বিশ্ব এখন এক অভাবনীয় পরিবর্তনের মুখোমুখি। দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত পুরোনো বিশ্বব্যবস্থা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক মানচিত্র নতুনভাবে রঙিন হচ্ছে। অথচ বিপুল জনমিতিক সম্ভাবনা নিয়েও আমরা বাংলাদেশের মানুষ অস্ট্রিচের মতো বালুতে মুখ লুকিয়ে সংস্কার, নোট অব ডিসেন্ট, নীলা মার্কেট, টিকটক ইত্যাদি নিয়ে চারদিক গরম করে চলেছি।
মানবেতিহাসের এই প্রথম একই সঙ্গে সবচেয়ে দ্রুতগতির অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনকে করায়ত্ত করাকে মূল দর্শন করে চীন নিজেকে প্রস্তুত করছে একুশ শতকের বিশ্বনেতা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার জন্য। এ জন্যই যে পাশ্চাত্য এতদিন চীনের সাফল্যকে শুধু বাজার অর্থনীতির ফসল হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে, তারা নিজেরা এখন চীনের উত্থান ঠেকানোর পথ খুঁজছে। বুঝতে পারছে, চীনের মডেল একটি সুপরিকল্পিত, গভীরভাবে প্রোথিত আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামোর প্রতিফল, যা মানুষের জীবনকে ইতোমধ্যে প্রভাবিত করেছে এবং এখন বিশ্বব্যবস্থার দিকনির্দেশক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে। পরিবর্তনের স্বপ্নে বিভোর বাংলাদেশের ভবিষ্যতের নায়কদের সফল হতে হলে অবশ্যই চীনের এ উত্থান প্রক্রিয়ায় দৃষ্টি দিতে হবে।
চীনের উত্থান ও উন্নয়নের মডেল তিনটি শক্তিশালী স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, যা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উদ্ভাবন ও সামাজিক সংহতি। এই তিন স্তম্ভের মধ্যে যে সমন্বয় তৈরি হয়েছে, তা বিশাল এক সমাজকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
১. রাজনৈতিক স্তম্ভ: স্থিতিশীলতা ও মেধাভিত্তিক নেতৃত্ব এখানে নেতৃত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়া কঠোর এবং মেধাভিত্তিক। উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের কেবল তাত্ত্বিক জ্ঞান নয়; বাস্তব প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা এবং সাফল্যের ভিত্তিতেই নির্বাচিত করা হয়। নেতাদের আগে বড় প্রদেশ বা অঞ্চল পরিচালনার মাধ্যমে কোটি কোটি মানুষের জীবনযাত্রার চ্যালেঞ্জ বোঝা এবং তা মোকাবিলার দক্ষতা অর্জন করতে হয়। প্রাচীন চীনের মেধাভিত্তিক সিভিল সার্ভিস পদ্ধতির বিবর্তনের প্রতিফল এই আধুনিক মডেল। এতে নির্বাচনের সঙ্গে মনোনয়ন ব্যবস্থার সমন্বয় রয়েছে, যা জনপ্রিয়তা, রাজনৈতিক সমর্থন ও চাপের ওপর নির্ভরশীল নয়। এই লক্ষ্য অর্জনে চীন সর্বাগ্রে তার সরকারি নীতিতে দুর্নীতিকে ঘৃণ্যতম কাজ হিসেবে চিত্রিত করে কঠোর নীতি ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, যা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে ২০১২ সাল থেকে চলমান ‘টাইগার অ্যান্ড ফ্লাইজ’ কার্যক্রমে আরও বেগবান হয়েছে।
সরকারি আইন ও প্রচারণায় ঘৃণ্যতম এই দুর্নীতি উচ্ছেদে শাস্তিও অত্যন্ত কঠোর, যাবজ্জীবন কারদণ্ড ও মৃত্যুদণ্ড; ২০২৪-এর ‘ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্টস’ সামান্য ঘুষের জন্য শাস্তি আরও বাড়িয়েছে। ২০২৫ সালে আকস্মিকভাবে শুরু করা দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে কয়েক হাজার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা-কর্মীকে অপসারণ, জেল-জরিমানা করা ছাড়াও ৫৭ লাখ পার্টি সদস্যকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, যা দেশটির দুর্নীতির বিরুদ্ধে অটল অবস্থান প্রদর্শন করে।
২. অর্থনৈতিক স্তম্ভ: রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা ও বাজার গতিশীলতা চীনের অর্থনীতি একটি অনন্য সংকর ব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে, যা ‘সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি’ নামে পরিচিত। এখানে রাষ্ট্র অর্থনীতির কৌশলগত খাত যেমন ব্যাংকিং, জ্বালানি, পরিবহন ও টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণে রাখে। এটি জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতকে উদ্ভাবন ও প্রতিযোগিতার পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়া হয়। রাষ্ট্রে বিশাল বিশাল অবকাঠামো যেমন রেল, সড়ক, বন্দর ও ডিজিটাল নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে, যা বেসরকারি কোম্পানিগুলোর কার্যক্রমকে আরও প্রসারিত করেছে। বিশাল অভ্যন্তরীণ বাজার এবং প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি চীনা কোম্পানিগুলোকে বিশ্বমানের প্রতিযোগী করেছে। চীনের অর্থনৈতিক মডেল বাজার ও রাষ্ট্রের মধ্যে একটি অভিন্ন সমন্বয় তৈরি করে, যেখানে রাষ্ট্র সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে। তবে বাজারশক্তিও প্রয়োজনমতো এই সম্পদকে নমনীয়ভাবে ব্যবহার এবং বণ্টন করার সুযোগ রাখে। এর মাধ্যমেই রাষ্ট্রীয় নির্দেশনায় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অবকাঠামো, প্রযুক্তি ও উৎপাদন খাত নিয়ন্ত্রণ করে ‘মেড ইন চায়না ২০২৫’ প্রকল্পের মতো নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে, যা উন্নত প্রযুক্তির বিকাশে সরকারি বিনিয়োগ ও নীতি সমর্থন প্রদান করে। অন্যদিকে বাজার গতিশীলতা বেসরকারি উদ্যোগগুলোকে প্রতিযোগিতা ও উদ্ভাবনের সুযোগ করে দেয়। যেমন আলিবাবা ও টেনসেন্টের মতো কোম্পানি ই-কমার্স এবং ডিজিটাল সার্ভিসে বাজার চাহিদা অনুসারে বৃদ্ধি পায়, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে। এটি বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে চীনের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধার মূল উৎস।
৩. সামাজিক স্তম্ভ: রাষ্ট্র ও জনগণের আস্থা ও সহযোগিতা : সরকার জনগণের কল্যাণ ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সরকারের প্রতিক্রিয়া দ্রুত ও কার্যকর। এই আস্থার সম্পর্ক দেশকে বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং জাতীয় লক্ষ্য অর্জনে উল্লেখযোগ্য সমন্বয় ও শক্তি প্রদান করেছে। নাগরিকরা শুধু আইন মেনে চলে না। তারা নীতি প্রণয়নের প্রতিটি স্তরে মত দেয়। এটি চীনের ‘প্রক্রিয়াগত পূর্ণাঙ্গ জনগণতন্ত্রের’ মূল ভিত্তি। রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে অলিখিত আস্থা-বিশ্বাসের চুক্তি অটুট রাখতে গত দুই দশকে অর্ধশত শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে ঘুষ ও অবৈধ অর্থ উপার্জনের কারণে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের এই কঠোর নীতি চীনের সিপিসি সরকারের নাগরিক গ্রহণযোগ্যতা ও সমর্থনকে আরও শক্তিশালী করেছে, যা রাষ্ট্রের ধারাবাহিক ও নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন নিশ্চিত করছে।
পৃথিবীর জানা ইতিহাসে চীনের উত্থানের মডেল অতীতের কোনো মডেলের সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। এটি যেমন পশ্চিমা লিবারেল ডেমোক্রেসি নয়, তেমনি সোভিয়েত-শৈলীর কমিউনিজম নয়, আবার মাও সে তুং-এর প্রদর্শিত পথও নয়। বরং এটি চীনের নিজস্ব ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং বাস্তব চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি অতীতের পতন হওয়া শক্তির নির্যাসের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে তৈরি অনন্য এক উন্নয়ন দর্শন। যখন বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক অসাম্য ও ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার মতো জটিল সমস্যার মুখোমুখি, তখন চীনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, স্থিতিশীলতা ও সমবায় উদ্যোগ অন্যান্য দেশের জন্য অনুসরণীয় বিকল্প হিসেবে দেখা দিয়েছে। একুশ শতকের নেতৃত্ব এশিয়ায় থাকবে এবং তার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে চীন– এটি এখন আর ভবিষ্যদ্বাণী নয়, নিরেট বাস্তবতা। ড. মো. আইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়