বেকারত্বের কশাঘাতে জর্জরিত বাংলাদেশ। বর্তমানে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ২৪ হাজারে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ৮ লাখ ৮৫ হাজারই স্নাতক ডিগ্রিধারী। অর্থাৎ প্রতি তিনজন বেকারের একজন উচ্চশিক্ষিত। গত বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর)বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে মোট বেকার ২৬ লাখ ২৪ হাজার মানুষÑ যার মধ্যে ৮ লাখ ২৪ হাজার নারী এবং ১৮ লাখ পুরুষ রয়েছেন। বিভাগভিত্তিক হিসেবে সবচেয়ে বেশি বেকার ঢাকা বিভাগে ৬ লাখ ৮৭ হাজার জন। এরপর চট্টগ্রামে ৫ লাখ ৮৪ হাজার এবং রাজশাহীতে ৩ লাখ ৫৭ হাজার বেকার রয়েছে। খুলনায় বেকারের সংখ্যা ৩ লাখ ৩১ হাজার, সিলেটে ২ লাখ ১৬ হাজার, রংপুরে ২ লাখ ৬ হাজার, বরিশালে ১ লাখ ৩৯ হাজার এবং ময়মনসিংহে ১ লাখ ৪ হাজার।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুযায়ী, সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করলেই কেউ বেকার হিসেবে গণ্য হবে না। তবে এ দেশের বাস্তবতায় কোনো বেকারের জন্য সপ্তাহে ১ ঘণ্টা কাজ করা জীবনধারণের জন্য যথেষ্ট নয়। দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ মনমতো কাজ না পাওয়ায় ছদ্মবেকার হিসেবে বিবেচিত। উন্নত দেশের তুলনায়, সেখানে সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করলেও রাষ্ট্র থেকে বেকার-ভাতা পেয়ে জীবনধারণের খরচ পূরণ হয়। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সি যুবকদের মধ্যে বেকারত্ব সবচেয়ে বেশি। এই বয়সি তরুণদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। মোট বেকারের ৭৬ শতাংশই এই বয়সের মধ্যে। এ বয়সি যুবকদের মধ্যে প্রায় ২৯ শতাংশ স্নাতক ডিগ্রিধারী। এর অর্থ, স্নাতক ডিগ্রিধারীদের তিনজনে একজন বেকার।
চাকরি খোঁজার পদ্ধতিতে আত্মীয় ও বন্ধুদের মাধ্যমে সাহায্য নেওয়া সবচেয়ে বেশি প্রায় ৩৬ শতাংশ। সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন থেকে চাকরি খুঁজেছেন ২৬ শতাংশ, আর সরাসরি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে চাকরি চেয়েছেন ১২ শতাংশ। কর্মে নিয়োজিত জনসংখ্যার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সর্বোচ্চ ৪৮ দশমিক ২ শতাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, ২২ দশমিক ২ শতাংশ খানাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে এবং ১৮ দশমিক ২ শতাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। শুধু ৪ দশমিক ৭ শতাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। লিঙ্গভিত্তিক বিশ্লেষণে নারীদের বেশি কর্মসংস্থান খানাভিত্তিক খাতে ৪০ দশমিক ২ শতাংশ, বেসরকারি বা যৌথ উদ্যোগ খাতে ২৯ দশমিক ৩ শতাংশ এবং বেসরকারি খাতে ২২ দশমিক ৬ শতাংশ। পুরুষদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ বেসরকারি বা যৌথ উদ্যোগ খাতে, ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ খানাভিত্তিক খাতে এবং ১৭ দশমিক ১ শতাংশ বেসরকারি খাতে কর্মরত।
বিগত ১৫ বছরে কর্মে নিয়োজিত জনবলের প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। ২০১০ সালে মোট কর্মে নিয়োজিত জনবল ৫ কোটি ৪১ লাখ, যেখানে পুরুষ ৩ কোটি ৭৯ লাখ এবং নারী ১ কোটি ৬২ লাখ। ২০২৪ সালে মোট কর্মে নিয়োজিত জনবল ৬ কোটি ৯১ লাখ, যার মধ্যে পুরুষ ৪ কোটি ৬২ লাখ ৩০ হাজার এবং নারী ২ কোটি ২৮ লাখ ৭০ হাজার। বেকারত্বের ধরনগুলো হলোÑ সামঞ্জস্যহীন, বাণিজ্য চক্রজনিত এবং কাঠামোগত। সামঞ্জস্যহীন বেকারত্ব দেখা দেয় শ্রমবাজারে চাহিদা ও সরবরাহের ঘাটতি থাকলে, যেমন উত্তরবঙ্গ ও হাওর অঞ্চলে। বাণিজ্য চক্রজনিত বেকারত্ব অর্থনীতিতে চাঙ্গাভাব বা মন্দাভাবের কারণে হয়। প্রযুক্তি পরিবর্তনের কারণে বেকারত্ব বাড়লে তা কাঠামোগত বেকারত্ব হিসেবে ধরা হয়।
খাতভিত্তিক কর্মসংস্থানে দেখা যায়, মোট কর্মে নিয়োজিত জনবলের মধ্যে সর্বাধিক ৪৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ কৃষি খাতে, ৩৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ সেবা খাতে এবং ১৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ শিল্প খাতে নিয়োজিত। শহরাঞ্চলে সেবা খাতের প্রাধান্য বেশি (৬১ দশমিক ৭২ শতাংশ), পল্লী এলাকায় কৃষি খাতের প্রাধান্য সবচেয়ে বেশি (৫৬ দশমিক ৯২ শতাংশ), এরপর সেবা ২৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ এবং শিল্প খাত ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। সাক্ষরতা অনুযায়ী, মোট জনসংখ্যার ৮১ দশমিক ১৪ শতাংশ বা ৫ কোটি ৬০ লাখ ৭০ হাজার সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। নিরক্ষর জনসংখ্যা ১৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ বা ১ কোটি ৩০ লাখ ৩০ হাজার। পল্লী এলাকায় কর্মরত পুরুষদের ৭৭ দশমিক ২১ শতাংশ সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন, শহরাঞ্চলে ৮৬ দশমিক ৫১ শতাংশ।
শ্রমশক্তি জরিপের এই চিত্র দেশের যুবসমাজ ও শিক্ষিতদের কর্মসংস্থানের জটিলতা তুলে ধরে। শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি, তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত এবং খাতভিত্তিক বৈষম্য স্পষ্ট।