বাংলাদেশের বিগত সরকারের সময়ে ব্যাপক দুর্নীতির কারণে অর্থনীতিতে ধস নামে। অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন কর্মকাণ্ড গ্রহণ করলেও এখনো সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। বিশ্ব বাণিজ্যের টানাপোড়েনে আছে বাংলাদেশের অর্থনীতি।
সামনে রয়েছে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ। বিনিয়োগকারীদের আস্থা আসছে না। বাড়ছে না শিল্প বিনিয়োগ। অন্তর্বর্তী সরকারের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও অর্থনীতি এখনো সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। পরিকল্পনা কমিশনের এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। এটি প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রণীত জাতীয় পর্যায়ের একটি পর্যালোচনামূলক প্রতিবেদন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ব বাণিজ্যের প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতে। ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেও দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও রাজস্ব আদায় বাড়েনি, বেড়েছে ঘাটতি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিভক্তি নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর আন্দোলনে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম সংঘটিত হয়। এসব কারণেও রাজস্ব সংগ্রহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের পর্যাপ্ত আয় না থাকায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে। উন্নয়ন কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমেছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) অর্থনৈতিক হালনাগাদবিষয়ক ওই প্রতিবেদনে দেশের অর্থনীতির গতিপথ নিয়ে বলা হয়েছে, চ্যালেঞ্জের মধ্যেও চলতি জুলাই মাসে দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের ঈঙ্গিত দেখা দিয়েছে।
জাতিসংঘে টেকসই উন্নয়নবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক ফোরামেও প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়েছে। এ সময় ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে আরও ছিলেন এসডিজির প্রধান সমন্বয়কারী লামিয়া মোর্শেদ এবং এসডিজি মহাপরিচালক শিহাব কাদের।
বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ অত্যন্ত কম রয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এর অন্যতম কারণ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপ।
প্রতিবেদনে অর্থনীতিকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে এবং ভবিষ্যতের ধাক্কা সামলাতে নতুন উদ্ভাবনে জোর দিয়ে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দারিদ্র্যমুক্ত, ক্ষুধামুক্ত, সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ, মানসম্মত শিক্ষা, বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন, জ্বালানি ও শিল্প, উদ্ভাবন, অবকাঠামোর মতো বিষয়ে লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের প্রস্তুতি সন্তোষজনক। তবে অনেক বিষয়ে এখনো পিছিয়ে। পিছিয়ে থাকা বিষয়ের মধ্যে রয়েছে লিঙ্গ সমতা, সম্পদের বৈষম্য কমানো, টেকসই উন্নয়ন, জীবনযাত্রা ও অংশীদারত্বের মতো পদক্ষেপ। এসব ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না হওয়ার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাকে দায়ী করা হয়েছে। প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, সরকার বিভিন্ন সংস্কার উদ্যোগের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়াতে জোর দিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের মাঝামাঝিতে রাজনৈতিক পরিবর্তন দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নতুন সরকার সংস্কার ও জবাবদিহির অঙ্গীকার করেছে। আগের সরকারের দমনমূলক শাসনব্যবস্থার ফলে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার টাস্কফোর্স গঠন করেছে। মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসন, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন, লিঙ্গবৈষম্য দূর করার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাত আছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা দ্রুত অর্জনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর জোর দিয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা; ডিজিটাল পরিষেবা বৃদ্ধি; জলবায়ু-সহনশীল স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন; পরিকল্পনায় স্বচ্ছতা, প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়নের মধ্যে ব্যবধান কমানোতে গুরুত্ব দিয়েছে। ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত অর্থনীতিতে উত্তরণের জন্য নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে এবং রপ্তানি বাড়াতে হবে।
প্রতিবেদনে স্পষ্ট জানানো হয়েছে, বোরোর বাম্পার ফলনের পরও চালের দাম বেশি। সার, বীজ, শ্রমিক, সেচের খরচও বেড়েছে। ফসল কাটার পর ক্ষতি ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণে চালের দাম বেড়েছে। এ ছাড়া বেশি দাম পাওয়ার আশায় মজুত করার কারণেও চালের দাম বেড়েছে। চালের দাম কমাতে সরকার তদারকির ওপর জোর দিয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো চলতি অর্থবছরের জন্য তাদের পূর্বাভাস কমিয়েছে। বিশ্বব্যাংক ৩ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে ৪ দশমিক ১ শতাংশ এর মধ্যে প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে, যেখানে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে এটি ৩ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে। এসব প্রতিষ্ঠান ২০২৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ১ শতাংশ থেকে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ প্রাক্কলন করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের জুনের মাঝামাঝি থেকে জুলাইয়ের প্রথম দিকে মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল ছিল। প্রতি মার্কিন ডলার ১২২ দশমিক ৪৫ থেকে ১২২ দশমিক ৭০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে। ছয় মাস ধরে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, কঠোর মুদ্রানীতি এবং দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে আমানত ও ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থ পাচার কমার ফলে দেশে অর্থের সরবরাহ বেড়েছে।