২৫শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

যুক্তরাষ্ট্র

ইউক্রেনকে পুতিনের কাছে আত্মসমর্পণ করতেই কি যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রস্তাব -আল-জাজিরার এক্সপ্লেইনার

ইউক্রেনকে পুতিনের কাছে আত্মসমর্পণ করতেই কি যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রস্তাব -আল-জাজিরার এক্সপ্লেইনার

আন্তর্জাতিক নানা সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া একটি নতুন কাঠামো তৈরি করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই ২৮ দফার পরিকল্পনা অনুযায়ী, কিয়েভকে (ইউক্রেনের রাজধানী) অস্ত্র এবং কিছু ভূখণ্ড ছেড়ে দিতে হবে।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি আজ বৃহস্পতিবার কিয়েভে মার্কিন সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করার ঠিক এক দিন আগে এ খবর প্রকাশিত হলো।পরিকল্পনা সম্পর্কে এ পর্যন্ত যা জানা গেছে এবং এই পরিকল্পনা অনুযায়ী কিয়েভকে কী কী ছাড় দিতে হতে পারে, তার কিছু বিবরণ তুলে ধরা হলো।

এই পরিকল্পনা কি সরকারি প্রস্তাব : না, এটি এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি প্রস্তাব নয়। যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রস্তাবের বিষয়ে কোনো ঘোষণা দেয়নি। এমনকি রাশিয়াও এমন কোনো শান্তি পরিকল্পনার অস্তিত্ব অস্বীকার করেছে।

তবে একাধিক সংবাদমাধ্যম অজ্ঞাতনামা সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে এই পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। মার্কিন ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওস এবং যুক্তরাজ্যের ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকা গত বুধবার প্রথম এই পরিকল্পনার বিবরণ প্রকাশ করে।

রয়টার্স অজ্ঞাতনামা সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র জেলেনস্কিকে ‘ইঙ্গিত’ দিয়েছে, ইউক্রেনকে অবশ্যই এই মার্কিন পরিকল্পনা মেনে নিতে হবে, যার মধ্যে ভূখণ্ড এবং অস্ত্র সমর্পণ অন্তর্ভুক্ত থাকছে। আরেক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিনিময়ে ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা গ্যারান্টি পাবে।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমস অজ্ঞাতপরিচয় এক কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, প্রস্তাবটি ‘গুরুত্বপূর্ণভাবে রাশিয়ার পক্ষে যাচ্ছে’ এবং প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য ‘খুবই সুবিধাজনক’। পত্রিকাটি আরও দাবি করেছে, শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কর্মকর্তারাই এর খসড়া তৈরির কাজ করেছেন।

তবে লন্ডনভিত্তিক চিন্তক প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের রাশিয়ান সামরিকবিশেষজ্ঞ কিয়ের জাইলস আল–জাজিরাকে বলেন, এই প্রস্তাব হয়তো যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসেনি। তিনি এ প্রস্তাবের উত্থাপনকে ‘বাস্তবতার ভিত্তি না হয়ে একটি রুশ তথ্যযুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেন, যা পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম আবারও সানন্দে গ্রহণ করেছে।

মার্কিন ও ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা কী বলছেন : হোয়াইট হাউস এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ‘এক্স’-এ লিখেছেন, এই যুদ্ধ অবসানের জন্য ‘উভয় পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে সম্ভাব্য ধারণাগুলোর একটি তালিকা তৈরি অব্যাহত থাকবে’ এবং স্থায়ী শান্তি অর্জনের জন্য ‘উভয় পক্ষকেই কঠিন হলেও প্রয়োজনীয় ছাড়ের বিষয়ে সম্মত হতে হবে’।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে আলোচনার সময় জেলেনস্কি কথিত এই প্রস্তাব নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তবে তিনি টেলিগ্রামে লিখেছেন, ‘রক্তপাত বন্ধ এবং স্থায়ী শান্তি অর্জনের জন্য প্রধান বিষয় হলো আমাদের সব অংশীদারের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা এবং মার্কিন নেতৃত্ব কার্যকর ও শক্তিশালী থাকা।’

পরিকল্পনার শর্তাবলি সম্পর্কে কী জানা গেছে : মার্কিন সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওস জানিয়েছে, এই পরিকল্পনা সুনির্দিষ্ট। এতে ২৮টি দফা রয়েছে।

এর ফলে সামগ্রিকভাবে রাশিয়া ২০১৪ সালে দখল করা দক্ষিণ ইউক্রেনের ক্রিমিয়া এবং দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক নিয়ে গঠিত পূর্বাঞ্চলীয় দনবাস অঞ্চলের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পাবে।

ইউক্রেনকে দনবাস থেকে পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহার করতে হবে। এটি একটি সেনামুক্ত অঞ্চলে পরিণত হবে, যেখানে রাশিয়াও সেনা মোতায়েন করতে পারবে না। এ পরিকল্পনায় ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর আকার এবং দীর্ঘ পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা কমানোর ওপরও দীর্ঘমেয়াদি সীমা আরোপের কথা বলা হয়েছে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, কৃষ্ণসাগরসংলগ্ন জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসন অঞ্চলে বিদ্যমান যুদ্ধরেখাগুলো স্থিতাবস্থা করে দেওয়া হবে। এই এলাকার কোনো অংশ ইউক্রেনকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে কি না, তা পরবর্তী আলোচনার ওপর নির্ভর করবে।

ইউক্রেনের জন্য এটি কতটা ভালো : বিশ্লেষকদের মতে, প্রাথমিকভাবে এই পরিকল্পনা কোনোভাবেই ইউক্রেনের পক্ষে নয়।

লন্ডন কিংস কলেজের প্রতিরক্ষা গবেষণা বিভাগের পোস্ট–ডক্টরাল গবেষক মারিনা মিরন বলেন, এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ইউক্রেনকে তার সামরিক বাহিনীর আকার ৬০ শতাংশ কমাতে হবে (৪ লাখের বেশি সৈন্য রাখা যাবে না)।

মিরন আরও বলেন, ইউক্রেনের এমন কোনো দূরপাল্লার সক্ষমতা থাকবে না, যা রাশিয়ায় আঘাত করতে পারে এবং রাশিয়ার দখলে থাকা অঞ্চলগুলো ও ক্রিমিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে।

সামরিক বিশেষজ্ঞ কিয়ের জাইলস এ পরিকল্পনাকে ‘ইউরোপীয় নিরাপত্তার জন্য বিপর্যয়কর’ বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ, সেনাবাহিনীর আকার হ্রাস এবং অস্ত্রের সীমাবদ্ধতা ইউক্রেনকে ভবিষ্যতে রুশ আক্রমণের সামনে খুব ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে।

মিরন বলেন, এই পরিকল্পনা স্পষ্টতই রাশিয়ার পক্ষে যায়। এখন দেখার বিষয়, ইউক্রেন ও জেলেনস্কিকে এটি মেনে নিতে বাধ্য করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করতে পারে কি না।

ট্রাম্পের বারবার অবস্থান বদল : ট্রাম্প এই বছর কয়েকবার ইউক্রেনের ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে তাঁর অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। গত মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইউক্রেনের যুদ্ধকে বর্তমান যুদ্ধরেখায় স্থগিত করার পরামর্শ দেন, যা রাশিয়া প্রত্যাখ্যান করেছিল।

এর আগে গত সেপ্টেম্বরে ট্রাম্প বলেছিলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সহায়তায় ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে হারানো সব অঞ্চল পুনরুদ্ধার করতে পারে। এরও আগে গত আগস্টে ট্রাম্প বলেছিলেন, যুদ্ধ শেষ করতে রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়কেই ভূখণ্ড ছাড় দিতে হবে, যা জেলেনস্কি তখন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

এরপর কী হতে পারে : মারিনা মিরন বিশ্বাস করেন, এই পরিকল্পনা যদি উপস্থাপন করা হয়, তবে রাশিয়াকে অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়ার কারণে ইউক্রেন ও ইউরোপ তা প্রত্যাখ্যান করবে।

মিরন মনে করেন, এতে ‘পরিকল্পনাটি নতুন করে লেখার আরেকটি চক্র শুরু হবে। এতে ইউক্রেন ও ইউরোপ তাদের নিজস্ব দাবি পেশ করবে। মিরন আরও বলেন, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে যদি এসব প্রতিবেদন সত্য হয়, তবে এই পরিকল্পনা সম্ভবত একটি ‘কূটনৈতিক খেলার’ জন্ম দেবে।

ইউক্রেনীয় ও ইউরোপীয়রা এটি প্রত্যাখ্যান করলে ট্রাম্প বলতে পারবেন, ‘আমরা তোমাদের জন্য একটি পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলাম, আর তোমরা তা প্রত্যাখ্যান করেছ। সুতরাং, দীর্ঘস্থায়ী শান্তি অর্জনের পথে তোমরাই বাধা।’

মিরন বলেন, ইউরোপ, ইউক্রেন ও রুশ—তিন পক্ষই আসলে একটা খেলায় মেতে আছে। তারা আগেই জানে, তারা প্রত্যেকে এমন প্রস্তাব দিচ্ছে, যা অন্য পক্ষ অবশ্যই ফিরিয়ে দেবে। ফলে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব গিয়ে পড়বে ইউরোপ ও ইউক্রেনের ওপর।