২৭শে আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ধর্ম ও সংস্কৃতির পার্থক্য বোঝা গুরুত্বপূর্ণ

বাঙালিয়ানার বিরুদ্ধে মগজ ধোলাইয়ের এক ধরনের প্রবণতা চলছে বাংলাদেশে। এ কথা সত্যি যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কারণে আমাদের পরিচয় বাংলাদেশি হতেই পারে। কিন্তু আমাদের এই পরিচয় প্রধানত রাজনৈতিক, নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানায় আবদ্ধ। আমরা এই ভৌগোলিক সীমানাকে অস্বীকার করি না বলেই রাজনৈতিক অর্থে বাংলাদেশি বলে পরিচিতি লাভে কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু এই পরিচয়কে আমাদের মূল নৃতাত্ত্বিক পরিচিতির প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা বহু দশক ধরে চলে আসছে। আমরা বাঙালি– এটিই হচ্ছে আমাদের প্রধান নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি। ধর্ম ও জাতীয়তার অজুহাত দিয়ে বাঙালির বাঙালিত্বকে খাটো করে রাখার এ প্রয়াস ও প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আমাদের শিকড় থেকে উপড়ে ফেলা হবে।

ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতীয়তা যে অভিন্ন বিষয় নয়, সেই কথাটি আবেগ নয়, বরং যুক্তি দিয়ে বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে। এই যেমন নারীদের কপালে টিপ পরা ‘হিন্দুয়ানি’ সংস্কৃতি– কেউ কেউ তা মনে করেন। তাদের মনে দুটি বিষয় ক্রিয়াশীল। একটি সাম্প্রদায়িকতা, অপরটি ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ে ব্যর্থতা। টিপ এক ধরনের প্রসাধনী, বাঙালি নারীর সাজসজ্জার অন্যতম উপাদান। টিপের সঙ্গে কোনো এককালে পূজা-অর্চনার সংযোগ থাকলেও বাঙালি নারীরা টিপ পরাকে কোনো ধর্মীয় আচার-উপাচার হিসেবে দেখেন না। ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে বাঙালি নারীরা টিপ পরেন প্রসাধনের উপাদান হিসেবে।
ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচারে পার্থক্য থাকা বিচিত্র কিছু নয়। কারণ এ ধরনের পার্থক্যই মূলত একেকটি ধর্মের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনকি একের ধর্ম অপরের জন্য অধর্ম হতে পারে। প্রতিমা পূজা মুসলমানদের জন্য পাপের সমতুল্য; গোমাংস ভক্ষণ হিন্দুদের জন্য গর্হিত কাজ এবং অধর্মই বটে। খ্রিষ্ট ধর্মে যে ‘ট্রিনিটির’ ধারণা, যেখানে ঈশ্বর একাধারে পিতা, পুত্র এবং আত্মা (যাকে পবিত্র প্রেতাত্মাও বলা হয়)। সেই বিশ্বাসটি হিন্দু কিংবা মুসলিম কারও কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এই পার্থক্যকে মেনে নিতেই হয়। কিন্তু এই তফাত মানুষের সঙ্গে মানুষের বৈরী সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পারে না।

ইসলাম একটি বৈশ্বিক ধর্ম। এটির উৎপত্তি আরব দেশে হলেও এর সঙ্গে আরব্য সংস্কৃতি এবং আরবি ভাষাকে মিশিয়ে ফেলা ঠিক নয়। আজকাল বাংলাদেশে আরবদের কায়দায় পোশাক পরার যে ফ্যাশন লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তার কারণ ধর্মীয় নয় আদৌ। ইসলাম এবং সব ধর্মেই রুচিসম্মত এবং শালীনতার সঙ্গে পোশাক পরা গ্রহণযোগ্য; নির্দিষ্ট কোনো পোশাকের কথা সেখানে আদৌ বলা হয়নি। আরব দেশে বিয়ে এবং শুভকাজে যে উলুধ্বনি দেওয়ার রেওয়াজ আছে, সে তো সে দেশেরই সংস্কৃতির অংশ। আফ্রিকায় ধর্ম নির্বিশেষে যে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রয়েছে, তা তো কখনোই ধর্মীয় কারণে নিষিদ্ধ হয়নি।
টিপকে তিরস্কার করায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে বটে, সামাজিক মাধ্যম, সংবাদমাধ্যমসহ সর্বত্র কিন্তু এই আদর্শিক লড়াইকে বাংলাদেশে টিকিয়ে রাখতে হলে শুধু টিপকে সমর্থন নয়, বাঙালি সংস্কৃতি লালন করতে হবে জীবনের সর্বত্রই। বাঙালি সংস্কৃতি স্বাধীন বাংলাদেশে যদি লালিত ও সমৃদ্ধ না হয়, তাহলে এর স্থান হবে কোথায়? বাঙালিবিরোধী এই মগজ ধোলাইয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের শিক্ষাসূচিতে বাঙালি সংস্কৃতির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। নইলে বাঙালি সংস্কৃতির পক্ষে এই তাৎক্ষণিক এবং আবেগাপ্লুত সমর্থন দীর্ঘস্থায়ী হবে না। টিপ তো কেবল প্রতীক মাত্র। বাঙালি সংস্কৃতিকে সার্বিকভাবে লালন এবং সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করা এখন বাংলাদেশের মানুষের আশু কর্তব্য।

এ কথা সত্যি, এক সময়ে হিন্দুরাও মনে করত, মুসলমানরা বাঙালি নয়। এর কারণ হলো, অধিকাংশ মুসলমান তখন ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে এই ভেদরেখা টানতে পারত না। ধর্মাচারের আলোকে সংস্কৃতিকে দেখত। সম্ভবত সে কারণেই স্বয়ং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে নির্দ্বিধায় লিখলেন ‘বাঙালি ও মুসলমানদের মধ্যে’ ফুটবল ম্যাচের কথা। শরৎচন্দ্র ধরেই নিয়েছিলেন– মুসলমানরা বাঙালি নয়। যেমন মুসলমানরাও ভাবত, তারা বাঙালি না। যেন ভিন্ন গ্রহ থেকে আসা মানুষ; যে রকমটি মনে করে এখনও বাংলাদেশের এক শ্রেণির মানুষ। এ কথা সত্যি, ভারতবর্ষে ইসলাম এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে; ইরান কিংবা ইরাক থেকে। কিন্তু সে তো কেবল ধর্মের কথা। ওদের সংস্কৃতির কেন সংক্রমণ ঘটবে আমাদের সমাজে!

যিশু খ্রিষ্টের জন্ম বর্তমান ফিলিস্তিনের বেথলেহেম শহরে। তাই বলে কি বাঙালি খ্রিষ্টান আরব্য সংস্কৃতির চর্চা করে? আমার কাছে মনে হয়, মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের যে হাজার হাজার লোক যাচ্ছে, তারা সঙ্গে করে শুধু বৈদেশিক মুদ্রাই আনছে না; আনছে ভিনদেশি সংস্কৃতিও। সে জন্যই এখন লক্ষ্য করি, গ্রামগঞ্জের মুসলমান নারী-পুরুষ আরব্য সংস্কৃতিকে ইসলামী সংস্কৃতি বলে গ্রহণ করছে। তারা জানে না, সংস্কৃতির মধ্যে শুধু সেই অংশেই ধর্মের প্রভাব থাকে, যেটি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ধর্মাচারের বাইরে সংস্কৃতিটি অঞ্চলভিত্তিক। লক্ষ্য করার বিষয়, আরবরা কিন্তু নিজেদের মুসলমান বলে পরিচয় দেয় না। তারা বলে, ‘উই আর অ্যারাবস’– আমরা আরব। কারণ তারা এ কথা জানে, আরবদের মধ্যে এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান থাকলেও সেখানে খ্রিষ্টান, ইহুদি এমনকি নাস্তিক লোকও থাকতে পারে। কিন্তু তাদের সবার পরিচয়, তারা আরব।
আমাদের বাঙালি পরিচয়ই একমাত্র অসাম্প্রদায়িক পরিচয়। এই পরিচিতিকে কোনো রকম খোঁড়া যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করা যায় না। আনিস আহমেদ: যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক। ঢাকার দৈনিক সমকাল এর সৌজন্যে