১৯শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কি মন্দা ঘনিয়ে আসছে

প্রশ্নটি আমার নয়। তবে বোধ হয় অনেকেরই। সাম্প্রতিক আর্থিক খাতের এক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে স্বয়ং অর্থ উপদেষ্টা সরাসরি না হলেও অনেকটা ইঙ্গিতে এ ধরনের চ্যালেঞ্জের কথাই বললেন। বিদেশিরা, বিশেষ করে বিনিয়োগকারীরা বরং নির্বাচনকেন্দ্রিক কিংবা নির্বাচন–পরবর্তী চ্যালেঞ্জ নিয়ে অনেক কথা বলছেন।

কেউ কেউ আবার ন্যূনতম আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বর্তমান সরকারের দুর্বলতা নিয়ে বেশ চিন্তিত। তাঁরা চিন্তিত এই নিয়ে যে নির্বাচন নিয়ে হাঙ্গামা আরও বেড়ে যাবে কি না। দু-একজন আবার হাঙ্গামা দীর্ঘায়িত হলে অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি না, বিমানবন্দর কিংবা সমুদ্রবন্দরে কাজকর্ম ব্যাহত হবে কি না, এটি নিয়ে চিন্তিত। চিন্তিত এ ধরনের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত করবে কি না, এ নিয়ে।

আমদানি দায় নিষ্পত্তি করা যাবে কি না, এ নিয়ে। নির্বাচনকালীন বা পরবর্তী হাঙ্গামা গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি ডেকে আনতে পারে কি না। আমি অবশ্য তাঁদের বলেই যাচ্ছি, আমি এ ধরনের পরিস্থিতির আশঙ্কা করছি না। কারণ, তাঁরাও যেটা জানেন, আমরাও দেখছি আমাদের প্রবাসী আয় বাড়ছে, রপ্তানি বাড়ছে, বৈদেশিক দায় বাড়লেও বিদেশি সাহায্য বাড়ছে, সরকারের আয় তেমন না বাড়লেও সরকার ঘোষিতভাবে কৃচ্ছ্রতা বজায় রাখার কথা বলছে। আমদানিকে কমিয়ে, বাজার থেকে ডলার কিনে বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।

তবে আশঙ্কা যেন থেকেই যাচ্ছে। আশঙ্কিত সবাই নৈরাশ্যবাদী কি না, আমি অবশ্য জানি না। বিশ্বব্যাংক, এডিবি নৈরাশ্যবাদী কি না, তা–ও আমি জানি না। তবে গত অর্থবছরের শুরুতে ছাত্র-তরুণ নেতৃত্বাধীন গণ-অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, উচ্চ সুদের হার ও লাগামহীন মূল্যস্ফীতির চাপে বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় ধাক্কা খেয়েছে। সার্বিক প্রবৃদ্ধি গত বছরের ৪ দশমিক ২ শতাংশ থেকে কমে ৪ শতাংশে নেমে এসেছে, যা এক দশকের মধ্যে অন্যতম নিম্নস্তর। মূল্যস্ফীতিতে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, সুদের হার বৃদ্ধি, ঋণসংকট, ব্যাংক খাতের অনিশ্চয়তা ও নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের অনীহা অর্থনীতির গতি শ্লথ করে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ উন্নয়ন হালনাগাদ প্রতিবেদনেও অনেকটা এ চিত্র উঠে এসেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই ধীরগতি শুধু প্রবৃদ্ধিকেই নয়, কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও ভবিষ্যৎ উন্নয়ন সম্ভাবনাকেও গুরুতরভাবে বাধাগ্রস্ত করছে।

বিশ্বব্যাংকের উল্লিখিত প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যবসায়িক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেয়। এই সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে এবং মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যাপকভাবে কমে যায়, যা নতুন শিল্প ও উৎপাদন প্রকল্পে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত। উচ্চ সুদের হার, ব্যয়বহুল কাঁচামাল ও অনিশ্চিত মুদ্রানীতি ব্যবসায়ীদের ঝুঁকি নিতে নিরুৎসাহ করেছে। ফলে বিনিয়োগ স্থবিরতা সার্বিক প্রবৃদ্ধিকে টেনে নামিয়েছে।

তবে একই সময়ে রপ্তানি খাত কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে। তৈরি পোশাক, চামড়া, প্লাস্টিক ও কৃষিপণ্য খাতের সাফল্যে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রবাসী আয়ও ইতিহাসের অন্যতম উচ্চপর্যায়ে উঠে এসেছে ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে। বলা হচ্ছে, এই দুটি খাতের ইতিবাচক প্রভাবেই অর্থনীতি পুরোপুরি সংকটে না পড়ে স্থিতিশীল থাকার চেষ্টা করেছে।

কৃষি খাত বছরের শেষ ভাগে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও শিল্প ও নির্মাণ খাতে প্রবৃদ্ধি স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে ছিল। সেবা খাতেও মন্দাভাব বিরাজ করেছে, বিশেষ করে বাণিজ্য, পরিবহন ও আবাসন খাতে কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে। শ্রমবাজারে সংকট আরও প্রকট; ২০২৪ সালে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ছিল ৬০ দশমিক ৯ শতাংশ, যা ২০২৫ সালে নেমে দাঁড়িয়েছে ৫৮ দশমিক ৯ শতাংশে। বিশেষ করে নারীদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ায় মোট কর্মসংস্থান অনুপাত ২ দশমিক ১ শতাংশ কমে ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে বেকারত্বের হার বেড়ে ৩ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছেছে।

অন্যদিকে ব্যাংক খাতে অস্থিতিশীলতা অর্থনীতির দুর্বলতাকে আরও স্পষ্ট করেছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী হিসাব করলে মার্চ ২০২৫ নাগাদ ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের হার দাঁড়ায় ২৪ দশমিক ১ শতাংশে, যা দক্ষিণ এশিয়ার গড়ের তিন গুণের বেশি। মূলধনঝুঁকি অনুপাত কমে ৬ দশমিক ৩ শতাংশে এসেছে, যা ন্যূনতম নিয়ন্ত্রক মান ১০ শতাংশের নিচে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ব্যাংক খাত সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে এবং নতুন ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ’ জারি করেছে।

বহিঃখাতে কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি দেখা গেছে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বৃদ্ধির ফলে আট বছর পর দেশটি প্রথমবারের মতো চলতি হিসাব উদ্বৃত্তে এসেছে ১৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে আমদানি কার্যক্রমের মধ্যেও বৈপরীত্য বিদ্যমান। খাদ্য ও মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি বেড়েছে, কিন্তু যন্ত্রপাতি ও মূলধনি পণ্যের আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, যা ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ ও উৎপাদন সম্প্রসারণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

রাজস্ব খাতের অবস্থা বেশ করুণ। কর আদায় জিডিপির অনুপাতে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে কমে ৬ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। অন্যদিকে ভর্তুকি ও সুদের ব্যয় বেড়ে বর্তমান ব্যয় জিডিপির ৯ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছেছে, আর উন্নয়ন ব্যয় কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৩ শতাংশে। ফলে বাজেট ঘাটতি বেড়ে হয়েছে জিডিপির ৪ দশমিক ৭ শতাংশ।

অধ্যাপক ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার রাজস্ব সংস্কারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন কর নীতি ও প্রশাসনের পৃথক্‌করণ, কর অব্যাহতির ব্যবস্থাপনা সংস্কার এবং বাধ্যতামূলক অনলাইন রিটার্ন দাখিল। তবু সরকারি ঋণ জিডিপির অনুপাতে আরও ভারী হয়েছে, যার প্রায় ৩৭ শতাংশ এখন দেশীয় ব্যাংকব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল।

বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ২০২৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে, যা প্রায় ৪ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে। মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমবে এবং ভোগব্যয় বাড়লে চাহিদা পুনরুদ্ধার হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা, সংস্কার বিলম্ব ও জ্বালানি সরবরাহের ঘাটতি আগামী বছরেও বিনিয়োগ পুনরুদ্ধারের পথে বড় বাধা হিসেবে থেকে যাবে।

তাঁদের মতে, রপ্তানি বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্প আগামী বছরও প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি হবে। তবে আমদানি স্বাভাবিক হলে চলতি হিসাব আবার ঘাটতিতে যেতে পারে। রাজস্ব ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার ধীরে ধীরে ভর্তুকি কমানোর পরিকল্পনা নিচ্ছে, যদিও কৃষি ও জ্বালানি খাতে ব্যয় এখনো বেশি থাকবে। সরকারি ঋণও বাড়ছে—২০২৭ সালের মধ্যে তা জিডিপির ৪১ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ’ বাস্তবায়ন, জরুরি তারল্য সহায়তা (ইএলএ) চালু এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে। অভিজ্ঞদের মতে, এখন প্রয়োজন নীতিগত স্থিতিশীলতা ও বাস্তবসম্মত সংস্কার, যাতে বিনিয়োগ আস্থা ফিরিয়ে অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা যায়।

বিশ্বব্যাংকের কর্তাব্যক্তিরা যেমন সুশাসন আর সরকারের দক্ষতার ওপর জোর দিয়েছেন, তেমনি প্রশাসনের সক্ষমতা, গুণগত ব্যয় ব্যবস্থাপনা আর মানবসম্পদের উন্নয়নের কথাও বলেছেন। আমাদের মতো তাঁদের অনেকেই তাকিয়ে আছেন নির্বাচনের পর নতুন সরকার কীভাবে দেশ চালায়, শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করে আর ব্যক্তি খাতকে প্রণোদিত করে। মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক। ঢাকার দৈনিক প্রথম আলোর সৌজন্যে