১২ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে উল্টো প্রবণতা বাংলাদেশে

অর্থনীতির দুটি পা। একটি হলো পুঁজিবাজার, অন্যটি ব্যাংক। তবে স্বাধীনতার পর ৫৪ বছর ধরে অর্থায়নে এক পায়ে ভর করে চলছে অর্থনীতি। দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য বন্ড ও পুঁজিবাজার বিশ্বের প্রথম পছন্দ হলেও বাংলাদেশে উল্টো। স্বল্প থেকে দীর্ঘমেয়াদি সব অর্থায়ন করছে ব্যাংক। এভাবে বেশিদূর এগোনো যাবে না। অবিলম্বে শক্তিশালী বন্ড ও পুঁজিবাজার গড়তে হবে।

সোমবার ‘বাংলাদেশের বন্ড ও সুকুক বাজারের উন্নয়ন: রাজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধি, অবকাঠামো বাস্তবায়ন ও ইসলামী মানি মার্কেটের বিকাশ’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। রাজধানীর নিকুঞ্জে ডিএসই টাওয়ারে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) যৌথভাবে এর আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব অরলিন্সের অধ্যাপক এম কবির হাসান। সভাপতিত্ব করেন বিএসইসির চেয়ারম্যান খোন্দকার রাশেদ মাকসুদ।

সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিশ্বের আর কোনো দেশে বিনিয়োগ বাংলাদেশের মতো ব্যাংকনির্ভর নয়। ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের বাইরে চিন্তা করেন না। এটা হতে পারে, ব্যাংক থেকে টাকা নিলে ফেরত না দিয়েও পারা যায়। আবার রাজনৈতিক কারণও থাকতে পারে। সময় এসেছে বদলানোর। তাদের বন্ড ও সুকুক বাজারে আনতে হবে। তবে এ বাজারে আস্থা তৈরি করতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, বেক্সিমকো সুকুকের টাকা কোথায় বিনিয়োগ হয়েছে খুঁজে পেতে কষ্ট হচ্ছে।

অর্থ উপদেষ্টা বলেন, প্রকল্প অর্থায়নে সরকারের অভাব আছে। ব্যবসায়ীরা কর কমাতে বলে, দিতে চায় না। কর কমালে সরকার কর্মচারীদেরই ঠিকমতো বেতন-ভাতা দিতে পারবে না। ব্যবসায়ীদের কর দেওয়ায় অনীহার কারণ, তারা সেবা পান না। করদাতাদের সেবা নিশ্চিত করতে হবে।

ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ঋণভিত্তিক সরকারি প্রকল্পের ধারণা থেকে বের হয়ে নতুন করে চিন্তার সময় এসেছে। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্পের সম্পদকে আর্থিক সিকিউরিটিতে রূপান্তর করে ভবিষ্যৎ প্রকল্পের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। এভাবে আরও মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করা সম্ভব। বন্ড বাজার গড়তে সরকারকে চাহিদা তৈরি করতে হবে। পেনশন ফান্ডকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে ব্যবহার করা যায়। বীমা খাতও বন্ডের চাহিদা তৈরি করতে পারে।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিশ্বে দীর্ঘমেয়াদি পুঁজির সবচেয়ে বড় জোগান আসে বন্ড বাজার থেকে, যার আকার ১৩০ ট্রিলিয়ন ডলার। অর্থায়নে দ্বিতীয় অবস্থানে পুঁজিবাজার থেকে আসে ৯০ ট্রিলিয়ন ডলার। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক খাত তৃতীয় অবস্থানে, আকার ৬০ ট্রিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বন্ড বাজারের তুলনায় ব্যাংক অর্থায়ন অর্ধেকেরও কম। অথচ বাংলাদেশে চিত্র পুরো উল্টো।
তিনি বলেন, দেশে করপোরেট বন্ড বাজার নেই বললেই চলে। যা আছে সরকারের বন্ড। বন্ড বাজারকে সক্রিয় করতে হবে। তিন লাখ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্রকে সিকিউরিটিতে রূপান্তর করে সেকেন্ডারি বাজার গড়া গেলে দ্রুতই বন্ড বাজার তৈরি করা যাবে।

নাজমা মোবারেক বলেন, টেকসই অর্থায়নের জন্য কার্যকর বন্ড বাজারের বিকল্প নেই। বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেন, অর্থনীতিতে অর্থায়নে দুটি পা। একটি ব্যাংক খাত, অন্যটি পুঁজিবাজার। বাংলাদেশের অর্থনীতি এত দিন শুধু ব্যাংক নিয়ে চলেছে। এক পায়ে চলে বেশি দূর যাওয়া যায় না।

রেনাটার সিএফও মুস্তফা আলীম আওলাদ তাঁর কোম্পানির বন্ড অনুমোদন নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা ও অযথা নিয়ন্ত্রণ জটিলতা সৃষ্টির অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘কোন ধরনের বন্ড হবে, সে বিষয়ে এক ইজিএমে শেয়ারহোল্ডারদের কোম্পানিকে সিদ্ধান্ত দেওয়ার পর ফের ইজিএম করার শর্ত দিয়েছে বিএসইসি। আবার বিএসইসির কাছে অনুমতি চাওয়ার জন্য ডিএসই এত তথ্য চেয়েছে যে, ২০ কার্টন তথ্য দিতে হয়েছে। এগুলো খুলে দেখেছে কিনা, জানি না। এত তথ্য দিতে হলে এত টাকা খরচ করে অডিট করাচ্ছি কেন।’

সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন বলেন, বেক্সিমকোর সুকুক নিয়ে অনেক কথা হলেও মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে। আসল টাকা ফেরত দিতে পারবে কিনা, নিশ্চিত নয়। না পারলে বেক্সিমকোর শেয়ার বিক্রি করে টাকা ফেরত পাওয়া যাবে। ঋণ দিলে হয়তো এই আশা থাকত না। ঋণের থেকে বন্ড বা সুকুকই কম ঝুঁকির বিনিয়োগ।
আইএফসির কর্মকর্তা তাহসিনা মোহসিন বলেন, বন্ডের ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের ‘গ্যারান্টি’ যুক্ত করলে মানুষের আস্থা বাড়বে। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক উজমা চৌধুরী বলেন, বন্ড বাজার নতুন। শুরুতে কিছুটা সমস্যা থাকবে, এটা মেনে নিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ইশতেকমাল হোসেন জানান, সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকও বন্ড বাজার গড়তে কাজ করছে। কীভাবে এ বাজার গড়া যায়, তার জন্য একটি প্রতিবেদন সরকারকে দিয়েছে। সবাইকে ১০ হাজার টাকা সরকারি সুকুক কেনার আহ্বান জানান তিনি।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকারী অধ্যাপক এম কবির হাসান বলেন, বাংলাদেশে সব কিছু বেশি বেশি। এত ছোট একটা দেশে ৬০টি ব্যাংক। এত ব্যাংকের দরকার নেই। বর্তমান অর্থনীতি কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারছে না। বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হলে বন্ড ও সুকুকের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিকল্প নেই।