বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, গত তিন বছরের তুলনায় বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরেছে। স্থিতিশীলতার কারণ হচ্ছে, অর্থনীতির অস্থিতিশীলতার পেছনে যারা ছিলেন, তারা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। দেশ থেকে অর্থ পাচার বন্ধ হয়েছে। হুন্ডি কমে গেছে, বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে বেশি। ব্যাংকের লুটপাট বন্ধ হয়েছে। তবে ক্ষুদ্র পর্যায়ে অবস্থার অবনতি হয়েছে। ব্যক্তি বিনিয়োগ, মজুরি হার, দারিদ্র্য ও বৈষম্য আগের চেয়ে বেড়েছে।
ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত মোয়াজ্জেম হোসেন স্মারক বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন। আলোচনার বিষয় ছিল ‘সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং উত্তরণের পথ’। প্রয়াত মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন ইআরএফের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও ইংরেজি দৈনিক দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক। ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের চেয়ারম্যান ও আইসিসিবি সভাপতি মাহবুবুর রহমান মোয়াজ্জেম হোসেনের অবদান তুলে ধরেন। রাজধানীর পুরানা পল্টনে ইআরএফ কার্যালয়ে সংগঠনের সভাপতি দৌলত আক্তার মালার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।
জাহিদ হোসেন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক শুল্ক আরোপ প্রসঙ্গে বলেন, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্কের অনিশ্চয়তা বাংলাদেশের জন্য সুযোগ। ভারত ও চীনের ওপর ট্রাম্প প্রশাসন যে হারে শুল্ক আরোপ করেছে, তাতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অতিরিক্ত ২০৫ কোটি ডলার রপ্তানি করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
মাহবুবুর রহমান বলেন, জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে যে পরিবর্তনের আশা করা হয়েছিল, তা হয়নি; বরং বৈষম্য বেড়েছে।
সংস্কার প্রসঙ্গে : ড. জাহিদ হোসেন বলেন, জনসাধারণ সংস্কার চায়। তবে সংস্কার বাস্তবায়নে যাদের কণ্ঠস্বর প্রভাবিত করে, তাদের মধ্যে সমন্বয় দরকার। অনেকেই ভাবেন, অন্যপক্ষ করবে। আবার রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলেই যে সংস্কার হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। সংস্কারের ‘ডেলিভারি ক্যাপাসিটি’ থাকতে হবে। সংস্কারের জন্য উপদেষ্টা পরিষদ, প্রশাসন, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও নাগরিক সমাজের যৌথ বা সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। এই চার পক্ষ যৌথভাবে কাজ না করলে সংস্কার কোথাও না কোথাও আটকে যাবে। তিনি বলেন, প্রশাসনের অংশগ্রহণ ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়। ব্যবসায়ীরা নীতি-সহায়তাকে গুরুত্ব দেন। কাঠামোগত সংস্কারে তাদের আগ্রহ কম। আর নাগরিক সমাজ বহুত্ববাদে বা
বহুমতে বিভক্ত। বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদ সম্পর্কে তিনি বলেন, কিছু ক্ষেত্রে তারা আন্তরিক, কিছু ক্ষেত্রে সাহসী, কিছু ক্ষেত্রে বেচারা আর কিছু
ক্ষেত্রে দিশাহারা।
অর্থনৈতিক পরিস্থিতি: ড. জাহিদ বলেন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যেসব সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে, সেগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির পক্ষে গেছে। বিশেষ করে জ্বালানির দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। আবার দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এসেছে। নীতিতে শৃঙ্খলা এসেছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে সরকার যা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তার সবকিছুই ঠিক। তিনি বলেন, ২০২৩-২৪-এর তুলনায় বর্তমান অর্থনীতি স্বস্তিদায়ক। রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। তবে বিনিয়োগ কমেছে। কর্মসংস্থানও কমেছে। সার্বিকভাবে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাদ দিলে অর্থনীতির কর্মচাঞ্চল্য উল্লেখযোগ্য বাড়েনি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য এবং পিপিআরসি ও বিআইজিডির গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমলেও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে উন্নতি হয়নি। টাকার মান কমেছে। রিজার্ভ বেড়েছে। আবার কার্পেটের নিচে থাকা খেলাপি ঋণ সামনে আসায় অঙ্কটা বড় হয়েছে। অনেক কঠিন নীতি-উদ্যোগ বাস্তবায়ন হচ্ছে। বিশেষ করে খেলাপি ঋণ হিসাব করার ক্ষেত্রে ১৮০ দিনের পরিবর্তে বকেয়া হলেই মেয়াদোত্তীর্ণ বিবেচনা করা, ঋণের প্রকৃত সুবিধাভোগীর রিপোর্টিং ইত্যাদি ভালো উদ্যোগ।
ক্ষুদ্র বা পরিবার পর্যায়ের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। দরিদ্র নয়, কিন্তু সামান্য অভিঘাতে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবে– এমন পরিবার বেড়েছে। জটিল রোগ রয়েছে– এমন পরিবার বেড়েছে। আবার মানুষ মনে করছে, হয়রানির মাত্রা বেড়েছে। বৈষম্যও বেড়েছে। তিনি বলেন, অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা থাকলেও পারিবারিক পর্যায়ে অবস্থা ভালো নয়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটা মধ্যম আয়ের ফাঁদে ঢুকে গেছে। এ ফাঁদ থেকে উত্তরণের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট, দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংক খাত, লজিস্টিক সিস্টেমের দুর্বলতা, শ্রমবাজার উন্নয়ন না হওয়া এবং প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয় এর অন্যতম কারণ।