১১ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

শেষের পাতা

ব্রেইন ড্রেইন’ এর কবলে যুক্তরাষ্ট্র, ট্রাম্পের নীতির জেরে চাকরি ছেড়েছেন প্রায় ১ লাখ সরকারি কর্মী

ব্রেইন ড্রেইন’ এর কবলে যুক্তরাষ্ট্র, ট্রাম্পের নীতির জেরে চাকরি ছেড়েছেন প্রায় ১ লাখ সরকারি কর্মী

ট্রাম্প প্রশাসনের দেওয়া ‘বিলম্বিত পদত্যাগ কর্মসূচি’ (ডিআরপি) গ্রহণ করে গত মঙ্গলবার ৩০ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চাকরি ছাড়ছেন প্রায় ১ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) দাপটে চাকরির বাজারে যখন টিকে থাকার লড়াই, তখন যুক্তরাষ্ট্রে দেখা যাচ্ছে ঠিক তার উল্টো চিত্র। যেখানে বেসরকারি খাতের কর্মীরা চাকরি আঁকড়ে ধরে আছেন, সেখানে হাজার হাজার কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী স্বেচ্ছায় দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছেন।

ট্রাম্প প্রশাসনের দেওয়া ‘বিলম্বিত পদত্যাগ কর্মসূচি’ (ডিআরপি) গ্রহণ করে আজ মঙ্গলবারই যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চাকরি ছাড়ছেন প্রায় ১ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী। গত প্রায় ৮০ বছরের মধ্যে এক বছরে এত বিপুলসংখ্যক সরকারি কর্মীর একসঙ্গে বিদায় নেওয়ার ঘটনা আর ঘটেনি। এর ফলে প্রশাসনে প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার এক মারাত্মক সংকট তৈরি হতে যাচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

সরকারের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ‘অফিস অব পার্সোনেল ম্যানেজমেন্ট’ (ওপিএম) জানিয়েছে, সব মিলিয়ে প্রায় ১ লাখ ৫৪ হাজার কর্মী এই প্যাকেজ গ্রহণ করেছেন, যাদের বাকিরা এ বছরের শেষ নাগাদ বিদায় নেবেন।

ওপিএমের দাবি, এই বিশাল কর্মী সংকোচনের ফলে দীর্ঘমেয়াদি ব্যয় কমে বছরে প্রায় ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলার সাশ্রয় হবে। যদিও গত জুলাই মাসে সিনেটের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছিল, প্রায় ২ লাখ কর্মীকে আট মাস পর্যন্ত সবেতন ছুটিতে রাখতে এই কর্মসূচিতে সরকারের খরচই হবে প্রায় ১ হাজার ৪৮০ কোটি ডলার।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই কেন্দ্রীয় সরকারের আকার ছোট করার ওপর জোর দিয়ে আসছেন। টেসলার প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্কের নেতৃত্বে তিনি ‘ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি’ (ডোজ) নামে একটি নতুন বিভাগও প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিভাগ প্রথমে সরকারি কাজে ২ ট্রিলিয়ন ডলারের অপচয়, জালিয়াতি ও দুর্নীতি নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দিলেও পরে মাস্ক নিজেই সেই লক্ষ্য কমিয়ে ১৫০ বিলিয়ন ডলারে নামিয়ে আনেন।

গত ফেব্রুয়ারিতে প্রায় ২০ লাখ সরকারি কর্মীর কাছে ‘অ্যা ফর্ক ইন দ্য রোড’ শিরোনামে একটি ই-মেইল পাঠানো হয়। মাস্কের এই শিরোনামটি কুখ্যাত, কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটার (বর্তমান এক্স) অধিগ্রহণের পরও তিনি কর্মীদের কাছে একই শিরোনামে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। সরকারি কর্মীদের পাঠানো ওই বার্তায় সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেতন নিয়ে পদত্যাগ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এর পরপরই হাজার হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করার পর কার্যত ইউএসএআইডির সব কর্মীকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

সব মিলিয়ে ছাঁটাই, প্রবেশনারি কর্মীদের বিদায় এবং পদত্যাগ কর্মসূচি গ্রহণকারীদের নিয়ে এ বছরের শেষ নাগাদ কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ কমবে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এক বছরে সবচেয়ে বড় কর্মী হ্রাসের ঘটনা।

মেধা সংকটের হুঁশিয়ারি : মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোর্ড স্কুল অব পাবলিক পলিসির অধ্যাপক ডন ময়নিহান বলেন, এত বিপুলসংখ্যক অভিজ্ঞ সরকারি কর্মীর বিদায়ের সবচেয়ে বড় প্রভাব হবে মেধা শূন্যতা তৈরি হওয়া।

তিনি মনে করেন, প্রতিভার এই ক্ষতি সহজে পূরণ হওয়ার নয়। ময়নিহান বলেন, ‘এই কর্মীরা যেসব সরকারি কর্মসূচি চালাতেন, সে বিষয়ে গভীর জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে বছরের পর বছর সময় লাগে। এখন সেই জ্ঞানের ভান্ডার দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।’

এক ডজনের বেশি বর্তমান ও সাবেক সরকারি কর্মী এবং ইউনিয়ন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার এই ঘাটতির কারণে অনেক সরকারি সংস্থার পক্ষেই এখন তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালানো এবং জনগণকে সেবা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। আবহাওয়া পূর্বাভাস, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য কর্মসূচি ও মহাকাশ প্রকল্পের মতো সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় আবহাওয়া সংস্থা থেকে প্রায় ২০০ জন কর্মী স্বেচ্ছায় পদত্যাগের সুবিধা নিয়েছেন, যার ফলে অভিজ্ঞ আবহাওয়াবিদ ও কারিগরি কর্মীর সংকট তৈরি হয়েছে। সংস্থাটির এমপ্লয়িজ অর্গানাইজেশনের পরিচালক টম ফাহি বলেন, ‘এর কারণে দেশজুড়ে দপ্তরগুলোতে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।’

নাসা থেকে স্বাস্থ্য খাত, সর্বত্রই প্রভাব : ট্রাম্প প্রশাসনের প্রস্তাব গ্রহণ করে মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার প্রায় ৪ হাজার কর্মী চাকরি ছেড়েছেন। নাসার কর্মীদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ম্যাট বিগস বলেন, ‘সংস্থাটি বিশ্বের সেরা কিছু প্রকৌশলী ও মহাকাশ বিজ্ঞানীকে হারাচ্ছে, কিন্তু তাদের জায়গায় নতুন কাউকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না।’ যদিও নাসার মুখপাত্র শেরিল ওয়ার্নারের দাবি, সংস্থাটি উদ্ভাবন ও গবেষণার এক ‘সুবর্ণ যুগে’ প্রবেশ করতে যাচ্ছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী দক্ষতা মূল্যায়ন করা হচ্ছে।

একই চিত্র কৃষি বিভাগেও। এর অধীনস্থ ‘এগ্রিকালচারাল রিসার্চ সার্ভিস’ (এআরএস) থেকে প্রায় ১ হাজার ২০০ কর্মী চাকরি ছেড়েছেন, যা সংস্থাটির মোট জনবলের ১৭ শতাংশ। তাদের মধ্যে একজন বিজ্ঞানী ছিলেন, যিনি শস্যের গুদামে ছত্রাকের বিষাক্ত উপাদান দ্রুত শনাক্ত করার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তার বিদায়ের ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা এগিয়ে নেওয়ার মতো আর কেউ নেই।

এর প্রভাব পড়েছে সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এবং ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) মতো স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর ওপরও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মী জানিয়েছেন, কর্মী সংকটের কারণে এফডিএ কিশোর-কিশোরীদের তামাক ব্যবহার বিষয়ক জাতীয় সমীক্ষা হালনাগাদ করতে হিমশিম খাচ্ছে।

এর আগে সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের শাসনামলেও বড় ধরনের কর্মী ছাঁটাই হয়েছিল। তবে তার সময়ে শক্তিশালী অর্থনীতির কারণে বেসরকারি খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থান তৈরি হওয়ায় সার্বিক চাকরির বাজারে এর কোনো দৃশ্যমান প্রভাব পড়েনি।

ব্যুরো অফ লেবার স্ট্যাটিসটিকসের তথ্যমতে, এবারও এক সঙ্গে এত বিপুলসংখ্যক কর্মী চাকরি ছাড়লেও তা দেশটির জাতীয় বেকারত্বের হারে তেমন প্রভাব ফেলবে না।