আওয়ামী লীগের দোসররা’ আড্ডা দেয়—এমন অভিযোগ তুলে রাজধানীর উত্তরায় একটি লাইব্রেরি ভাঙচুর করা হয়েছে। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, স্থানীয় দুই পক্ষের তরুণ-যুবকদের মধ্যে মারামারির জের ধরে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ভেঙে দেওয়া হয় রাজউক উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্ট আবাসিক এলাকায় অবস্থিত উন্মুক্ত লাইব্রেরিটি। এ সময় লাইব্রেরিতে থাকা বই, চেয়ার-টেবিল ও আসবাব লুট করা হয়। ইউনাইটেড ব্রাদার্স নামে একটি ক্রিকেট ক্লাব এই লাইব্রেরিটি পরিচালনা করত। (প্রথম আলো, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫)।
ঘটনার পরে একজন সাংবাদিক ফেসবুকে লিখেছেন: ‘কয়েক মাস আগে আমাদের এলাকায় এই লাইব্রেরিটি শুরু হয়। উন্মুক্ত পাঠাগার কনসেপ্টই বাংলাদেশে বিলুপ্ত প্রায়। সেখানে তরুণদের এই উদ্যোগ আমার অসাধারণ লেগেছিল। আজ জানলাম সেখানে আওয়ামী লীগের দোসররা আড্ডা দেয়, তাই সব দোষ লাইব্রেরির।’
এর আগে গত ১৮ আগস্ট কলেজের ইউনিফর্ম পরে হাসিমুখে শিক্ষার্থীদের বই পোড়ানোর একটি ছবি গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে—যেখানে দেখা যায়, বরগুনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের কিছু শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসেই বই পোড়াচ্ছেন। কেউ কেউ মোবাইল ফোনে তার ছবি তুলছেন।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, বরগুনা সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের গ্রন্থাগারে থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’সহ ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কিত’ বিভিন্ন ধরনের চার শতাধিক বই বের করে পুড়িয়ে দেন কিছু শিক্ষার্থী। এ সময় সেখানে কলেজ শাখা ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির কম্পিউটার বিভাগের শিক্ষার্থী ও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি আবদুল্লাহ বলেন, ‘লাইব্রেরিতে শেখ মুজিবের কিছু বই ছিল। গত ৫ আগস্টের পর সেগুলো থাকার কথা নয়। স্যারদের কাছেও শিক্ষার্থীরা জানতে চেয়েছেন, বইগুলো সেখানে আছে কি না। তারা বলেছিলেন যে বইগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। পরে লাইব্রেরিতে খুঁজে বইগুলো পাওয়া যায়।’
আরেক শিক্ষার্থী ও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক শিহাব হোসাইন বলেন, ‘শেখ মুজিবের বিভিন্ন গল্পের বইসহ চার শতাধিক বই বের করা হয়েছে। ছাত্রদলের কলেজ শাখার সদস্য, ছাত্রশিবির, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের (সাবেক) নেতা-কর্মীসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা একত্র হয়ে বইগুলো খুঁজে বের করেন।’
সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের লাইব্রেরি থেকে নিয়ে কয়েক শ বই পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা স্বীকার করে ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অনিল চন্দ্র কার্তুনিয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘গত সরকারের সময় বইগুলো কেনা ছিল। দেড় মাসের মতো সময় হয়েছে, তিনি যোগদান করেছেন। এর আগে যিনি দায়িত্বে ছিলেন, তিনি বলেছেন যে সম্মুখে কোনো বই রাখা নেই। তবে কলেজে পরীক্ষা চলায় এবং এ সময়ের মধ্যে কোথায় কোন বই রাখা হয়েছে, তা সম্পূর্ণভাবে খোঁজ নিতে পারেননি তিনি। শিক্ষার্থীরা আজ লাইব্রেরিতে গিয়ে বইগুলো একত্র করে পুড়িয়ে ফেলেছেন।’
শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের এই বক্তব্য পড়ার পরে আপনার হয়তো মনে হচ্ছে যে, সবাই মিলে একটা মহৎ কাজ করলেন! বইগুলো পোড়ানোই উচিত ছিল। বরং বইগুলো লাইব্রেরিতে কেন রাখা হলো, সেই অপরাধে যে অধ্যক্ষ ও লাইব্রেরিয়ানের চাকরি যায়নি বা তাদের মব সৃষ্টি করে যে ফ্যাসিস্টের দোসর ট্যাগ দিয়ে বের কের দেওয়া হয়নি, সেটিই বরং আনন্দের!
এর দিন কয়েক আগে একই ঘটনা ঘটে রাজধানীর মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজে। ভিডিওতে দেখা যায়, মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজের মাঠে স্তূপ করা বইয়ে আগুন দিচ্ছেন দুজন। পাশেই এ ঘটনার নেতৃত্ব দিচ্ছেন কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব। এ সময় কলেজের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষসহ অন্য শিক্ষকেরা বাধা দিতে এলে তাদের সঙ্গেও খারাপ আচরণ করেন ছাত্রদলের দুই নেতা।
লাইব্রেরির দায়িত্বে থাকা সহকারী অধ্যাপক রবিউল আলম জানান, লাইব্রেরির এই অংশ থেকে দু শর বেশি বই জোর করে মাঠের মাঝখানে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন আট থেকে দশজন। যে বইগুলো পোড়ানো হয়েছে তার বেশির ভাগই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লেখা। কলেজের অধ্যক্ষ এইচ. এম. ওয়ালী উল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, বারবার নিষেধ করার পরও ছাত্রদল নেতারা তার কথা শোনেননি।
রাজনৈতিক বিরোধ বা প্রতিহিংসার কারণে মারামারি এমনকি খুনোখুনিও নতুন কিছু নয়। কিন্তু সেই বিরোধে কিংবা মতাদর্শের ভিন্নতার কারণে বই পুড়িয়ে ফেলা বা লাইব্রেরি ভাঙচুর করার যেসব ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, তাতে এই প্রশ্ন উঠছে যে, একটি বিরাট অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একজন কর্তৃত্ববাদী শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করার পরে কারা ক্ষমতাবান হয়ে উঠলেন এবং যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও নির্মূলকরণের প্রতিবাদে এত বড় একটি অভ্যুত্থান হলো, তার মধ্য দিয়ে যে একটা সহনশীল ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল, সেই প্রত্যাশা ক্রমশই কেন ফিকে হয়ে আসছে?
যে তরুণেরা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন বা নতুন ধরনের রাজনীতির কথা বলেন, তারা কী করে বই পোড়ানো কিংবা লাইব্রেরি ভেঙে দেওয়ার মতো জঘন্য কাজে নিজেদের নিয়োজিত করছেন?
বইয়ের টেক্সট বা বিষয় পছন্দ না হলে সেই বই পুড়িয়ে ফেলার মধ্য দিয়ে যে অজ্ঞানতা ও প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ তারা ঘটালেন, তাতে তাদের হাতে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কতটা নিরাপদ, তা নিয়ে সংশয় যেমন আছে, তেমনি এই প্রজন্মের হাত ধরে আদৌ একটি উদার, গণতান্ত্রিক, সহনশীল ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গড়ে উঠবে কি না—তাও অনিশ্চিত। এই তরুণের সংখ্যা হয়তো খুব বেশি নয়। অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব দল ও সংগঠন হয়তো এই তরুণদের সমর্থন করে না। কিন্তু যারা এসব ঘটনা ঘটালেন, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে?
যে কলেজের শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সামনে, ক্যাম্পাসে উৎসবের মতো বই পোড়ালেন, তারা কি এখনও সেখানের শিক্ষার্থী আছেন বা তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কি কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে? নাকি উল্টো কলেজ কর্তৃপক্ষই ভয়ের মধ্যে আছে যে, এই ঘটনায় কাউকে শাস্তি দিলে তারাও আক্রান্ত হবেন? কেননা, গত বছরের ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের নাজেহাল করার যেসব ছবি গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় এসেছে, তা কোনো সভ্য সমাজ অনুমোদন করে না।
প্রশ্ন হলো, বই পোড়ানো বা লাইব্রেরি ভাঙচুরের ঘটনাকে আমরা কি ‘রাজনীতি’ নামে অভিহিত করব নাকি নৈরাজ্য? কেননা, ইদানীং মবকে ‘মব’ বললে অনেকের মন খারাপ হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টাও বলেছেন, মব আর রাজনৈতিক কর্মসূচি এক নয়।
প্রশ্ন হলো, মতাদর্শের ভিন্নতার কারণে প্রকাশ্যে বই পুড়িয়ে দেওয়া কিংবা ভিন্নমতের লোকেরা আড্ডা দেন—এমন অভিযোগ তুলে লাইব্রেরি ভাঙচুরের ঘটনাও কি তাহলে রাজনৈতিক কর্মসূচি? যদি তাই হয়, তাহলে এই প্রশ্নও তুলতে হবে যে, এই রাজনীতি দেশকে কোথায় নিয়ে যাবে? বলা ও লেখা পছন্দ না হলেই তাকে ফ্যাসিস্ট বা স্বৈরাচারের দোসর ট্যাগ দেওয়ার এই ‘সংস্কৃতি’ একটি অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে কি না—সেটিও ভেবে দেখা দরকার। আমীন আল রশীদ সাংবাদিক ও লেখক। দৈনিক প্রথম আলো-র সৌজন্যে