ঋণনির্ভর উন্নয়নের চাপ এখন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দৃশ্যমানভাবে স্পষ্ট। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই–সেপ্টেম্বর) বিদেশি ঋণ প্রাপ্তির চেয়ে প্রায় ১৩ কোটি ডলার বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে সরকারকে। ফলে নতুন ঋণ নিয়ে পুরোনো ঋণ পরিশোধের প্রবণতা বাড়ছে, এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকেও ঋণ শোধ করতে হচ্ছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বৈদেশিক ঋণ ছাড় হয়েছে ১১৪ কোটি ৮৫ লাখ ডলার; বিপরীতে পরিশোধ করতে হয়েছে ১২৭ কোটি ৯৯ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে পরিশোধ ছিল ১১২ কোটি ডলার, অর্থাৎ এবার ঋণ পরিশোধ বেড়েছে প্রায় ১৫ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। এর মধ্যে শুধু আসল পরিশোধই বেড়েছে ১৩ কোটি ডলার।
একই সময়ে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে নতুন ঋণের প্রতিশ্রুতি এসেছে ৯১ কোটি ৬ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেশি। তবে প্রতিশ্রুতি বাড়লেও বাস্তবে ঋণ ছাড়ের গতি কমে গেছে, ফলে বড় প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে অর্থের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।
ইআরডি জানায়, পদ্মা রেল সংযোগ, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলসহ কয়েকটি বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। তবে মেট্রোরেল ছাড়া অন্য প্রকল্পগুলো এখনো প্রত্যাশিত আয় দিতে পারছে না। কর্ণফুলী টানেল ও পদ্মা সেতু রেল প্রকল্প থেকে যে আয় হচ্ছে, তা দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণের খরচই কষ্টে মেটানো যাচ্ছে। ফলে এসব প্রকল্পের ঋণ সরকারকে নিজস্ব তহবিল থেকে পরিশোধ করতে হচ্ছে।
বিদায়ী ২০২৪–২৫ অর্থবছরে ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৪০৯ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। আগের দুই অর্থবছরে এ পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৩৩৫ কোটি ও ২৬৭ কোটি ডলার।
এদিকে বাজারভিত্তিক ঋণের সুদের হারও বেড়েছে। ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে সিকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং রেট এখন ৫ শতাংশের ওপরে, যেখানে যুদ্ধের আগে এটি ছিল ১ শতাংশের নিচে। ফলে জাইকা, এডিবি ও অন্যান্য বাণিজ্যিক উৎস থেকে নেওয়া ঋণের ব্যয়ও অনেক বেড়ে গেছে।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আমাদের বৈদেশিক ঋণ যেমন বাড়ছে, তেমনি পরিশোধের চাপও দ্রুত বাড়ছে। আগামী দু–তিন বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ৫ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। রাজস্ব আদায় না বাড়লে এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৃদ্ধি না পেলে এই ঋণচাপ অর্থনীতিতে বড় ধরনের দুর্দশা সৃষ্টি করবে