সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসে একটি সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে—এবং তার যথেষ্ট কারণও আছে।
প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘কলেজে ভর্তির আবেদনপত্রে মামদানি নিজেকে এশীয় এবং আফ্রিকান আমেরিকান দেখিয়েছিলেন’
কেন নিউইয়র্ক টাইমসের ওই প্রতিবেদন তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে, তার কয়েকটি কারণ তুলে ধরেছেন মার্গারেট সুলিভান। তিনি দ্য গার্ডিয়ান ইউএসের একজন কলাম লেখক। তিনি গণমাধ্যম, রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে কলাম লেখেন।
মার্গারেট সুলিভান তাঁর কলামে লিখেছেন, প্রতিবেদনটি নিউইয়র্ক সিটির মেয়র পদপ্রার্থী জোহরান মামদানিকে নিয়ে করা। ডেমোক্র্যাটদের প্রাথমিক বাছাইয়ে (প্রাইমারি ইলেকশন) তাঁর চকমপ্রদ জয় জাতীয় পর্যায়ে নজর কেড়েছে।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত মামদানির জন্ম উগান্ডায়। নিউইয়র্ক টাইমসের ওই প্রতিবেদনের মূল বক্তব্য ছিল, নিউইয়র্কে হাইস্কুলের শেষ ধাপে মামদানি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করার সময় জাতিগত পরিচয়সম্পর্কিত একাধিক ঘরে টিক দিয়েছিলেন।
আপনি বলতে পারেন, এতে সমস্যা কোথায়? কেন এ বিষয়টি নিয়ে রিপোর্টই–বা করতে হবে? দারুণ প্রশ্ন।
সংবাদটির প্রকৃত গুরুত্ব থাকুক বা না থাকুক, এটি অবধারিতভাবে মামদানির একজন প্রতিদ্বন্দ্বীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তিনি হলেন, নিউইয়র্ক সিটির বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস। এবার অ্যাডামস একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
অ্যাডামস একজন কৃষ্ণাঙ্গ। তিনি বলেছেন, জোহরান মামদানি কৃষ্ণাঙ্গ না হয়েও আফ্রিকান–আমেরিকান পরিচয়কে পুঁজি করে ফায়দা তোলার চেষ্টা করেছেন। এটা তাঁর কাছে গভীর অপমানজনক মনে হয়েছে।
আর ফক্স নিউজে একাধিক টক শোতে উপস্থাপকেরা নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনের উল্লেখ করে জোহরানকে তুলাধোনা করেছেন।
যেমন, ফক্স অ্যান্ড ফ্রেন্ডস অনুষ্ঠানের উপস্থাপক চার্লি হার্ট জোহরানকে একজন ‘বর্ণবাদী’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ যা কিছুতে বিশ্বাস করে, তার সবকিছুকেই ঘৃণা করেন মামদানি।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন প্রকাশের আগেও ডানপন্থী টেলিভিশন নেটওয়ার্ক ফক্স নিউজ জোহরানকে ধুয়ে দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছে। জোহরান একজন মুসলিম ও সমাজতান্ত্রিক।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জোহরানকে একজন কমিউনিস্ট বলেছেন এবং তাঁকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়ন করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন।
অন্যান্য ডানপন্থী সংবাদমাধ্যমও নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনটি লুফে নিয়েছে। তারা মামদানির জাতিসংক্রান্ত তথ্য দেওয়াকে ডিইআই কেলেঙ্কারির উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করেছে। ডিইআই হলো বৈচিত্র্য, সাম্যতা ও অন্তর্ভুক্তি নীতি।
জোহরানকে নিয়ে ডানপন্থী সংবাদমাধ্যমগুলো দাবি করে, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিবাচক পদক্ষেপমূলক ভর্তি নীতির (অ্যাফারমেটিভ অ্যাকশন) সুযোগ নিতেই মামদানি নিজের জাতিগত পরিচয় নিয়ে মিথ্যা বলেছিলেন। মামদানি কিন্তু শেষতক কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হননি, যে কারণে তাঁকে নিয়ে করা ওই সংবাদটি আরও ফালতু হয়ে গেছে।
নিউইয়র্ক টাইমসের মুদ্রিত সংস্করণে এ খবরের শিরোনাম করা হয়, ‘কলেজে ভর্তির আবেদনপত্র ঘিরে সমালোচনার মুখোমুখি মামদানি’।
জোহরান তাঁর ব্যাখ্যায় বলেছেন, তিনি তাঁর জটিল পারিবারিক পটভূমি বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর বাবা একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত উগান্ডার নাগরিক এবং মা ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান। জোহরানের জন্ম উগান্ডায়, শৈশবে নিউইয়র্ক সিটিতে চলে আসার আগে স্বল্প সময় তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাস করেছেন।
নিউইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেন, ‘অধিকাংশ কলেজে ভর্তির আবেদনপত্রে ভারতীয় বংশোদ্ভূত উগান্ডার নাগরিকদের জন্য আলাদা কোনো ঘর থাকে না, তাই আমার পারিবারিক পটভূমি পুরোটা তুলে ধরার চেষ্টা হিসেবে আমি একাধিক ঘরে টিক দিয়েছিলাম।’
সুলিভান লেখেন, জোহরান মামদানিকে নিয়ে এ ধরনের একটি প্রতিবেদন করা এবং সেটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত কম করে বললেও বোকার মতো কাজ হয়েছে বলা যায়।
এর একটি কারণ, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যভান্ডারে (ডেটাবেজে) বড় ধরনের হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে নিউইয়র্ক টাইমসের হাতে এ তথ্য এসেছে। এক মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে পত্রিকাটির কাছে এ তথ্য আসে। নিউইয়র্ক টাইমস তাদের প্রতিবেদনে তথ্যসূত্র গোপন রেখেছে।
কিন্তু পরে জানা গেছে, ওই সূত্র হলেন জর্ডান লাসকার। গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিনি একজন সুপরিচিত এবং ব্যাপক সমালোচিত জাতিগত বিশুদ্ধতাবাদী বা শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী।
প্রখ্যাত সাংবাদিক ও গণমাধ্যম উদ্যোক্তা সোলেদাদ ও’ব্রায়েন নিউইয়র্ক টাইমসে জোহরানকে নিয়ে করা ওই প্রতিবেদনকে ‘একটি রসিকতা’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, জোহরান মামদানির ওপর এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা টাইমসের জন্য ‘চরম লজ্জাজনক একটি ঘটনা’।
সোলেদাদ নিজেও মিশ্র জাতিগত পারিবারিক পটভূমি থেকে এসেছেন এবং নিজেকে কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে পরিচয় দেন।
এ ঘটনা একটি বড় বিষয় তুলে ধরেছে। সেটি হলো, জোহরান মামদানির প্রার্থিতা নিয়ে টাইমসের প্রকাশ্য বিরূপ মনোভাব।
পত্রিকাটির মতামত বিভাগ দেখলে এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ প্রায় নেই। যদিও টাইমস এখন মেয়র পদে আর আনুষ্ঠানিক সমর্থন ঘোষণা করে না। তবে পত্রিকাটি একটি সম্পাদকীয়তে ভোটারদের আহ্বান জানিয়েছিল, তাঁরা যেন মামদানিকে তাদের বাছাইয়ে একেবারে স্থানই না দেয়। কারণ, মামদানি অত্যন্ত অযোগ্য প্রার্থী।
টাইমসের মতামত বিভাগ তাদের মতপ্রকাশের অধিকার রাখে, যতই তা ভুল পথে পরিচালিত হোক না কেন। কিন্তু সরাসরি সংবাদ প্রতিবেদনে কোনো প্রার্থীর পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া ঠিক না।
সংবাদ প্রতিবেদন দলনিরপেক্ষ হওয়া উচিত। কোনো প্রার্থীকে উৎসাহ দেওয়া বা কাউকে খোঁড়া করে দেওয়া সংবাদের কাজ নয়।
বাস্তব সংবাদের বেলায় অনেক ক্ষেত্রেই তা একেবারে মানা হয় না।
এই সাজানো কেলেঙ্কারি এবং পূর্ব সম্পাদকীয় মিলিয়ে টাইমস মামদানির বিরুদ্ধে যেন একটি ধর্মযুদ্ধে নেমেছে, এমনই মনে হচ্ছে। আর কোনো আদর্শিক ব্যাখ্যাই এটা ঢেকে রাখতে পারবে না।