১২ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

যুক্তরাষ্ট্র

ইরানের সরকার পরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্রের ৭২ বছরের আগের ভূমিকায় কি নামছেন ট্রাম্প

ইরানের সরকার পরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্রের ৭২ বছরের আগের ভূমিকায় কি নামছেন ট্রাম্প

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে। পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে তা ঠিক অনুমান করা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুমকি দিয়ে বলেছেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যা করা কোনো বিষয় নয়। তিনি ‘আমেরিকার জন্য একেবারেই সহজ লক্ষ্য’।

গত মঙ্গলবার (১৭ জুন) নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘আমরা এখনই তাঁকে সরিয়ে দিচ্ছি না (মানে, হত্যা করছি না!), তবে আমাদের ধৈর্য ফুরিয়ে আসছে।’

ইসরায়েল চাইছে, ইরানে হামলায় যুক্তরাষ্ট্রও যুক্ত হোক। তা নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন চিন্তাভাবনা করছে। ইসরায়েলের অভিযানকে সহায়তা দিতে মার্কিন যুদ্ধবিমান ও অস্ত্র ব্যবহার করা হবে কি না, তা নিয়ে শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে অব্যাহতভাবে আলোচনা করছেন ট্রাম্প।

কিন্তু ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের মধ্যে ইরানে হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি অংশ নেওয়া নিয়ে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। এর মধ্যেই তাঁর ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ (এমএজিএ) আন্দোলনের ভেতরেই ভাঙন শুরু হয়েছে।

ট্রাম্পের সাবেক উপদেষ্টা স্টিভ ব্যানন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক টাকার কার্লসনের মতো সমর্থকেরা বলছেন, ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্য শুধু পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস করা নয়। সরকার বদলই এই ধরনের হামলার মূল লক্ষ্য।

ব্যাননের পডকাস্ট ‘ওয়ার রুম’-এ কার্লসন বলেন, ‘আপনি আমাকে বোঝাতে পারবেন না যে ইরানিরা আমার শত্রু। এটা তো পুরোপুরি “অরওয়েলের মতো ব্যাপার” হয়ে গেল। কে কাকে ঘৃণা করবে, তা নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে।’ কার্লসন এখানে বিখ্যাত ইংলিশ ঔপন্যাসিক জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’–এর কথা বলেছেন। এটি একটি ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস, যেখানে একাধিপত্যবাদী সরকার জনগণের চিন্তা ও জীবন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে, স্বাধীনতা রুদ্ধ করে।

ইরানের বর্তমান শাসকদের বিরোধিতা করতে গিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের অনেকেই ইসলামি প্রজাতন্ত্রের ধর্মীয় রক্ষণশীলতাকে দায়ী করেন। তবে ইরানে পশ্চিমা হস্তক্ষেপের ইতিহাস নতুন নয়। আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের অনেক আগ থেকেই দেশটিতে পশ্চিমারা হস্তক্ষেপ চালিয়ে আসছে। এখন প্রশ্ন হলো, ইসরায়েল কি আসলেই ইরানে সরকার পরিবর্তন চায়? যুক্তরাষ্ট্র কি তাতে সহায়তা করছে? আর ইরানে পশ্চিমা হস্তক্ষেপের ইতিহাসই বা কতটা গভীর?

ইসরায়েলের ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ কেন?
গত শুক্রবার (১৩ জুন) ভোররাতে ইরানের ওপর হামলা শুরু করে ইসরায়েল। এরপর দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক ভিডিও বার্তায় ইংরেজিতে ইরানিদের উদ্দেশে বলেন, ‘আশা করি, এই সামরিক অভিযান আপনাদের স্বাধীনতা অর্জনের পথের বাধা দূর করবে।’

নেতানিয়াহু বলেন, ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্রের পরমাণু ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের হুমকি থেকে আমাদের রক্ষা করা ইসরায়েলের হামলার মূল উদ্দেশ্য।’ সঙ্গে তিনি আরও বলেন, এই হামলা ইরানে সরকার পরিবর্তনের পথও খুলে দিতে পারে।

এই সামরিক অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’, যার নানা ঐতিহাসিক ইঙ্গিত রয়েছে। সিংহ আর সূর্যের ছবি প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রতীক। ১৯ শতকের শেষ দিক থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত পাহলভি শাসকদের সময়ে ইরানের পতাকায় তলোয়ার হাতে সিংহের প্রতীক ব্যবহার করা হতো।

১৩ জুন শুক্রবার হামলার কয়েক ঘণ্টা পরে দেওয়া সেই বক্তৃতায় নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ইরানি জনগণের সামনে এখন ঐতিহাসিক পতাকাকে ঘিরে সমবেত হওয়ার সময় এসেছে। সময় হয়েছে এই অন্যায় ও অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করার।

গত ১৭ জুন মঙ্গলবার ইসরায়েলের পার্সিয়ান ভাষার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ছবি পোস্ট হয়। সেখানে দেখা যায়, তলোয়ারধারী একটি সিংহ আধুনিক ইরানি পতাকাকে ছিন্নভিন্ন করছে। পতাকাটিতে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের প্রতীক ছিল।

অনেকে মনে করেন, বিপ্লব-পূর্ব ইরানের স্মৃতি জাগিয়ে ইরানিদের প্রতিরোধে উৎসাহ দিতে চেয়েছে ইসরায়েল। তবে কাতারের নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মার্ক ওয়েন জোনস বলেন, ‘সিংহ নিয়ে ইসরায়েলি নেতারা কী বলছেন, তাতে ইরানিরা প্রভাবিত হবে, এটা ভাবা খুব বেশি কাজের বলে মনে হয় না।’

জোনস বলেন, সিংহকে ঘিরে ইসরায়েলের বার্তা শুধু ইরানিদের জন্য নয় বরং নিজেদের জনগণের জন্যও। তিনি বলেন, ইসরায়েল নিজেকে সিংহ হিসেবে দেখাচ্ছে, যে ভূমি দখল করতে এসেছে। ইসরায়েল ইতিহাসে নিজেকেই সিংহ হিসেবে উপস্থাপন করে এসেছে। জোনসের মতে, ইসরায়েল বোঝাতে চাইছে এটা শুধু কৌশলগত যুদ্ধ নয় বরং এটি তাদের জাতিগত পরিচয় ও ইহুদিদের বাইবেলীয় জন্মভূমির দীর্ঘ ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত।

তবে ইরানের বর্তমান শাসকদের বিরুদ্ধে দেশটির জনগণকে জাগাতে চাইলে পুরোনো পারস্যের প্রতীক দেখিয়ে খুব একটা ফল পাওয়া যাবে না বলে মনে করেন জোনস। কারণ, ইরানের কোনো মানুষ তাদের এই প্রতীক দেখাচ্ছে না, দেখাচ্ছে ইসরায়েল, যারা ইরানি নয়।

খামেনিকে নিয়ে ট্রাম্প কী বলেছেন?
ট্রাম্প এখনো তেহরানে সরকার পরিবর্তনের আনুষ্ঠানিক আহ্বান জানাননি। কিন্তু তিনি স্পষ্ট হুমকি দিয়ে রেখেছেন, যখন ইচ্ছা তখন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের শীর্ষ নেতা খামেনিকে হত্যার চেষ্টা করতে পারে। গত বুধবার হোয়াইট হাউসের উঠানে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প আবারও ইরানের প্রতি ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের’ আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ: এর মানে আমি আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারছি না। বুঝলে? আমি হাল ছেড়ে দিলাম। আর নয়। তারপর আমরা ওখানে [ইরানে] ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সব পরমাণু স্থাপনা উড়িয়ে দেব।’

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ৪০ বছর ধরে তারা [ইরানিরা] চিৎকার করে আসছে-‘আমেরিকা ধ্বংস হোক’, ‘ইসরায়েল নিপাত যাক’। যাদের তারা পছন্দ করে না, তারা নিঃশেষ হয়ে যাক। ট্রাম্প বললেন, ‘আমরা যুদ্ধবিরতি চাই না। আমরা পুরোপুরি বিজয় চাই। বিজয় মানে হলো, [ইরানের হাতে] কোনো পারমাণবিক অস্ত্র থাকবে না।’

পশ্চিমারা কি আগেও ইরানে সরকার বদল করেছে?
যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীদের কাছে অতীতে ইরানে ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ মানেই ছিল সরকার সম্পূর্ণভাবে বদলে ফেলা। এখন থেকে ৭২ বছর আগে ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ) ও যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থা এমআই৬ ইরানের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র চালিয়েছিল।

মোসাদ্দেক ইরানের তেলশিল্পকে জাতীয়করণ করেছিলেন, যা আগে ব্রিটিশ মালিকানাধীন অ্যাংলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি (বর্তমানে বিপি) নিয়ন্ত্রণ করত। মোসাদ্দেকের এই সিদ্ধান্ত জনগণের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো তা পছন্দ করেনি।

এই সময়টাতে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমাদের স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। ওয়াশিংটনের তৎকালীন কর্মকর্তারা আশঙ্কা করতেন, মোসাদ্দেক সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। এই পরিস্থিতিতে মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য মিলিয়ে একটি গোপন অভিযান চালায়, যা ‘অপারেশন অ্যাজ্যাক্স’ নামে পরিচিত।

অভিযানের অংশ হিসেবে বিক্ষোভে অর্থায়ন করা হয়, স্থানীয় পত্রিকায় প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয় এবং ইরানের শাহ মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভির প্রতি অনুগত সামরিক কর্মকর্তাদের সমর্থন করা হয়। ১৯৫৩ সালের ১৯ আগস্ট মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। অল্প সময়ের জন্য ইরান ছেড়ে যাওয়া শাহ আবার ফিরে এসে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় নিজের ক্ষমতা শক্তিশালী করেন।

ইরান ও উন্নয়নশীল দেশগুলো (গ্লোবাল সাউথ) এই অভ্যুত্থান ভালোভাবে নেয়নি। এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এই ধারণা জোরদার হয় যে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার চেয়ে তেল ও প্রভাব নিয়ন্ত্রণের দিকেই পশ্চিমাদের মনোযোগ ছিল বেশি।

এরপর কী ঘটল?
শাহ ১৯৫৩ সালে শাসন শুরুর করার পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি করতে থাকে। একই সঙ্গে তিনি আরও কঠোর ও দমনমূলক হয়ে ওঠেন। শাহ ‘হোয়াইট রেভল্যুশন’ নামে একটি বড় প্রকল্প চালু করলেন। এর অধীনে শিক্ষাব্যবস্থা ও অবকাঠামো বৃদ্ধি করা হয়। নানা ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধাসংক্রান্ত সংস্কার করা হয়। কিন্তু তার গোপন পুলিশ ‘সাভাক’ রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর ভয়াবহ রকমের নিপীড়ন চালাত।

খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তার, সেন্সরশিপ এবং নির্যাতন সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ধনী ও গরিবের ব্যবধান বাড়তে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ায় শাহ সরকারের সঙ্গে ধর্মীয় নেতা ও ভিন্নমতের সাধারণ মানুষের বিরোধ বাড়তে থাকে।

১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে জনগণের অসন্তোষ চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। ইরানজুড়ে বড় বড় বিক্ষোভ হতে থাকে, শাহকে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর দাবি বাড়তে থাকে। ১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে চাপ সামলাতে না পেরে শাহ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।

আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি নির্বাসন থেকে ফিরে এসে ইসলামি বিপ্লবের নেতৃত্বের হাল ধরেন। একটা পর্যায়ে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং ইরানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়। দীর্ঘ অসুস্থতায় ভুগে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৮৯ সালে খোমেনি মারা যান। এরপর আলী খামেনিই ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হন। এর আগে ১৯৮১ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত তিনি ইরানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৮৯ সালের ৪ জুন থেকে আজ পর্যন্ত খামেনিই ইরানের দ্বিতীয় ও বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে দায়িত্বে পালন করছেন।

ইসরায়েলি হামলার পর প্রথম টেলিভিশন ভাষণে গত বুধবার আলী খামেনিই ট্রাম্পের ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের’ আহ্বানকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ ও ‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ’ বলে মন্তব্য করেছেন। খামেনি বলেন, ‘এই জাতি কখনোই আত্মসমর্পণ করবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমেরিকার জানা উচিত, সামরিক হস্তক্ষেপের চেষ্টা করলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।’ খামেনির ভাষণের জবাবে হোয়াইট হাউসের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘শুভ কামনা রইল।’