নিউইয়র্ক     সোমবার, ১৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ  | ৪ঠা ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আল-জাজিরার প্রতিবেদন

ভারতের উদ্বেগের মধ্যে হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে পাকিস্তান

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ | ০১:৪৫ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ | ০১:৪৫ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
ভারতের উদ্বেগের মধ্যে হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে পাকিস্তান

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের সঙ্গে কথা বলেছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল এসএম কামরুল হাসান। তাদের বসার পাশেই একটি টেবিলের ওপর দুই দেশের জাতীয় পতাকা ছিল। পাকিস্তানের রাজধানীতে হাসানের সফরটি দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের উচ্চতার সাক্ষার বহন করে। ওই বৈঠকে এসএম কামরুল হাসান পাকিস্তানের অন্যান্য সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন। গত মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারী) জেনারেল মুনির এবং লে. জেনারেল কামরুল হাসানের বৈঠক প্রসঙ্গে দেয়া বিবৃতিতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর গণমাধ্যম শাখা দুই দেশকে ‘ভ্রাতৃপ্রতিম জাতি’ বলে উল্লেখ করেছে।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ আলাদা হওয়ার ৫৪ বছরের মধ্যে ঢাকা ও ইসলামাবাদের সম্পর্ক এর আগে এমন দেখা যায়নি। গত ১৬ বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক আরও তলানিতে ঠেকে। গত দেড় দশক শেখ হাসিনা স্বৈরতান্ত্রিকভাবে দেশ শাসন করে। আর এ কাজে সহযোগিতা করে ভারত। শেষ পর্যন্ত গত বছরের জুলাই ও আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয় হাসিনা। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক আরও গভীর হচ্ছে। কারণ রাজনীতির মাঠে দুই দেশের মধ্যেই ভারত বিরোধীতা রয়েছে।

পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, মুনির ও কামরুল হাসান দুই দেশের মধ্যে সামরিক সম্পর্ক জোরদারের গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং এই অংশীদারত্বকে বাহ্যিক প্রভাব থেকে সুরক্ষিত রাখার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। তাদের বৈঠক ছিল, দুই দেশের মধ্যে সাম্প্রতিক উচ্চপর্যায়ের একাধিক বৈঠকের অংশ।

গত মাসে মিশরের রাজধানী কায়রোত অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহম্মদ ইউনূস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এছাড়া এই দুই নেতার মধ্যে গত বছরের সেপ্টেম্বরেও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সাইডলাইনে সাক্ষাত হয়। এছাড়া পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার আগামী মাসে বাংলাদেশ সফর করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ২০১২ সালের পর এটিই হবে পাকিস্তানের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম বাংলাদেশ সফর। এই বিষয়গুলো দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে ঢাকা ও ইসলামাবাদের বৈরিতার শুরু হয়। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এবং আল-বদর ও আলশামসসহ তাদের সহযোগী মিলিশিয়ারা স্বাধীনতাকামী জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করতে নিধনযজ্ঞে নামে। লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। অন্তত দুই লাখ নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। ওই সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার দল আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এতে সহায়তা করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। পরে শেখ মুজিব বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট হন এবং ‘জাতির পিতা’ উপাধি পান। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে পাকিস্তান একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্বীকার করলেও ইসলামাবাদ ও ঢাকার মধ্যে বিভিন্ন অমীমাংসিত বিষয় থেকে যায়। এর মধ্যে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে যুদ্ধাপরাধের জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা না চাওয়া, পাকিস্তানি পরিচয় দেয়া উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে না নেয়া এবং ১৯৭১ সালের পূর্ববর্তী সম্পদের ভাগাভাগি অন্যতম। আর এই অমিমাংশিত বিষয় নিয়ে কায়রোতে শাহবাজ শরিফের সঙ্গে বৈঠকে কথা বলেন ড. ইউনূস। জবাবে শাহবাজ শরিফ বলেন, তিনি এই বিষয়গুলো দেখবেন।

বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত আশরাফ কোরেশি আল-জাজিরাকে বলেন, নয়াদিল্লির তরফ থেকে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারকে দীর্ঘদিন ধরে সমর্থন করার কারণে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, সম্ভবত এই বিষয়টি ঢাকা প্রশাসনকে নতুন করে কৌশল নির্ধারণে উদ্বুদ্ধ করেছে।

গত মাসে ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকার দিল্লির কাছে হাসিনাকে প্রত্যর্পণের দাবি জানায়। ক্ষমতায় থাকার সময় হাসিনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের দমনের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে। ভারতের পক্ষ থেকে এখনো এই বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। তবে কিংস কলেজ লন্ডনের সিনিয়র লেকচারার ওয়াল্টার ল্যাডউইগ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক ও সামরিক চালাচালিকে ‘অতিরঞ্জিত’ করে দেখা হচ্ছে বলে সতর্ক করেন। আশরাফ কোরেশি বলেছেন, ভৌগোলিক বাস্তবতার কারণে বাংলাদেশের পক্ষে সরাসরি ভারতবিরোধী অবস্থান নেয়া কঠিন। কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘ সীমান্ত, পানির উৎস রয়েছে। এ অবস্থায় হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশ ভারতের বিরুদ্ধে কিছুটা স্বাধীন নীতিগত অবস্থান নিবে। কিন্তু বাংলাদেশ ভারতবিরোধী অবস্থান নেবে না। আশরাফ কোরেশির বক্তব্যের সঙ্গে ল্যাডউইগও একমত। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষ ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা মেনে নিয়েছে- এটি অবশ্যই লক্ষ্য করার মতো একটি প্রবণতা। তবে এটি তখনই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, যখন এর সঙ্গে ব্যাপক নীতিগত পরিবর্তন যুক্ত হবে। এর আগে আমরা আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে বড় কোনো পরিবর্তনের কথা ভাবতে পারি না।

শেয়ার করুন