জরুরি অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে শুল্ক আরোপ করতে গিয়ে নিজের ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট, পর্যবেক্ষণ আদালতের। বর্তমান পরিস্থিতিতে একে ট্রাম্পের বড় ধাক্কা বলে মনে করা হচ্ছে।
বিভিন্ন দেশের পণ্যের উপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করে সারা বিশ্বের বাণিজ্যকে ধাক্কা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর সেই শুল্ক আরোপের অনেক সিদ্ধান্তকেই শুক্রবার (আমেরিকার স্থানীয় সময়) ‘বেআইনি’ বলেছে আমেরিকার ফেডেরাল সার্কিটের আপিল আদালত। ট্রাম্পকে জানানো হয়েছে, এ ভাবে শুল্ক আরোপ করা যায় না। জরুরি অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে শুল্ক আরোপ করতে গিয়ে নিজের ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট, পর্যবেক্ষণ আদালতের। বর্তমান পরিস্থিতিতে একে ট্রাম্পের বড় ধাক্কা বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও এখনই শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তে কোনও স্থগিতাদেশ দেয়নি আদালত। ট্রাম্পকে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। এ বার তিনি এই আদালতের রায় চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যাবেন।
কিন্তু কেন ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে বেআইনি বলল আদালত? কী আছে আমেরিকার আইনে? কোন আইনকে ঢাল করে শুল্কযুদ্ধে এগোচ্ছিলেন তিনি? সুপ্রিম কোর্টও কি আপিল আদালতের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত হবে? ২৯ আগষ্ট শুক্রবারের রায়ের পর এমন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতির অলিন্দে।
ট্রাম্পের যুক্তি: বিভিন্ন দেশের পণ্যে শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে ১৯৭৭ সালের আন্তর্জাতিক জরুরি অর্থনৈতিক ক্ষমতা আইনকে (আইইইপিএ) ঢাল করেছেন ট্রাম্প। গত মে মাসে আমেরিকার নিম্ন আদালত জানিয়েছিল, এই আইন ব্যবহার করতে গিয়ে কর্তৃত্বের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি। আপিল আদালতও সেই রায় বহাল রেখেছে। গত এপ্রিলে ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, একাধিক দেশের সঙ্গে আমেরিকার ‘বাণিজ্যিক ঘাটতি’ রয়েছে। বন্ধু হোক বা শত্রু, সকলে আমেরিকার বাণিজ্যনীতির সুযোগ নিচ্ছে। এতে মার্কিন উৎপাদনকারীরা সমস্যায় পড়ছেন। এর ভিত্তিতেই জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে বিশেষ অর্থনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করা শুরু করেন তিনি। আমেরিকায় বেআইনি অভিবাসন ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগে গত ফেব্রুয়ারিতে এই আইনের মাধ্যমেই মেক্সিকো, কানাডা এবং চিনের উপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করেছিলেন ট্রাম্প।
আইন কী বলছে : আইইইপিএ অনুযায়ী, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিশেষ এক ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষমতা পান। এর মাধ্যমে তিনি জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে বিভিন্ন অর্থনৈতিক লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এই আইনের অধীনে আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা, বিদেশ নীতি এবং অর্থনীতিকে রক্ষা করতে প্রেসিডেন্ট বিবিধ অর্থনৈতিক পদক্ষেপ করেন। বাইরের কোনও উৎস যদি আমেরিকার অর্থনীতির জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তবে তার বিরুদ্ধেও প্রেসিডেন্ট পদক্ষেপ করতে পারেন।
কেন বেআইনি বলল আদালত: বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ, রফতানি নিয়ন্ত্রণ এবং লেনদেন সীমিত করার ক্ষেত্রে অতীতে একাধিক বার মার্কিন প্রেসিডেন্ট এই আইনকে ব্যবহার করেছেন। ট্রাম্প প্রশাসনের প্রাক্তন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কেলি আন শ-কে উদ্ধৃত করে এই তথ্য জানিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইম্স। তবে এই আইনকে ঢাল করে এর আগে কোনও দেশের উপর শুল্ক আরোপ করা হয়নি। প্রথম থেকেই আইনি বিশেষজ্ঞেরা তা নিয়ে ট্রাম্পকে সাবধান করে আসছিলেন। তাঁরা জানাচ্ছেন, অতীতের মার্কিন প্রেসিডেন্টরা শুল্ক আরোপের জন্য ১৯৬২ সালের বাণিজ্য আইনের ২৩২ ধারাকে ব্যবহার করেছেন। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সেই শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এই কাজের জন্য আইইইপিএ ব্যবহার করা হয়নি। দু’টি আইন কোথায় আলাদা? ১৯৬২ সালের আইনটিতে শুল্ক আরোপের আগে ২৭০ দিনের মধ্যে নির্দিষ্ট তদন্ত এবং রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা বলা হয়। সত্যিই আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা সঙ্কটে কি না, তা আগে নিশ্চিত করতে হয়।
১৯১৭ সালের বাণিজ্য আইনের মাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে যে জরুরি অর্থনৈতিক ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে বার বার তার অপব্যবহার হচ্ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। প্রেসিডেন্টের সেই ক্ষমতাকে সীমিত করার উদ্দেশে মার্কিন কংগ্রেস পরে আইইইপিএ পাশ করে। অনেকের মতে, তদন্তের বিষয়টি এড়াতেই ১৯৬২ সালের বাণিজ্য আইনের পরিবর্তে ট্রাম্প আইইইপিএ ব্যবহার করেছেন।
এর পর কী : আপাতত ট্রাম্পের হাতে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত সময় আছে। তিনি যে দেশের পণ্যের উপর যত শুল্ক আরোপ করেছেন, তত দিন পর্যন্ত সেই শুল্কই কার্যকর থাকবে। আপিল আদালতের রায়ের পর ট্রাম্প সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। এই রায়কে ‘ভুল’ বলেও উল্লেখ করেছেন। জানিয়েছেন, এই রায় প্রযুক্ত হলে আমেরিকার জন্য ‘বিপর্যয়’ নেমে আসবে। অর্থনৈতিক ভাবে আমেরিকা দুর্বল হয়ে পড়বে। আইনি লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত জয় তিনি ছিনিয়ে নিতে পারবেন বলে আত্মবিশ্বাসী। ভারত এবং ব্রাজ়িলের উপর এই মুহূর্তে আমেরিকার রফতানি শুল্ক সর্বোচ্চ। ঘরে-বাইরে ট্রাম্পের নীতি সমালোচিত হয়েছে বার বার। আদালতের রায়ের পর কোন পথে এগোন ট্রাম্প, সে দিকে নজর রয়েছে সকলের।