২৫শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

আর্ন্তজাতিক

‘গণভোটের গেজেটের বিধান অসাংবিধানিক, সংসদ হতে পারে ঝুলন্ত’ বললেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক

‘গণভোটের গেজেটের বিধান অসাংবিধানিক, সংসদ হতে পারে ঝুলন্ত’ বললেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একইসঙ্গে গণভোট-সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরিত গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শাহদীন মালিক মন্তব্য করেছেন, গেজেটে প্রকাশিত বেশিরভাগ বিধান অসাংবিধানিক হওয়ায় এটি একটি সাংবিধানিক জটিলতা তৈরি করেছে। সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি সংবিধানের পরিপন্থী কোনো অধ্যাদেশ জারি করতে পারবেন না’; ফলে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ প্রবর্তন হলে একটি ঝুলন্ত সংসদ তৈরি হতে পারে।

তিনি টিবিএসকে আরও বলেন, ‘জুলাই সনদসহ গেজেটে যেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তার অধিকাংশই বর্তমান সংবিধানের পরিপন্থী। এখনও যেহেতু সংবিধান বলবত আছে, তাই আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি এই গেজেটে স্বাক্ষর করতে পারেন না। যদি সংধান বাতিল হতো কিংবা সামরিক শাসনে স্থগিত হতো, তাহলে সেটা ঠিক ছিল। যেহেতু এমন কিছুই ঘটেনি, তাই বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী হওয়ারই কথা।’

গেজেট অনুযায়ী, চারটি বিষয়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। গণভোটের দিন এই চারটি বিষয়ের ওপর একটিমাত্র প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে জনগণ মতামত জানাবেন। তবে একই সাথে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন হলে অধিকাংশ গণভোটের ব্যালট পেপার ফাঁকা থাকবে বলে আশঙ্কা করছেন শাহদীন মালিক।

তিনি বলেন, ‘গণভোটের যে বিষয়ের উপর জনগণ “হ্যাঁ” বা “না” ভোট দেবেন, তাদের তো আগে বিষয়গুলো বুঝতে হবে। তাই একই দিনে হলে জাতীয় নির্বাচনমুখী থাকবে মানুষ, ফলে গণভোটের বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অনেকেই ভোট না দিয়ে ব্যালট ফাঁকা রাখবেন। আর ভিন্ন দিনে হলেও গণভোটে উপস্থিতি অনেক কম থাকে।’

গেজেটে বলা হয়েছে, নির্বাচিত সংসদকে প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ থেকে ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে জুলাই জাতীয় সনদ এবং গণভোটের ফলাফল অনুসারে সাংবিধানিক সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে।

বিধানটিকে ‘অ্যাবসার্ড’ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন শাহদীন মালিক। তিনি টিবিএসকে বলেন, ‘এসব আইনের ক্ষেত্রে সময় বেঁধে দেওয়া কিংবা পরবর্তীতে আলোচনার বিষয়টি সাধারণত থাকে না। তাই এসব দিন ধার্য করে দিয়েও লাভ নেই, যদি সংসদ সেটাকে গুরুত্ব না দেয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘যদি নির্বাচিত সরকার প্রথম অধিবেশনে সনদ কিংবা গণভোটের বিষয়ে “না” ভোট দেয়, তাহলে তো আর ১৮০ দিন বেঁধে দিয়ে লাভ নেই। সংসদেই যদি বিষয়টি পাশ না হয়, তাহলে পরবর্তীতে সেটা বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা তো আর থাকে না।’

শাহদীন মালিক বলেন, ‘গণভোট আগে করেও লাভ হবে না, যদি সেটা সংসদ নির্বাচনের পরে পাশ না করে। সংসদ কোনো একটা প্রস্তাব পাশ করল, সেটা যদি জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়, তখন সেটার ব্যাপারে জনগণের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য গণভোট হয়। সাধারণত আগে গণভোটের প্রস্তাব সংসদে পাশ হয়, পরে তা জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে হচ্ছে উল্টো।’

এই আইনজীবী বর্তমান সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে বলেন, এতে স্বচ্ছতা ও সাংবিধানিক জ্ঞানের অভাব রয়েছে। গেজেটে প্রকাশিত ১৮০ দিনের আলোচনার কথাকে ‘অর্থহীন’ ও ‘হাস্যকর’ বলে আখ্যায়িত করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘গেজেটে নির্বাচনের ধরন [গণপরিষদ, সংসদ নাকি হাইব্রিড] নিয়ে বিভ্রান্তি প্রকাশ করা হয়েছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রবর্তনের প্রস্তাবটি অত্যন্ত জটিল ও অপরিণত পদক্ষেপ।’

এই পদ্ধতিতে নির্বাচনের কার্যকারিতা, উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের মধ্যে সম্পর্ক এবং ভোটের শতাংশের সাথে আসন বণ্টনের সম্ভাব্য অসামঞ্জস্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।

গেজেটে বলা হয়েছে, আগামী জাতীয় সংসদ হবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চ কক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধনী করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন প্রয়োজন হবে।

এ বিষয়ে শাহদীন মালিক টিবিএসকে বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে বিগত কোনো নির্বাচনেই ৫০ শতাংশ ভোট পেয়ে সংসদ গঠনের নজির নেই। ৩৫-৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৭০-১৮০ আসনে নির্বাচিত হয়ে সংসদ গঠন করেছে বিভিন্ন দল। এখন যদি কোনো দল ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৮০ টি আসনে জিতে সরকার গঠন করে, তাহলে বাকি ৬০ শতাংশ ভোট পাওয়া বিরোধী দলগুলোকে উচ্চকক্ষে আসন দিতে হবে। তাই যখনই কোনো সিদ্ধান্ত নিতে যাবে, তখনই এই অসামঞ্জস্যতার কারনে জটিলতা বাধবে। এখন যদি সরকারের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে উচ্চকক্ষের ভোট চলে যায়, তখন আর সেটা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।’

তিনি ভারতের লোকসভা-রাজ্যসভা ও বেলজিয়ামের পার্লামেন্টের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘বেলজিয়াম ১৯৭০ সালে দ্বিকক্ষের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশ বছর পর্যালোচনা করে। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালের দিকে এসে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রবর্তন করে। আর বাংলাদেশে এসেই দ্বিকক্ষ চালু করা হচ্ছে; যাতে সরকার ও সংস্কার কমিশনের অদূরদর্শিতা প্রকাশ পেয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, সংসদ সদস্যরা যদি পূর্বের কোনো অধ্যাদেশ দ্বারা ‘আবদ্ধ’ থাকেন, তাহলে নতুন কোনো সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ক্ষমতায় এসে সেগুলোকে বাতিল করে দিলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে।

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামা অনুসারে সংবিধানে জুলাই জাতীয় সনদ অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে ভাষণে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে সুশাসন নিশ্চিতের জন্য এসব সংস্কার বড় ভূমিকা রাখবে।

ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষরিত সনদকে মূল দলিল হিসেবে ধরে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার বৃহস্পতিবারের উপদেষ্টা পরিষদের সভায় জুলাই জাতীয় সনদ ও সংবিধান সংস্কার বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫ অনুমোদন করেছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই আদেশে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধান গ্রহণ করা হয়েছে, যার মধ্যে সংবিধান সংস্কারবিষয়ক গণভোট অন্যতম।