বাংলাদেশীদের জন্য ঘটনাবহুল ও রাজনৈতিক বাঁকবদলের আগস্ট মাসের সমাপ্তি ঘটছে আজ। এ সময়ের মধ্যে ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যাপক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশ। দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় দোর্দণ্ড প্রতাপের সঙ্গে শাসন করার পর দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ আমলে মামলা ও হয়রানির শিকার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠন হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। মুক্তি পেয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
আগস্ট মাসের সূচনা হয়েছিল ব্যাপক উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে। আগের ১৫ দিনে দেশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনগুলোর হামলায় ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। আন্দোলন দমনের অংশ হিসেবে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে। আবার আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক ডিবি পুলিশের হেফাজতে। শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও নেমে এসেছেন রাস্তায়। নামতে শুরু করেছে জনসাধারণও। প্রতিদিনই ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হচ্ছে আন্দোলন। এর ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্ট এ আন্দোলন রূপ নেয় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে। দেশ ছেড়ে পালান শেখ হাসিনা।
ভেঙে পড়ে গত দেড় দশকের স্বৈরশাসনে দুর্বল হয়ে পড়া রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম প্রায় তিনদিন প্রশাসনশূন্য অবস্থায় ছিল বাংলাদেশ। এরপর ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা শপথ নেন। একটু একটু করে স্বাভাবিক হতে থাকে পরিস্থিতি। এর মধ্যেই উজানি ঢল ও অতিবৃষ্টিতে বন্যা দেখা দেয় দেশের পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোয়, যা কয়েক দশকের মধ্যে ভয়াবহতম আকার নেয় দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় চারটি জেলায়। এ বন্যার পানি এখন কমতে থাকলেও এখনো এর অভিঘাত মোকাবেলা করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
শুধু ২০২৪ সাল নয়, স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশকে এমন বেশ কয়েকবার ঘটনাবহুল আগস্টের সাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ১৯৭১ যেমন আছে, তেমনি আছে ১৯৭৪, ১৯৭৫, ২০০৪ ও ২০০৫।
১০ আগস্ট, ১৯৭১
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধর সময় আগস্টে শেখ মুজিবকে ফাঁসি দেয়ার একটি পরিকল্পনার খবর বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ওই মাসের ১০ আগস্ট ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জাতিসংঘ মহাসচিব বরাবর এ-সংক্রান্ত একটি জরুরি বার্তা পাঠান। ওই বার্তায় তিনি শেখ মুজিবকে হত্যার পরিকল্পনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ দেয়ার জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের নেতাদের পাশাপাশি জাতিসংঘের কাছে বার্তা দেন। পরবর্তী সময়ে ইয়াহিয়া খানের ঘোষণার মধ্য দিয়ে মুজিবের রাষ্ট্রদ্রোহের বিচার স্থগিত হয় এবং ইন্দিরা গান্ধীর সতর্কতাটি সফলতার মুখ দেখে।
২০ আগস্ট, ১৯৭১
বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবপ্রাপ্ত সাতজন মুক্তিযোদ্ধার অন্যতম ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান। তিনি পাকিস্তান বিমানবাহিনী একাডেমিতে যোগ দিয়ে ১৯৬৩ সালের জুনে কমিশন লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করেন তিনি। তার লক্ষ্য ছিল, বিমান ছিনতাই করে সেটি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবেন। ১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট সকালে করাচির মশরুর বিমানঘাঁটি থেকে পাইলট অফিসার মিনহাজ রশিদের টি-৩৩ বিমান নিয়ে ওড়ার শিডিউল ছিল। মতিউর ছিলেন তার প্রশিক্ষক। টি-৩৩ বিমানের সাংকেতিক নাম ছিল ব্লু বার্ড। প্রশিক্ষণকালে মতিউর বিমানটির নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। বিমানটি বিধ্বস্ত হয় ভারতীয় সীমান্তের কাছে থাট্টায়। মতিউরের মৃতদেহ ঘটনাস্থলের কাছাকাছি পাওয়া গেলেও মিনহাজের লাশের কোনো হদিস মেলেনি। মতিউর রহমানকে দাফন করা হয় মশরুর বিমানঘাঁটির চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের কবরস্থানে। দেশপ্রেম ও আত্মদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
১৯৭৪ সালের আগস্টের বন্যা
১৯৭৪ সালের আগস্টে বৃহত্তর ময়মনসিংহসহ দেশের মধ্যাঞ্চল ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে। ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি অঞ্চল এতে আক্রান্ত হয়। লাখ লাখ ঘরবাড়ি তলিয়ে যায়। মৃত্যু হয় বহু মানুষের। দুর্ভিক্ষ চলাকালীন বন্যা হওয়ায় খাদ্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ মাসের ১০ আগস্ট বাংলাদেশকে জরুরি ত্রাণসহায়তার জন্য সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি আহ্বান জানান। এদিন দুর্গতদের জন্য জাতিসংঘ ত্রাণ তহবিল ২০ হাজার ডলার মঞ্জুর করে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সামরিক বাহিনীর কয়েকজন জুনিয়র অফিসারের অভ্যুত্থানে সপরিবার নিহত হন শেখ মুজিবুর রহমান। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে অভ্যুত্থানকারী সেনাসদস্যদের গুলিতে আরো মারা যান বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব, ছোট ভাই শেখ আবু নাসের, বড় ছেলে শেখ কামাল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল খুকী, মেজো ছেলে শেখ জামাল, পুত্রবধূ পারভীন জামাল রোজী ও ছোট ছেলে শেখ রাসেল। ওইদিন সেখানে বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ (মরণোত্তর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদাপ্রাপ্ত) ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তারও মৃত্যু হয়। অভ্যুত্থানকারী সেনা কর্মকর্তারা সেদিন শেখ মুজিবের ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে হামলা চালায়। সেখানে আবদুর রব সেরনিয়াবাত ছাড়াও মৃত্যু হয় আরিফ সেরনিয়াবাত, বেবী সেরনিয়াবাত, শহীদ সেরনিয়াবাত, সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, নাঈম খান রিন্টু, গৃহভৃত্য পোটকা ও লক্ষ্মীর মার। হামলা চালানো হয় শেখ মুজিবের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির বাড়িতেও। সেখানে শেখ ফজলুল হক মনি ও তার স্ত্রী আরজু মনি মারা যান।
খন্দকার মোশতাকের সরকার গঠন
শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের দিন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। ক্ষমতা গ্রহণের সময় প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত করেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। ফলে তার সেই সরকারে ১২ জন মন্ত্রী এবং ১১ জন প্রতিমন্ত্রী থাকলেও কোনো প্রধানমন্ত্রী পদ ছিল না। এ মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়া ২৩ সদস্যের ২২ জনই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের (বাকশাল) মন্ত্রিসভার। ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট খন্দকার মোশতাক সামরিক আইন জারি করেন এবং নিজেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নেন।
১৯৮১ সালের ১৩ আগস্ট
১৯৭০ সালের সাইক্লোনে বঙ্গোপসাগরে সাতক্ষীরার অদূরবর্তী স্থানে জেগে ওঠে একটি দ্বীপ। ১৯৭৪ সালে আমেরিকার ভূ-উপগ্রহ ইআরটিএস-১ সর্বপ্রথম দ্বীপটির অবস্থান শনাক্ত করে। এরপর বাংলাদেশ ও ভারত উভয়েই দ্বীপটির মালিকানা দাবি করে। দ্বীপ নিয়ে বিবাদের মীমাংসার জন্য ১৯৭৯ সালে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে ভারতে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৮১ সালের ১১ মে ভারত দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপে নৌজাহাজ পাঠায় এবং সেখানে বিএসএফ (ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী) চৌকি স্থাপন করে। দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপে উড়তে থাকে ভারতের পতাকা। বাংলাদেশ এ ঘটনার দুদিন পর ১৩ মে কোস্টগার্ডের দুটি গানবোট প্রেরণ করে এবং বিএসএফের চৌকিতে হামলা চালায়। অস্ত্রের যুদ্ধে না জড়িয়ে ভারত দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয় এবং দ্বীপটিকে নো ম্যান’স ল্যান্ড ঘোষণা করে। ১৯৮১ সালের ১৩ আগস্ট বাংলাদেশের সংবাদপত্রে এ ঘটনার সংবাদ ছাপে এবং বাংলাদেশের প্রতিবাদের বিষয়টি প্রকাশ পায়।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এতে দলের নেতা-কর্মীসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন শেখ হাসিনাসহ দলের কয়েকশ নেতা-কর্মী। আওয়ামী লীগ অভিযোগ করে আসছে, ‘রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের’ সহায়তায় ওই হামলার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা করা হয়েছে। অনেকে মনে করেন, ১৫ অগাস্টের পরে ওই হামলার ঘটনা ছিল আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে বড় আঘাত। ফলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক যে তিক্ততা শুরু হয়েছে, এখনো তার সমাধান হয়নি।
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলা
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশে একযোগে সিরিজ বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) ওইদিন বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে দেশের ৬৩ জেলার প্রেস ক্লাব, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও ঢাকার ৩৪টিসহ সাড়ে চারশ স্পটে প্রায় পাঁচশ বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। ওই হামলায় দুজন নিহত এবং দুই শতাধিক মানুষ আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। ৬৪ জেলার মধ্যে মুন্সিগঞ্জ জেলা বাদে অবশিষ্ট ৬৩টি জেলায় এ হামলা করা হয়। হামলার জায়গাগুলোয় জেএমবির পক্ষ থেকে লিফলেট ছড়ানো হয়। পুলিশ সদর দপ্তর ও র্যাবের তথ্য অনুযায়ী, ঘটনার পর পরই সারা দেশে ১৫৯টি মামলা দায়ের করা হয়।