১৯শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সংকটে বাংলাদেশে বাড়ছে দারিদ্র্য

বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে এক রকম স্থবিরতা চলছে। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়ন সর্বকালের সর্বনিম্ন। বাস্তবায়নের হার ৬৮ শতাংশেরও কম। চলতি অর্থবছরের গত দুই মাসের পরিস্থিতিও ভিন্ন কিছু নয়। অন্তত পাঁচ মন্ত্রণালয় খরচের খাতাই খুলতে পারেনি। সরকারি খাতের মতোই বেসরকারি বিনিয়োগ পরিস্থিতি। বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে ৭ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। বাংলাদেশে গত অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের এমন স্থবিরতার প্রভাবে কর্মসংস্থানের গতি ধীর। আবার যারা কাজে আছেন, তাদের মজুরি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে না। অন্যদিকে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। সার্বিক এ পরিস্থিতিতে দারিদ্র্যসীমার নিচে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এ রকম বাস্তবতায় আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবস।
জাতিসংঘ এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্ব্যবহারের অবসান: দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকারী পরিবারের জন্য সম্মান এবং কার্যকর সহায়তা নিশ্চিত করা’।
গত এপ্রিলে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের ৩০ লাখ মানুষ অতি দারিদ্র্যের কবলে পড়তে পারে। অর্থনৈতিক কার্যক্রমে ধীরগতি এবং শ্রম বাজার সংকুচিত হয়ে আসার কারণে বিশ্বব্যাংক দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা করে। সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থনৈতিক কার্যক্রমে ধীরগতির কারণে পিছিয়ে পড়া মানুষেরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সমাজে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া বৈষম্য আরও বাড়বে।

দারিদ্র্যের হার আসলে কত : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয় ও ব্যয় জরিপ-২০২২ অনুযায়ী দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। বিবিএস পাঁচ বছর পরপর এই জরিপ করে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) সাম্প্রতিক এক জরিপ বলছে, দেশে দারিদ্র্যের হার প্রায় ২৮ শতাংশ। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ২০ দশমিক ৫০ শতাংশ হয়েছে। সর্বশেষ অর্থবছরে (২০২৪-২৫) অর্থবছরে যা বেড়ে হয়েছে ২১ দশমিক ২ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর সর্বশেষ প্রতিবেদনে বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে মোট কর্মসংস্থান ২০ লাখ কমে গেছে। ৩০ লাখের বেশি কর্মক্ষম মানুষ শ্রমবাজারের বাইরে।
পিপিআরসির প্রতিবেদনে দেখা যায়, শহরের একটি পরিবারের গড়ে মাসিক আয় ৪০ হাজার ৫৭৮ টাকা। খরচ হয় ৪৪ হাজার ৯৬১ টাকা। জাতীয়ভাবে একটি পরিবারের মাসে গড় আয় ৩২ হাজার ৬৮৫ টাকা। খরচ হয় ৩২ হাজার ৬১৫ টাকা। সঞ্চয় নেই বললেই চলে।

বিবিএসের জরিপে ২০২২ সালে অতিদারিদ্র্যের হার ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রাক্কলন হলো, গত অর্থবছরে বাংলাদেশে অতিদরিদ্র মানুষের হার বেড়ে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ হয়েছে। বিশ্বব্যাংক ক্রয়ক্ষমতার সমতার ভিত্তিতে দৈনিক তিন ডলার আয়ের নিচের মানুষকে অতিদারিদ্র্য হিসেবে গণ্য করে।

গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান সমকালকে বলেন, বিবিএস ২০২২ সালে খানা আয়-ব্যয় জরিপে দারিদ্র্যের হার দেখিয়েছে। এরপর সংস্থাটির পক্ষ থেকে এ-সংক্রান্ত আর কোনো প্রতিবেদন দেওয়া হয়নি। এর পর বিশ্বব্যাংক এবং পিপিআরসি কিংবা অন্যান্য সংস্থার প্রাক্কলনে দেখা গেছে, দেশে দারিদ্র্য আরও বেড়েছে। দারিদ্র্যের হার বাড়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবিরতা চলছে। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমেছে। আবার গত চার বছর ধরে যে হারে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, সে হারে মজুরি বাড়েনি। অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি, বৈষম্যহীন বণ্টন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়িয়ে বেকারত্বের লাগাম টেনে ধরা এবং দারিদ্র্য কমিয়ে আনার পথে আর কোনো বিকল্প নেই।

বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মধ্যে ৪ কোটি মানুষ : দেশের প্রায় চার কোটি মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে। প্রায় ২৪ শতাংশ বা প্রতি চারজনের মধ্যে একজন মানুষ বসবাস করছে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যে। এ ধরনের দারিদ্র্যের হার শহরের তুলনায় গ্রামে প্রায় দ্বিগুণ। প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের মধ্যে বেশি। সবচেয়ে বেশি সিলেট বিভাগে। আর জেলাভিত্তিক হিসাবে সবচেয়ে বেশি বান্দরবানে।সংবাদসুত্র দেনিক সমকাল