে পারি, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কিছু লোক কেবল শেখ মুজিবের মূর্তি নয়, ফুলার রোডে বা ময়মনসিংহের শশী লজে মূর্তি ভাঙতে গেছেন। মূর্তি-মাজার ভাঙচুরের অধিকার চাই—এই দাবি জুলাই আন্দোলনে কেউ করেনি।

ভাঙচুরপন্থী ও সুযোগসন্ধানী ওই সব গোষ্ঠীকে আমরা ডান-রক্ষণশীল হিসেবে চিনেছি, যারা আন্দোলন–পরবর্তী ‘দেশ গড়ার’ সময়ে, দক্ষ-যোগ্য-দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ঢালাওভাবে ‘ইসলামবিদ্বেষী’ বলে নাকচ করে গেছে। ‘মব’ প্রপঞ্চের মব গ্রুপগুলোতে এদেরই আধিক্য। জনপরিসরে মেয়েদের পেটানোর একাধিক ঘটনাও ঘটেছে, বাইরের মেয়েরা যেন ঘরে ঢুকে যায়। হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ থেকে নারী সংস্কার কমিশনের সদস্যদের অশ্লীল গালি দেওয়া হয়েছে।

আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের নতুন দলও প্রত্যাশার তুলনায় নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিতে পারেনি। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি—এই তিন দলের মধ্যে এখন নিত্যকলহ লেগে আছে। তবে শেষের দুই দলের কলহের তুলনায় সদ্ভাব বেশি। আন্দোলনে যোগ দেওয়া সাধারণ অনেক পক্ষই যার যার পুরোনো অবস্থায় ফিরে গেছে।

কোনো কোনো পক্ষকে রাজনৈতিক মল্লযুদ্ধের মাঠ থেকে কৌশলে বা পরিস্থিতি তৈরি করে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। যেমন নারীরা আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকলেও কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের বড় অবদান থাকলেও তরুণদের নেতৃত্বাধীন নতুন রাজনৈতিক শক্তিতে, ঢাকাকেন্দ্রিক পুরুষ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেকদের প্রাধান্য। সারকথা হলো আন্দোলন সবার থাকলেও আন্দোলন–পরবর্তী এক বছর কারও কারও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

আন্দোলনের পরে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব ছিল মূলত তিনটি: সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন। সংস্কার কমিশন হয় ১১টি, কমিশনগুলো রিপোর্টও দিয়েছে। এখন চলছে সংস্কার বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর আলোচনা। তবে সংস্কারের সঙ্গে নির্বাচনের দ্বান্দ্বিক একটা ফ্রেমিং দাঁড় করানোর চেষ্টাটা, অসাধু চেষ্টা বলে আমার মনে হয়েছে।

‘আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন’ বলে একটা ক্যাম্পেইন ছিল, সঙ্গে ছিল ‘ইউনূস সরকারকে ৫ বছর চাই’ নামের আরেক ক্যাম্পেইন। বিএনপি ছাড়া অন্য পক্ষগুলো এসব ক্যাম্পেইনের পক্ষে ছিল। আর বিএনপি যেন ছিল ‘আগে নির্বাচন, পরে সংস্কার’ নীতির পক্ষে। বস্তুত, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা নিয়ে সরকারপক্ষের অবস্থান অস্পষ্ট ছিল।

আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার করতে হবে। কিছু সম্ভাব্য অপরাধী গ্রেপ্তার হয়েছেন। কিন্তু ৫ আগস্টের অনেক পরে পালিয়ে গেছেন, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী জনতার ওপর হামলার হুকুমদাতা ওবায়দুল কাদের, দায়িত্বপ্রাপ্ত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, গুম-পীড়নে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদসহ অনেকে। প্রচলিত ধারণা, তাঁরা ব্যাপক অর্থকড়ি ব্যয় করে এই সুযোগ পেয়েছেন।

আবার যাঁদের ধরা হয়েছে, তাঁদের প্রায় সবার নামেই ঢালাও হত্যা মামলা। কারও কারও ক্ষেত্রে হত্যার সংযোগটি হাস্যকর হিসেবে ধরা পড়েছে। অর্থাৎ যথাযথ অপরাধ চিহ্নিত না করেই, যত্নসহকারে অনুসন্ধানের পথ না বেছে, যে মামলাগুলো করা হয়েছে, আইনি লড়াইয়ে তা টিকবে না শেষে।

এদিকে জুলাইয়ে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো কিংবা আহত ব্যক্তিদের প্রযোজ্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রেও বিস্তর অভিযোগের কথা শোনা যায়। দেশের আমলাতন্ত্র, পুলিশ, সাংবাদিকতা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও বিশেষ কোনো পরিবর্তন আসেনি। ন্যারেটিভ নির্মাণ বা অ্যাকশনের ক্ষেত্রে কেবল চরিত্র বদলেছে, ধরন একই রয়েছে। ফলে শাসনব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন ঘটেনি।

গুমের মতো ঘটনা আর ঘটছে না, কিন্তু মানুষের মৃত্যুও এড়ানো যাচ্ছে না। সরকারের দিক থেকে গুম-হত্যাকাণ্ড হচ্ছে না, কিন্তু নাগরিকেরা পরস্পরকে নিয়মিত আক্রমণ করছে। সামান্য বিষয় নিয়ে বড় বড় সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। আবার এনসিপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে সরকারি বাহিনীর গুলিতে ১৬ জুলাই মারা গেছে পাঁচজন গোপালগঞ্জের অধিবাসী। চাঁদাবাজি-রাহাজানি কমেনি, যুবলীগের জায়গায় শোনা যাচ্ছে যুবদলের কথা।

জুলাইয়ের লড়াই চলাকালে সবার একটাই প্রতিজ্ঞা ক্রমে দানা বেঁধেছিল, শেখ হাসিনার সরকারের পতন। পতনের পরে সুযোগসন্ধানীরা ছাড়া, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্বপ্ন দেখেছিলেন নতুন বাংলাদেশের। এক বছরে বোঝা গেছে, রাতারাতি বদলে যাবে না বাংলাদেশ। বরং পরিবর্তনের পথটি দীর্ঘ ও ধীরগতির।

গণতন্ত্রে ফেরাটাই প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত, যেটা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান এজেন্ডা হতে হবে। সংস্কারের ধারণাগুলোকেও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। নির্বাচিত সরকার যেন এগুলোর অনেকখানি বাস্তবায়ন করে, সে জন্য আমাদের সবাইকেই সত্যিকারের ‘প্রেশার গ্রুপ’ হিসেবে কাজ করতে হবে। আর নির্বাচিত সরকারের প্রথম কাজ হবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা। আর নতুন সৃষ্ট উদ্ভট-অগণতান্ত্রিক আবদারগুলোকে নিষ্ক্রিয় করা। তবে সবচেয়ে জরুরি হবে অর্থনৈতিক উন্নতিসাধন। ফাহমিদুল হক ফ্যাকাল্টি মেম্বার, বার্ড কলেজ, যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকার দৈনিক প্রথম আলোর সৌজন্যে