বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (আরএমজি) রপ্তানিকারকরা সম্প্রতি ভারতের অদৃশ্য এক অশুল্ক বাধার মুখে পড়েছেন, যা বৈশ্বিক বাজারে নতুন সুযোগ কাজে লাগানোর পথে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত কয়েক মাস ধরে দিল্লি, বেঙ্গালুরুসহ ভারতের বিভিন্ন শহরে অবস্থিত বিদেশি বায়ারদের আঞ্চলিক অফিসে কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠানো পোশাকের স্যাম্পল ভারতের কাস্টমস পরীক্ষার নামে দীর্ঘ সময় ধরে আটকে রাখছে, কখনোবা একেবারেই ছাড় করছে না। কখনও তিন সপ্তাহ পর্যন্ত দেরি করা হচ্ছে, আবার অনেক সময় একেবারেই আটকে দেওয়া হচ্ছে। যার ফলে স্প্যারো গ্রুপের মতো রপ্তানিকারকরা বাধ্য হচ্ছেন স্যাম্পল বিমানে লোক মারফত পাঠাতে, যা কুরিয়ার খরচের তুলনায় প্রায় ২০ গুণ বেশি ব্যয়বহুল।
গত বছর প্রায় ৩০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে স্প্যারো গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, “এটা নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার (অশুল্ক বাধা) ছাড়া কিছু না। বাধ্য হয়ে আমাদের ফ্লাইটে হ্যান্ড ক্যারি করতে হচ্ছে।” এমন এক সময়ে এ বাধা তৈরি করা হলো, যখন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতির পরিবর্তনের ফলে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রচুর অর্ডার আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে, আবার গত আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কয়েক মাস যাবত দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কেও শীতলতা বিরাজ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতির সুবিধা কাজে লাগানোর পথে বাধা: রপ্তানিকারকরা আশঙ্কা করছেন, এ প্রতিবন্ধকতা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তুলনামূলক শুল্ক সুবিধাকে ম্লান করে দিতে পারে। কারণ মাঙ্গো, লিভাইস ও মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সারের মতো ব্র্যান্ডগুলো সময়মতো নমুনা অনুমোদন না পেলে অর্ডার দেয় না। ফলাফল; প্রতি ৫ কেজি ওজনের স্যাম্পলের প্যাকেট পাঠাতে আগে যেখানে খরচ হতো পাঁচ হাজার টাকা, সেখানে এখন সময়মতো পৌঁছাতে বিমানে লোক মারফত পাঠাতে খরচ হচ্ছে প্রায় এক লাখ টাকা।
শোভন ইসলাম বলেন, “গত কয়েক মাস ধরে ভারতে তিনটি বিদেশি ক্রেতার অফিসে কুরিয়ারে পোশাকের নমুনা পাঠানো জটিল হয়ে পড়েছে, যা গত দুই মাস ধরে আরও বেড়েছে। ভারতীয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নানা অজুহাতে এগুলো আটকে রাখছে বা ছাড় করছে না। ফলে আমাদের বাধ্য হয়ে বিমানে লোক মারফত পাঠাতে হচ্ছে। এতে ৫ কেজির একটি নমুনা পাঠানোর খরচ পাঁচ হাজার টাকা থেকে বেড়ে প্রায় এক লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।”
এই সমস্যা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রপ্তানিকারককে প্রভাবিত করছে। যেমন ডিবিএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ জব্বার, ফকির ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির কামরুজ্জামান নাহিদসহ আরও তিনজন রপ্তানিকারক ও বায়ারদের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, এখন ভারতে নমুনা পাঠাতে আগের তুলনায় তিন থেকে চার গুণ বেশি সময় লাগছে।
তাদের অভিযোগ, ভারত সরকার লিখিতভাবে কোনো নিষেধাজ্ঞা না দিলেও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে এয়ার কুরিয়ারে পাঠানো এসব নমুনা আটকে দিচ্ছে, তারা এটি করছে বাংলাদেশের রপ্তানিকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য।
ভারতে পুমা, মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সার, এইচঅ্যান্ডএম, লিভাইস ও ম্যাঙ্গোর মতো শীর্ষস্থানীয় বেশকিছু বায়ার ও ব্র্যান্ডের অফিসে নিয়মিত স্যাম্পল পাঠাতে হয় বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের। যেখানে ভারতে বা তৃতীয় কোনও দেশে রপ্তানি করার জন্য অনুমোদন নিতে হয়। সাধারণত পোশাক তৈরি করার আগে একবার স্যাম্পল পাঠিয়ে অনুমোদন নিতে হয়, আর পণ্য তৈরির পর ফাইনাল শিপমেন্ট করার আগে দৈবচয়নের ভিত্তিতে নমুনা নির্বাচন করে সেগুলো পাঠিয়ে অনুমোদন নিতে হয়। আবার স্টোরগুলোতে কাস্টমারকে পণ্য দেখানোর জন্যও কিছু নমুনার প্রয়োজন হয়, যা সেলসম্যান স্যাম্পল হিসেবে পরিচিত। নমুনা অনুমোদন না হলে পণ্য তৈরি হলেও তার চালান পাঠান যায় না। ফলে বাড়তি খরচ করে হলেও রপ্তানিকারকদের আকাশপথ বা বিকল্প উপায়ে স্যাম্পল পাঠাতে হচ্ছে।
পোশাকের বেশিরভাগ নমুনাই কাস্টমসে বিলম্বের শিকার: ভারতে অধিকাংশ তৈরি পোশাকের নমুনা পাঠানো এখন বিলম্বিত হচ্ছে। রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন, বর্তমানে ভারতে পাঠানো অধিকাংশ নমুনার কুরিয়ার চালান ভারতীয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বিলম্বিত করছে, আটকে দিচ্ছে কিংবা পণ্যমূল্যের সীমাবদ্ধতা আরোপ করছে। যেখানে ৩–৫ দিনে চালান পৌঁছানোর কথা, এখন তা পৌঁছাতে সময় লাগছে ১৫–২০ দিন, আর কিছু চালান একেবারেই আটকে দেওয়া হচ্ছে।
শোভন ইসলাম বলেন, তিনি নিয়মিতভাবে মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সার, লিভাইস ও ম্যাঙ্গোর রিজিওনাল অফিসে অনুমোদনের জন্য নমুনা পাঠান—যার মধ্যে দুটি দিল্লি এবং একটি বেঙ্গালুরুতে অবস্থিত। তিনি বলেন, “কিন্তু ইন্ডিয়ান কাস্টমস কর্তৃপক্ষ কুরিয়ার চালান হয় আটকে দিচ্ছে, নয়তো ডিলে (বিলম্ব) করছে। ফলে এখন বাধ্য হয়ে বিমানে ব্যক্তির মাধ্যমে হ্যান্ড ক্যারি করে পাঠাতে হয়, সেখান থেকে আবার কুরিয়ারে বায়ারদের অফিসে পাঠাতে হয়।”
এমন সমস্যার কথা জানিয়েছেন ঢাকায় পুমার কান্ট্রি ম্যানেজার মঈন হায়দার চৌধুরী-ও। টিবিএসকে তিনি বলেন, “ইন্ডিয়াতে আমাদের প্রায় ১,০০০ স্টোর আছে। সেখানে নিয়মিত স্যাম্পল পাঠানোর প্রয়োজন হয়, কিন্তু এয়ার বা এয়ারের মাধ্যমে কুরিয়ারে কোন শিপমেন্ট অ্যালাও করছে না। এর ফলে কিছু হ্যান্ড ক্যারি করে নিয়ে যেতে হচ্ছে।” “এ কারণে আমাদের ভেন্ডরদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে” – উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এ পরিস্থিতিতে এখন আমরা জাহাজের মাধ্যমে স্যাম্পল পাঠানোর পরিকল্পনা করছি।” রপ্তানিকারক ও কুরিয়ার কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এয়ারের মাধ্যমে কুরিয়ারে নমুনা পাঠাতে সময় লাগে ৪ কর্মদিবস, অন্যদিকে জাহাজের মাধ্যমে পাঠাতে সময় লেগে যায় তিন সপ্তাহের মত।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সিনিয়র সহ-সভাপতি ইনামুল হক খান বাবলু টিবিএসকে বলেন, “বায়ার ও রপ্তানিকারক উভয়ের কাছ থেকেই আমরা অভিযোগ পেয়েছি যে, এয়ার কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠানো স্যাম্পল ভারতের কাস্টমসে আটকে দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানানোর পরিকল্পনা করছি।”
তিনি অভিযোগ করেন, অনেক আগে থেকেই ভারত বাংলাদেশের স্যাম্পল পাঠানোর ক্ষেত্রে ছাড়পত্রে জটিলতা তৈরি করছে। “তবে যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফ রেট নির্ধারণের পর এই সমস্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে, ১৫ থেকে ২০ দিন দেরি করা হচ্ছে – যা অপ্রয়োজনীয়।”
এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্ক কাঠামোতে ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ হারে শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের রপ্তানির ক্ষেত্রে তা ২০ শতাংশ। ফলে বেশকিছু বায়ার, যারা এতদিন ভারত থেকে পণ্য সংগ্রহ করত, তারা এখন বাংলাদেশে অর্ডার সরিয়ে আনছে বা আনতে চাচ্ছে। এখন হয়তো এর মাধ্যমে (কুরিয়ার পাঠানোয় জটিলতা সৃষ্টি) এই পরিবর্তনটা আটকানোর চেষ্টা করছে।”
তিনি বলেন, “এই সমস্যা আগামীতে হয়তো আরো হবে বলে আমরা মনে করছি। এ অবস্থায় আমাদের বায়াররা-ও অপ্রস্তুত হয়ে গেছেন। ডিএইচএল, ফেডেক্স, ইউপিএস, আরামেক্স-সহ বাংলাদেশেস ৫৫টি নিবন্ধিত কুরিয়ার কোম্পানি আছে।
ডিএইচএল -এর রপ্তানি বিভাগে কর্মরত একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, “ভারতে মেইড ইন বাংলাদেশ নামে কোনো ফেব্রিকের চালান থাকলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আটকে ফেলে, কারণ তাদের সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের এক্সপোর্ট এর ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আছে।”
“রপ্তানিকারকদের তাই আমরা পরামর্শ দিই কোন স্যাম্পল পাঠানোর আগে ওখানকার প্রাপকের সাথে যোগাযোগ করে নিতে, যাতে তারা লোকাল ফেডেক্স এর সাথে যোগাযোগ করে দেখে, ওই আইটেম ছাড়াতে পারবে কিনা” –বলেন তিনি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রপ্তানি অনুবিভাগের যুগ্মসচিব নারগিস মুরশিদা টিবিএসকে বলেন, “আমরা এখনো রপ্তানিকারকদের কাছ কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে পরবর্তী করণীয় ঠিক করব।” টিবিএস এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের সঙ্গে ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করলেও বুধবার পর্যন্ত কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
বাণিজ্যে বাধার মধ্যেও রপ্তানি বেড়েছে ভারতে: ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন এবং তার ভারতে আশ্রয় নেওয়া নিয়ে উভয় দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক শীতল রূপ নেয়। আওয়ামী সরকার পতনের প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই বাংলাদেশি পর্যটকদের ভারতে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়, এরপরে বাংলাদেশি বিভিন্ন পণ্যেও একের পর এক বিধিনিষেধ দিতে শুরু দেশটি। কয়েক দফায় ভারত বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য পণ্যের ওপর স্থলবন্দর দিয়ে দেশটিতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়। বন্ধ করে দেয় দেশটির বন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধাও।
অন্যদিকে বাংলাদেশও স্থানীয় টেক্সটাইল মিল মালিকদের দাবির প্রেক্ষিতে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি ঠেকাতে স্থলবন্দর ব্যবহার করে ভারত থেকে সুতা আমদানি বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে কেবল ভারতের মুম্বাইয়ের নভসেবা বন্দর দিয়ে সেখানে রপ্তানি করা যাচ্ছে।
এতসব বিধিনিষেধ সত্ত্বেও দেশটিতে গত জুলাই মাসে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বেড়েছে। সরকারি হিসেবে, গত জুলাইয়ে ভারতে বাংলাদেশ আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ শতাংশ বেশি রপ্তানি করেছে। আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও তার আগের বছরের তুলনায় দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে ১২ শতাংশের বেশি, যার পরিমাণ ১৭৬ কোটি ডলার। সংবাদসুত্র টিবিএস