৭ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ডায়াবেটিস কি সত্যিই উল্টে যেতে পারে? গবেষণায় যা বলছে

টাইপ–২ ডায়াবেটিস সাধারণত আজীবন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়—ওষুধ, খাদ্যনিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত নজরদারি এবং জটিলতার আশঙ্কা সবসময় সঙ্গে থাকে। তবে ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগোর সাম্প্রতিক এক গবেষণা জানাচ্ছে, বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে এ রোগকে নন-ডায়াবেটিক অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হতে পারে। ‘রিভার্সাল’ বা ‘রেমিশন’ আসলে কী?

চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, টাইপ–২ ডায়াবেটিসের রেমিশন বলতে বোঝায়—কোনো ওষুধ বা অস্ত্রোপচারের সক্রিয় চিকিৎসা ছাড়াই দীর্ঘ সময় রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ডায়াবেটিস-সীমার নিচে নেমে আসা। এটি স্থায়ী ‘নিরাময়’ নয়, কারণ রোগের মূলে থাকা জৈবিক প্রবণতা থাকে অক্ষত। অনেক ক্ষেত্রেই এটিকে ‘রিভার্সাল’ বলা হয়—অর্থাৎ ওষুধ ছাড়াই উল্লেখযোগ্য ও স্থায়ী গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ। ডায়াবেটিস উল্টে যাওয়ার পেছনের বিজ্ঞান

টাইপ–২ ডায়াবেটিস মূলত দুই কারণে হয়: ১. শরীরে ইনসুলিন প্রতিরোধ

২. অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষের দুর্বল ইনসুলিন নিঃসরণ

গবেষণা বলছে, লিভার ও অগ্ন্যাশয়ে অতিরিক্ত চর্বি জমা হলে এই দুই প্রক্রিয়াই দুর্বল হয়ে যায়। গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাডিসহ বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, দ্রুত ও উল্লেখযোগ্য ওজন কমালে লিভার ও প্যানক্রিয়াসের ফ্যাট কমে, ফলে ইনসুলিন নিঃসরণ বেড়ে যায় এবং শরীর ইনসুলিনকে আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে। এতে অনেকের ক্ষেত্রেই ডায়াবেটিস রেমিশনে চলে যায়। এ প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করতে রয় টেইলরের টুইন–সাইকেল হাইপোথেসিস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

রেমিশন ঘটাতে যে পদ্ধতিগুলো কার্যকর প্রমাণিত: ১. ওবেসিটি সার্জারি (বেরিয়াট্রিক সার্জারি)

গুরুতর স্থূলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা স্লিপ অ্যাপনিয়ার রোগীদের জন্য বেরিয়াট্রিক সার্জারি কার্যকর চিকিৎসা।

১.সাধারণত বিএমআই ৩২-এর বেশি হলে, অথবা চরম স্থূলতায় বিএমআই ৩৫-এর বেশি হলে এটি সুপারিশ করা হয়।

২. রোবোটিক-সহায়িত সার্জারি বর্তমানে অধিক নিখুঁত, কম রক্তক্ষরণ এবং দ্রুত সুস্থতার সুবিধা দেয়।

৩. স্লিভ গ্যাস্ট্রেকটমি বা গ্যাস্ট্রিক বাইপাসের মতো পদ্ধতিতে পাকস্থলীর আকার কমে এবং ক্ষুধা–হরমোনও বদলে যায়, ফলে দ্রুত ওজন কমে ও রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে আসে।

ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের স্টাম্পডে ও এআরএমএমএস-টি২ডি ট্রায়ালে দেখা গেছে, সার্জারি–গ্রহণকারীরা ওষুধে থাকা রোগীদের তুলনায় দীর্ঘমেয়াদে অনেক ভালো ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ পেয়েছেন।

বুখওয়াল্ডের গবেষণা অনুযায়ী, ৭৬%–৯২% রোগী সার্জারির পর রেমিশন অর্জন করেন, যা এ পদ্ধতির শক্তিশালী ইতিবাচক প্রভাবকে নির্দেশ করে।

২. ভেরি–লো ক্যালরি ডায়েট (VLCD)

প্রায় ১৫ কেজি বা তার বেশি ওজন কমাতে পারলে টাইপ–২ ডায়াবেটিস রেমিশনে যাওয়ার সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে—বিশেষ করে রোগ ধরা পড়ার পর দ্রুত হস্তক্ষেপ করলে।

ট্রায়ালে দেখা গেছে, যারা প্রথম বছরেই প্রায় ১৫ কেজি ওজন কমাতে পেরেছিলেন, তাদের প্রায় অর্ধেক রেমিশনে গেছেন।

তবে এ ডায়েট কঠোর তত্ত্বাবধান, ঘনঘন মনিটরিং এবং ওজন ধরে রাখার পরিকল্পনা দাবি করে।

৩. লো-কার্ব বা লো-এনার্জি ডায়েট

কম কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ ইনসুলিনের চাহিদা কমায়, রক্তে শর্করা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনে এবং ওজন কমাতে সাহায্য করে।

একটি ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং–ভিত্তিক গবেষণায় দেখা গেছে, অর্ধেকের বেশি অংশগ্রহণকারী অন্তত এক বছর রেমিশনে থাকতে পেরেছেন। কারা রেমিশনের জন্য সবচেয়ে যোগ্য?

১.যাদের ডায়াবেটিসের সময়কাল কম

২. যারা ১০–১৫ কেজি বা তার বেশি ওজন কমাতে সক্ষম

৩. যাদের প্যানক্রিয়াসের বিটা-সেল রিজার্ভ এখনও ভালো

৪. প্রাথমিক পর্যায়ে যাদের রক্তে শর্করার এক্সপোজার কম ছিল

৫. জটিলতা কম রয়েছে

দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস থাকা রোগীদের ক্ষেত্রে রেমিশনের সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম। বাস্তবে, কমিউনিটি-ভিত্তিক বড় ডাটায় দেখা গেছে—স্কটল্যান্ডে মাত্র ০.১% রোগী রেমিশন ক্যাটেগরিতে পড়েছেন।

রেমিশন হলেও সতর্কতা প্রয়োজন: রেমিশন মানেই ডায়াবেটিস শেষ হয়ে গেছে—এটা নয়। ওজন বেড়ে গেলে, ব্যায়াম বন্ধ হলে ও বিপাকীয় চাপ বাড়লে

রোগ আবার ফিরে আসতে পারে। তাই নিয়মিত ফলো-আপ, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন বজায় রাখা অত্যাবশ্যক।

চিকিৎসা–ব্যবস্থায় এর বাস্তব প্রয়োগ : টাইপ–২ ডায়াবেটিস আক্রান্তদের জন্য রেমিশন একটি সম্ভাব্য লক্ষ্য হতে পারে, তবে এটি নিশ্চিত নয়। চিকিৎসকদের উচিত:

১. দ্রুত ওজন কমাতে রোগীকে কাঠামোবদ্ধ সাহায্য দেওয়া

২. নিরাপদ হলে ভিএলসিডি বা লো-কার্ব ডায়েটের ব্যবস্থা করা

৩. নিয়মিত ব্যায়াম, বিশেষ করে স্ট্রেংথ ট্রেনিং উৎসাহিত করা

৪. রক্তে শর্করা, ইনসুলিন চাহিদা ও জটিলতা নিয়মিত মনিটরিং

৫. ওজন ধরে রাখতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা

বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত—টাইপ–২ ডায়াবেটিস রেমিশনে যাওয়া সম্ভব, এবং দ্রুত ও উল্লেখযোগ্য ওজন হ্রাস এতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বেরিয়াট্রিক সার্জারি, খুব কম ক্যালরির ডায়েট এবং লো-কার্ব খাদ্য পরিকল্পনা উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে। তবে সবার ক্ষেত্রে রেমিশন সম্ভব নয়; এর জন্য প্রয়োজন ধারাবাহিক চিকিৎসা, কঠোর জীবনধারা পরিবর্তন এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি।