নজরুল ইসলাম মিন্টু: যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি আজ আর শুধু সাদা, কৃষ্ণ কিংবা লাতিনো প্রার্থীদের হাতে সীমাবদ্ধ নয়। দক্ষিণ এশীয় বিশেষ করে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের অংশগ্রহণ দিন দিন চোখে পড়ার মতোভাবে বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে উঠে এসেছেন এক নতুন নাম মেরি জোবাইদা। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই নারী এখন নিউ ইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলি নির্বাচনের একজন উল্লেখযোগ্য প্রার্থী। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, পেশাগত অভিজ্ঞতা, শিক্ষা এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশের গল্প শুধু অনুপ্রেরণার নয়; এটি যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশিদের স্বপ্ন ও সম্ভাবনার একটি প্রতীকও।
মেরি জোবাইদার জন্ম বাংলাদেশের বরিশালে। ঢাকার লালমাটিয়া মহিলা কলেজে পড়াশোনা করে তিনি ঢাকা সিটি কলেজে সাহিত্য বিভাগে লেখাপড়া করেন। এরপর পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে, যেখানে তিনি নিজের পরিচয় গড়ে তুলেছেন কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও প্রগতিশীল আদর্শের মাধ্যমে।
যুক্তরাষ্ট্রে এসে তিনি লা গার্ডিয়া কমিউনিটি কলেজে ভর্তি হন, যেখানে মিডিয়া ও কমিউনিকেশন স্টাডিজে পড়াশোনা করেন। এরপর নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে (NYU) অধ্যয়ন করেন এবং সেখান থেকে ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন মিডিয়া, কালচার অ্যান্ড কমিউনিকেশন ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে একই প্রতিষ্ঠান থেকে মাস্টার্স অব আর্টস ইন এডুকেশন সম্পন্ন করেন।
মেরি জোবাইদার স্বামী আবু তাহের নিউ ইয়র্কের অন্যতম জনপ্রিয় বাংলা চ্যানেল টাইম টেলিভিশন-এর প্রধান নির্বাহী (CEO) এবং সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকার সম্পাদক। একজন সফল মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবু তাহের নিউ ইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে পরিচিত ও সম্মানিত নাম। তাঁর এই সাংবাদিকতা ও সম্প্রচারজগতের অভিজ্ঞতা মেরির রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
মেরি জোবাইদার পেশাগত জীবন শুরু হয় শিক্ষা খাত দিয়ে। তিনি Niagara Falls City School District-এ কাজ করেছেন, এরপর নিউ ইয়র্ক সিটি ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশন-এর অধীন P.S. 111 Jacob Blackwell স্কুলে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকতা করেন। পাশাপাশি, The New York Public Library (NYPL)-এ ইংরেজি ভাষার প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন, যেখানে প্রবাসী সম্প্রদায়ের শিক্ষা উন্নয়নে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য।
শুধু শিক্ষকতা নয়, তিনি যুক্ত ছিলেন Urban Health Plan, Inc.-এ আউটরিচ স্পেশালিস্ট হিসেবে, যেখানে তিনি স্বাস্থ্যসেবা ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তিনি নিউ ইয়র্ক থেকে প্রচারিত টাইম টেলিভিশনের প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন, যা তাঁর মিডিয়া জ্ঞান ও নেতৃত্ব দক্ষতাকে আরও শাণিত করে।
তাঁর সাংবাদিকতাও আলাদা করে বলার মতো। তিনি The Weekly Bangla Patrika-তে ফিচার রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছেন, যেখানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জীবন, সংগ্রাম ও সফলতার গল্প তুলে ধরেন।
জোবাইদার নেতৃত্বগুণ বিকশিত হয় ছাত্রজীবন থেকেই। তিনি LaGuardia CC Student Government Association-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং CUNY-এর অধীন USS (University Student Senate)-এর কমিটি অফ দ্য চাইল্ড কেয়ার সার্ভিস-এর চেয়ারও ছিলেন। এ সময় তিনি শিশু যত্ন সেবার অধিকার নিয়ে সক্রিয় ছিলেন।
২০২০ সালে, তিনি প্রথম নিউ ইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলি ডিস্ট্রিক্ট ৩৭-এ প্রার্থী হন এবং মাত্র ১,৫০০ ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে দমাতে পারেনি। বরং নতুন করে আত্মপ্রত্যয়ী করে তোলে।
এবার (২০২৫) যখন জোহরান মামদানি মেয়র প্রার্থিতা গ্রহণ করেন, তখন তাঁর অ্যাসেম্বলি আসন ডিস্ট্রিক্ট ৩৬-এর শূন্যতা তৈরি হয়, আর ঠিক তখনই মেরি জোবাইদা এই আসনে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘জোহরানের বিজয়ের পর কমিউনিটির অনেকেই বলল, তুমি চুপ করে বসে থাকতে পারো না, তোমাকেই দাঁড়াতে হবে।’
তিনি তাঁর প্রার্থিতার পেছনে একটি বড় দর্শনের কথা বলেন, ‘আমি এমন এক নিউ ইয়র্ক স্টেট গড়তে চাই, যেখানে সবাই নিজেকে দেখা, শোনা, যত্ন ও গ্রহণযোগ্য মনে করবে’। তাঁর মতে, ‘আমরা বর্তমানে এক গভীর অনিশ্চয়তার সময় পার করছি যেখানে সাধারণ মানুষ ক্রমাগত ভয় ও চাপের মধ্যে রয়েছে, এমনকি সেই রাষ্ট্রপ্রধানের কাছ থেকেও, যার দায়িত্ব ছিল জনগণকে আশ্বাস ও নিরাপত্তা দেওয়া।’
জোবাইদা নিজেকে Democratic Socialists of America (DSA)-এর সদস্য হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি চান একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ, যেখানে CUNY ও SUNY-তে ফ্রি শিক্ষা, ইউনিভার্সাল চাইল্ড কেয়ার, এবং নিউ ইয়র্কবাসীর মৌলিক চাহিদা পূরণে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা থাকবে। তিনি মনে করেন, ক্ষুধার কারণে কেউ খাবার চুরি করলে তাকে অপরাধী হিসেবে গ্রেপ্তার করা উচিত নয়; বরং তা প্রতিরোধের জন্য সামাজিক কাঠামো গড়ে তোলা উচিত।
মেরি জোবাইদার গল্প নিছক একটি রাজনৈতিক প্রার্থীতার কাহিনি নয়; এটি প্রমাণ করে যে, অভিবাসী পরিচয় কোনো বাধা নয়, বরং তা হতে পারে এক শক্তি। নিউ ইয়র্কের মতো শহরে, যেখানে বাংলাদেশি অভিবাসীদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, সেখানে এমন প্রার্থিতা প্রজন্মান্তরে প্রভাব ফেলবে।
এই শহরে এর আগে আমরা পেয়েছি শাহানা হানিফকে, যিনি প্রথম বাংলাদেশি-আমেরিকান নারী নিউ ইয়র্ক সিটি কাউন্সিল মেম্বার। মেরি জোবাদিয়া সেই ধারাবাহিকতায় আরেকটি নাম, যিনি নিজেকে আরও বিস্তৃত দায়িত্বে দেখতে চান।
মেরি জোবাইদা শুধু একজন প্রার্থী নন, তিনি প্রবাসী নারীদের জন্য একটি প্রতীক। একজন মা, একজন শিক্ষিকা, একজন কমিউনিটি সংগঠক, একজন সাংবাদিক, এবং এখন একজন রাজনীতিক। তাঁর এই যাত্রা প্রমাণ করে, যদি লক্ষ্য স্থির থাকে এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা হৃদয়ে ধারণ করা যায়, তবে রাজনীতির সর্বোচ্চ শিখরেও পৌঁছানো অসম্ভব কিছু নয়।
নিউ ইয়র্কের এই নির্বাচন কেবল একটি আসন নিয়ে নয়, এটি প্রবাসী বাংলাদেশিদের সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান, প্রতিনিধিত্ব এবং নেতৃত্বের প্রশ্নে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মেরি জোবাইদা সেই অধ্যায়ের কেন্দ্রবিন্দুতে। তিনি নিজেই হয়তো সেই ইতিহাসের নতুন পৃষ্ঠা হয়ে উঠতে চলেছেন। নজরুল ইসলাম মিন্টু লেখক ও সাংবাদিক, টরন্টো থেকে প্রচারিত দেশে বিদেশে টিভির সত্তাধিকারী