বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার কোনোভাবেই থামছে না। আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থপাচার হয়েছে। এর সিংহভাগ হয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে। ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও এ প্রবণতা থামানো যায়নি। রপ্তানির আড়ালে এখনও প্রচুর অর্থপাচার হচ্ছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক পরিদর্শনে উঠে এসেছে। এ ছাড়া দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনেও অর্থপাচারের তথ্য আসছে। এমন পরিস্থিতিতে বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচার ঠেকাতে ব্যাংকগুলোকে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিশেষ করে আমদানি-রপ্তানি সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র অধিকতর পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণ করতে বলা হয়েছে, যাতে বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচার রোধ করা যায়। এদিকে পাচারকৃত টাকা উদ্ধারে অন্তর্বর্তী সরকার নতুন একটি আইন করার উদ্যোগ নিলেও তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। ফলে পাচারের টাকা উদ্ধারের প্রক্রিয়া থমকে আছে।
বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, দেশ থেকে প্রতি বছর যে পরিমাণ অর্থপাচার হয়, তার প্রায় ৭০-৮০ শতাংশই হচ্ছে বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে। ওভার ইনভয়েসিং (আমদানিতে মূল্য বেশি দেখানো) এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের (রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানো) মাধ্যমে এসব অর্থপাচার হয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশ থেকে পাচার হওয়া মোট অর্থের প্রায় ৭৫ শতাংশই বাণিজ্যর মাধ্যমে হয়। আমদানি ও রপ্তানির সময় মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এই বিপুল অর্থপাচার হচ্ছে। অন্যদিকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য মতে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বাণিজ্যের আড়ালে বছরে গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৪ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং ছাড়াও বর্তমানে মাল্টিপল ইনভয়েসিং, শর্ট ও ওভার শিপমেন্ট, প্যান্টম শিপমেন্ট এবং ডিসকাউন্ট অথবা পণ্যমূল্য পরিবর্তনের মাধ্যমে আমদানি ও রপ্তানি প্রক্রিয়ায় বাণিজ্যভিত্তিক মনিলন্ডারিং হয়ে থাকে। এ ছাড়া হুন্ডিতেও অর্থপাচার করা হচ্ছে। দুর্বল নজরদারি এবং আন্তর্জাতিক লেনদেনের সুযোগ নিয়ে প্রভাবশালী ও অসাধু ব্যবসায়ীরা এসব কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে সরকারের কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও বাস্তবে পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যাংকগুলোর ইনভয়েস যাচাইয়ের পাশাপাশি কাস্টমস ও এনবিআরের নজরদারি জোরদার না হলে এ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজম্যান্টের সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, বাংলাদেশ থেকে বেশিরভাগ অর্থপাচার হয় আমদানি-রপ্তানির আড়ালে। অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্যের মূল্য কম-বেশি দেখিয়ে অর্থপাচার করে থাকে। শুধু অর্থপাচারই নয়, ব্যবসায়ীদের অনেকেই কাক্সিক্ষত রপ্তানি আয়ের টাকাও সময়মতো দেশে প্রত্যাবাসন করেন না। আবার অর্থপাচার না কমার জন্য ব্যংকারদেরও দায় রয়েছে। কারণ, কাগজপত্র যাচাইয়ের ক্ষেত্রে তাদের যোগসাজশ কিংবা গাফিলতি থাকে। তাই ব্যাংকাররা সতর্ক এবং সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র যাচাইয়ে মনোযোগী হলে বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচারের পরিমাণ অনেকাংশেই কমানো সম্ভব।
রপ্তানির আড়ালে এখনও অর্থপাচার হচ্ছে : বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মিত তদারকিতে সাম্প্রতিক সময়ে আমদানির আড়ালে অর্থপাচার কমলেও রপ্তানির আড়ালে এখনও প্রচুর অর্থপাচার হচ্ছে। এ বিষয়ে গত জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় বৈদেশিক পরিদর্শন বিভাগ থেকে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়- সাম্প্রতিক পরিদর্শনে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, রপ্তানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং (বাজারমূল্যের চেয়ে কম মূল্য দেখানো), ওভার শিপমেন্ট (নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি পণ্য/ওজন দেখানো) এবং মাল্টিপল ইনভয়েসিংয়ের (একটি ইএক্সপির বিপরীতে একাধিক ইনভয়েস) মাধামে বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচার সংঘটিত হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে প্রচুর অর্থপাচার হচ্ছে। এসব অর্থপাচারে পোশাক খাতের রপ্তানিকারকদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে এই অর্থপাচার হচ্ছে।
সভায় বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন বিভাগের পরিচালক মাহবুবুল আলম বলেন, ব্যাংকাররা সচেষ্ট হলে প্রাথমিক পর্যায়ে ইনভয়েস পর্যালোচনার মাধ্যমে এ ধরনের অর্থপাচার রোধ করতে পারেন। একই বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, এ ধরনের মানি লন্ডারিংয়ের জন্য হুন্ডি বাজার সক্রিয় রয়েছে। আমদানির ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রা নীতি বিভাগ প্রতিটি আমদানি পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করছে। উক্ত বিভাগের ন্যায় রপ্তানির ক্ষেত্রেও পর্যবেক্ষণ চলমান রাখা হবে। সভায় গভর্নর আহসান এইচ মনসুর অর্থপাচার প্রতিরোধে ব্যাংকগুলোকে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেন।
জানা যায়, বৈদেশিক মুদ্রা নীতি বিভাগ থেকে ২০২৩ সালের জুলাই হতে আমদানি মূল্য পরিবীক্ষণ, জাহাজ ভাড়া, ইনস্টলেশন, কমিশন, ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং, শুল্কায়ন, আমদানির আড়ালে অর্থপাচার প্রভৃতি দৈনিক ভিত্তিতে যাচাই করা হচ্ছে। এ জন্য ব্যাংকগুলোকে ৫০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের ঋণপত্র খোলার তথ্য ২৪ ঘণ্টা আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে হয়। তবে রপ্তানির তথ্য সেভাবে যাচাই করা হচ্ছে না।
ব্যাংক খাতে কিছু সংস্কারের ফলে ঢালাওভাবে অর্থপাচার কিছুটা বন্ধ হয়েছে বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। অর্থপাচার কমেছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কিছুটা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। ব্যাংক খাত ছিল অর্থপাচারের অন্যতম খাত। সেখানে কিছু সংস্কার হয়েছে, যে কারণে আগে ঢালাওভাবে এখানে জালায়াতির সুযোগ ছিল, সেটা বন্ধ হয়েছে। তবে আমাদের সিংহভাগ অর্থপাচারের পুরোটা নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছে, সেটা বলতে পারব না। কারণ, সেখানে বাস্তব সংস্কার এখন পর্যন্ত হয়নি। কিছু কিছু পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে মাত্র।
শেখ হাসিনার আমলে বিপুল অর্থপাচার : শেখ হাসিনার শাসনামলে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচারের তথ্য উঠেছে এসেছে লন্ডনভিত্তিক দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে। গত ১১ সেপ্টেম্বরের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওভার-ইনভয়েসিং ও আন্ডার-ইনভয়েসিং এবং হুন্ডির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ওই অর্থপাচার হয়েছে। এসব অর্থের প্রধান গন্তব্য ছিল যুক্তরাজ্য। এর আগে অন্তর্বর্তী সরকারের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৫ বছরে প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার করে অর্থপাচার হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, শেখ হাসিনার সময়ে মোট ২৪০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। বর্তমান বিনিময় হারে এর পরিমাণ প্রায় ২৮ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থে গড়ে তোলা বিদেশে ৪০ হাজার কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ পেয়েছে এনবিআর। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত পাঁচটি দেশের সাতটি শহরে অনুসন্ধান চালিয়ে এই তথ্য পেয়েছে বলে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) থেকে জানানো হয়। এ ছাড়া ৯টি দেশে ৩৫২টি পাসপোর্টের সন্ধান পায় এনবিআর, যেগুলো টাকার বিনিময়ে অর্জন করেছে কিছু বাংলাদেশি। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে দুদক, সিআইসি ও পুলিশের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ দেশের সম্পদ লুট করে বিদেশে সম্পত্তি গড়তে না পারে।
পাচারের টাকা উদ্ধারের প্রক্রিয়া থমকে আছে : দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এরই মধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে এখনও অর্থ উদ্ধারের জন্য ‘নতুন আইনের খসড়া’ চূড়ান্ত হয়নি। গত বছরের ১০ মার্চ প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে ‘পাচারকৃত সম্পদ পুনরুদ্ধার, গৃহীত পদক্ষেপ ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক শেষে প্রেস সচিব শফিকুল আলম সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন- পাচার হওয়া এই টাকা কীভাবে ফেরত আনা যায়, সে বিষয়ে একটি বিশেষ আইন শিগগির করা হবে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে আইনটি দেখা যাবে। তবে এক বছরের বেশি সময় পার হলেও ওই আইনের খসড়া চুড়ান্ত করতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, নতুন আইনে দেওয়ানী মামলার বিধান রাখা এবং সমঝোতার মাধ্যমে পাচারের টাকা ফেরত আনার সুযোগের প্রশ্নে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছে না সরকার। এ বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আজিমুদ্দিন বিশ্বাস আমাদের সময়কে বলেন, আমরা আইনটি প্রণয়নে কাজ করছি। এরই মধ্যে কয়েকটি মিটিং করেছি। সামনে আরও মিটিং হবে। কবে নাগাদ আইনটি চূড়ান্ত হতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব না। তবে আইন প্রণয়নের কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। শিগগিরই আরেকটি মিটিং করব।
জানা যায়, বিদ্যমান মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে পাচারের অপরাধে শুধু ফৌজদারি মামলা ও শাস্তির বিধান রয়েছে। এই আইন ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর রয়েছে। তবে এই আইনের অধীনে অর্থ উদ্ধারের কোনো তথ্য নেই। সংবাদসুত্র দৈনিক আমাদের সময়