অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন,বাংলাদেশে ‘ক্যাশলেস সোসাইটি’ গড়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও অনানুষ্ঠানিক খাতের লেনদেন এই রূপান্তরের পথে বড় বাধা।
সরকার ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ [নগদ টাকাবিহীন] গড়ায় জোর দিলেও এখনও দেশের ৭২ শতাংশের বেশি লেনদেন হচ্ছে নগদ টাকায়। বড় অঙ্কের টাকার ক্ষেত্রে মানুষ এখনও নগদ বা চেকের ওপরই বেশি নির্ভরশীল। তবে ছোট ও মাঝারি অঙ্কের লেনদেনের জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পেমেন্ট সিস্টেম প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশে মোট লেনদেনের ৭১ দশমিক ৭২ শতাংশই নগদ অর্থে হয়েছে। ওই মাসে মোট লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৯ লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকায়, যা আগের বছরের ডিসেম্বরে ছিল ১৮ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, সংখ্যার হিসাবেও ডিসেম্বরে মোট লেনদেনের ৫৩ শতাংশ, অর্থাৎ ৪৫ কোটির বেশি লেনদেন হয়েছে নগদ অর্থে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, টাকার অঙ্ক এবং লেনদেনের সংখ্যা—উভয় ক্ষেত্রেই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের চেয়ে এগিয়ে নগদ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, দেশের আনুষ্ঠানিক পেমেন্ট ব্যবস্থা মূলত দুই ভাগে বিভক্ত—বড় অঙ্কের লেনদেন ও খুচরা লেনদেন। বড় অঙ্কের লেনদেনের বেশিরভাগই বাংলাদেশ অটোমেটেড চেক প্রসেসিং সিস্টেম (বিএসিপিএস)–এর আওতায় চেকের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন, ‘ক্যাশলেস সোসাইটি’ গড়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও অনানুষ্ঠানিক খাতের লেনদেন এই রূপান্তরের পথে বড় বাধা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘একটা কথা আছে—”ক্যাশ ইজ কিং”, বাস্তবেও তাই। দেশের বেশিরভাগ নগদ লেনদেন অনানুষ্ঠানিক খাতে হয়। এই খাতগুলোকে আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থার আওতায় না আনলে ক্যাশলেস সমাজ গড়া কঠিন।’
তিনি আরও বলেন, ‘পরিবহন খাত, কৃষি, খুচরা-পাইকারি খাতে এখানে কিন্তু অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা ব্যবসা করে যাচ্ছে, তবে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে তারা। এরা অন্তর্ভুক্ত হতেও চায় না। কারণ এ চ্যানেলের মধ্যে আসলে, কর ও ট্যাক্সের মধ্যে পড়বে।’
জাহিদ হোসেন মনে করেন, যে ভিত্তির ওপর ‘ক্যাশলেস সোসাইটি’ গঠন করার চেষ্টা চলছে, সেই ভিত্তি যদি পুরোনো ধ্যান-ধারণার হয়—যেখানে মানুষ নগদেই বেশি স্বচ্ছন্দ, সেখানে এই পরিবর্তন আনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
এনআরবিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ড. মো. তৌহিদুল আলম খান এর পেছনে একাধিক কারণ উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘এর প্রাথমিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য পয়েন্ট-অব-ট্রানজ্যাকশন [পস] সিস্টেমের অভাব বা সীমাবদ্ধতা। এর সাথে ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অনীহা এবং সীমিত সচেতনতাও রয়েছে।’
‘উচ্চ ইন্টারনেট খরচ, স্মার্ট ডিভাইসের অভাব, ডিজিটাল স্বাক্ষরতার সীমাবদ্ধতা এবং বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় আর্থিক অন্তর্ভুক্তির হার কম থাকার মতো বিষয়গুলো নগদ লেনদেনের ওপর নির্ভরতা বাড়ায়। অনলাইন প্ল্যাটফর্মের ওপর বিশ্বাসের অভাবও এই প্রবণতায় ভূমিকা রাখে, যা ডিজিটাল চ্যানেলের ব্যাপক প্রসারে বাধা সৃষ্টি করে’, যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও জানান, সংস্কৃতিগত কারণও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। ‘অনেকে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা বা তথ্য প্রকাশ এড়ানোর জন্য নগদে লেনদেন করতে পছন্দ করেন। বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেনেও প্রায়ই নগদ ব্যবহার করা হয়, যাতে ডকুমেন্টেশন, কর বা ব্যাংক তদারকি এড়ানো যায়।’
তবে তিনি ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকও তুলে ধরেন। তার ভাষায়, ‘বাংলাদেশ এখনো রূপান্তর পর্যায়ে আছে, কিন্তু ইতিবাচক ধারা তৈরি হয়েছে। ডিজিটাল ওয়ালেট, মোবাইল ব্যাংকিং এবং কিউআর কোড–ভিত্তিক পেমেন্ট ব্যবস্থার প্রসার আশাব্যঞ্জক।’
তৌহিদুল আরও বলেন, ‘সম্পূর্ণ রূপান্তর আনতে হলে প্রয়োজন সমন্বিত প্রয়াস—কার্যকর বাস্তবায়ন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিতে সহজ প্রবেশাধিকারের নিশ্চয়তা। অগ্রগতি দৃশ্যমান হলেও পরিবর্তন এখনো ধীরগতির; দেশ এখনো রূপান্তর পর্যায়েই রয়েছে।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান টিবিএস–কে বলেন, ‘বাংলাদেশ এখনো নগদভিত্তিক লেনদেনের ওপর নির্ভরশীল। ক্যাশলেস অর্থনীতি গড়তে হলে ডিজিটাল অবকাঠামোকে শক্তিশালী করতে হবে। এমনকি অনেক শিক্ষিত মানুষও এখনো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে অনীহা দেখান। তবে একবার এই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে টাকার মুদ্রণ ব্যয়ও উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে ক্যাশলেস লেনদেন সম্প্রসারণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। জেলায় জেলায় সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন বা ইস্যুর ক্ষেত্রে এখন কিউআর কোড–ভিত্তিক পেমেন্ট ব্যবস্থা রাখা বাধ্যতামূলক।
দুই বছর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘বাংলা কিউআর’ নামে একটি জাতীয় কিউআর কোড মানদণ্ড চালু করে খুচরা লেনদেনের জন্য। বর্তমানে এই ব্যবস্থায় ৪৩টি ব্যাংক, ৫টি মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) এবং ৩টি পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার (পিএসপি) যুক্ত রয়েছে।
সরকার ২০৩১ সালের মধ্যে সব ধরনের লেনদেনকে ক্যাশলেস করার লক্ষ্য নিয়েছে—’স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’–এর চারটি ধাপ (স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার ও স্মার্ট সমাজ) বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে।
সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো ইতোমধ্যে নগদের ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে ক্যাশলেস অর্থনীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বাড়ছে ডিজিটাল লেনদেনও
নগদ অর্থ এখনো লেনদেনের মূল মাধ্যম হলেও, দেশে ডিজিটাল পেমেন্টের ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের এপ্রিল ও জুন মাসে ডিজিটাল লেনদেনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি ছিল—প্রায় ৫৬ শতাংশ। ঈদকেন্দ্রিক কেনাকাটা, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ভাতা প্রদান এবং বিভিন্ন বার্ষিক বিক্রয় উৎসবের কারণে এই দুই মাসে লেনদেন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়।
অন্যদিকে ডিসেম্বর মাসে ডিজিটাল লেনদেনের হার নেমে আসে ৪৭ শতাংশে, কারণ বছরশেষে হিসাব নিষ্পত্তি ও নগদ উত্তোলন বেড়ে যায়। লেনদেনের পরিমাণের দিক থেকে নভেম্বর মাসে ডিজিটাল পেমেন্ট সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশে পৌঁছায়—মূলত প্রাতিষ্ঠানিক স্থানান্তরের কারণে। এপ্রিল মাসে এ হার ছিল সর্বনিম্ন, প্রায় ২০ শতাংশ। সারা বছর জুড়ে মোট লেনদেনের প্রায় ৫৬ শতাংশই ছিল ডিজিটাল মাধ্যমে।
এনআরবিসি ব্যাংকের সিইও মো. তৌহিদুল আলম খান বলেন, ‘একটি ক্যাশলেস অর্থনীতি আর্থিক শৃঙ্খলা বাড়ায়, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে এবং কর আহরণকে শক্তিশালী করে। এটি নগদ অর্থ ব্যবস্থাপনার খরচ কমায়, লেনদেনকে দ্রুততর করে এবং সামগ্রিক রাজস্ব স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সর্বোপরি, একটি ক্যাশলেস কাঠামো আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ায়, অর্থনৈতিক অপচয় কমায় এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখে।’