বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশে কমেছে আমদানি ব্যয়। এ সময় সবচেয়ে বেশি কমেছে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি। সেই সঙ্গে কমছে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি। টানা সাত মাস বিনিয়োগের অন্যতম এই সূচকটি ৭ শতাংশে ঘোরাফিরা করছে। এই দুই গুরুত্বপূর্ণ সূচক কমে যাওয়ায় দেশে বিনিয়োগ এবং শিল্পে স্থবিরতা বার্তা দেয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যানুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে মোট ৬১ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে, যা এর আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে ৭ শতাংশ কম। আগের অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৬ হাজার ৫১৪ কোটি ডলারের পণ্য। তবে পরিমাণের দিক থেকে ২০২৪–২৫ অর্থবছরে আমদানি কিছুটা বেড়েছে।
আলোচ্য সময়ে সবচেয়ে বেশি কমেছে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, বিদায়ী অর্থবছরে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ঋণপত্র (এলসি) খোলার পরিমাণ কমেছে ২৫ দশমিক ৪১ শতাংশ। আর নিষ্পত্তি কমেছে ২৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। আগের অর্থবছরের একই সময়ে নিষ্পত্তি কমেছিল ২৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ। একই সময়ে শিল্পের প্রয়োজনীয় মধ্যবর্তী পণ্য আমদানিতে এলসি খোলা কমেছে ৬ দশমিক ২৬ শতাংশ। আর নিষ্পত্তি কমেছে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। আগের অর্থবছরের একই সময়ে নিষ্পত্তি কমেছিল ১২ শতাংশ।
আগের অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় ডলারসংকট নিয়ে বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছর শুরু হয়েছিল। অর্থবছরের ৩৬ দিনের মাথায় গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। দেশে ডলার নিয়ে আগে থেকে যে সংকট ছিল, তা তখনো আমদানির ক্ষেত্রে বহাল ছিল। সে জন্য নতুন সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। এতে ডলারসংকট অনেকটাই কেটে যায়। যদিও ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানি এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। এখনো অনেক পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে মার্জিন দিতে হয় বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিদায়ী অর্থবছরে বিনিয়োগের অন্যতম নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধিও অব্যাহতভাবে কমছে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ঘরে ছিল। এরপর থেকেই তা ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। সর্বশেষ গত মে মাসে এই ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ। টানা ৭ মাস এই ঋণ প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে ঘোরাফিরা করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, আন্দোলন শুরুর মাস জুলাইয়ে ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও সরকার পতনের মাস আগস্টে তা নেমে যায় ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশে। পরের মাস সেপ্টেম্বরে তা আরও কমে হয় ৯ দশমিক ২০ শতাংশ, যেটি ছিল তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। নিম্নমুখী এ হার পরের মাসে আরও কমে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৩০ শতাংশে। আর নভেম্বরে সেটা কমে ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশে নেমে যায়। বিদায়ী বছরের ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। জানুয়ারিতে তা আরও কমে ৭ দশমিক ১৫ শতাংশে নেমে যায়। ফেব্রুয়ারিতে তা আরও কমে ৬ দশমিক ৮২ শতাংশে নামে। মার্চে তা কিছুটা বেড়ে ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ হলেও এপ্রিলে তা কমে হয় ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। মে মাসে তা আরও কিছুটা কমে ৭ দশমিক ১৭ শতাংশে নেমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে অর্থপ্রবাহ কমিয়ে রাখার যে নীতি ঠিক করেছে, ঋণ প্রবাহের এই প্রবৃদ্ধি তারও অনেক নিচে নেমে গেল। সংকোচনমূলক নীতি বজায় রাখার ধারায় আগের মুদ্রানীতিতে এই লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাড়ে ৯ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে বিনিয়োগ বাড়ার অন্যতম নিয়ামক হচ্ছে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি। এই দুটি সূচক বাড়লে বিনিয়োগ বাড়ে আর কমলে বিনিয়োগ কমে। বিদায়ী অর্থবছরজুড়ে এই দুটি সূচক কমতে থাকায় আগামী দিনে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে মারাত্মক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নতুন গভর্নর তিন দফায় নীতি সুদহার বাড়িয়েছেন। এতে ঋণের সুদহারও বাড়ছে। সবশেষ গত এপ্রিলে ঋণের সুদহার দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ১১ শতাংশ, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। যদিও সুদহার বৃদ্ধির কোনো সুফল জনগণ পায়নি বরং বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি যখন সর্বনিম্ন, তখন মূল্যস্ফীতির হার খুব বেশি কমতে দেখা যাচ্ছে না।
এই অবস্থায় অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস হলো বেসরকারি খাত। শিল্পের উৎপাদন, বিপণন কিংবা সেবা খাতের সিংহভাগই বেসরকারি খাতনির্ভর। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে খাতটিকে ঋণবঞ্চিত করা হচ্ছে। যদিও মূল্যস্ফীতি না কমে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় এখন আরও বাড়ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামীতে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। খেলাপি ঋণ বেড়ে ব্যবসায়ীরা আরও নাজুক পরিস্থিতিতে পড়বেন।
ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, ‘আমরা যারা ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত আছি, তারা বিদ্যমান ব্যবসা কীভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায়, সে চেষ্টা করছি। ব্যবসা সম্প্রসারণ বা নতুন কোনো প্রকল্প নেওয়ার কথা কেউ ভাবছে বলে আমার জানা নেই। সরকারের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ কিংবা কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়ে সরকার কারও সঙ্গে আলোচনায়ও বসছে না। তিনি আরও বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া এখন অনেকটাই দুর্লভ বিষয়। এত উচ্চ সুদ আর ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে নতুন ব্যবসা করাও অনেক কঠিন। আর নতুন ব্যবসা না হলে মূলধনি যন্ত্রিপাতি আমদানি কমবে- এটাই স্বাভাবিক।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এখনো সন্তেুাষজনক না হওয়ায় বিনিয়োগ হচ্ছে না। ফলে ঋণের চাহিদাও বাড়ছে না।
বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ অনেক দিন ধরেই জিডিপির আনুপাতিক হার একই পর্যায়ে অর্থাৎ ২২-২৩ শতাংশেই রয়ে গেছে। বর্তমান সরকার এসব বিষয়ে সচেতন থাকলেও দৃশ্যমান তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতি দীর্ঘদিন চলতে থাকলে বিনিয়োগ স্থবিরতা আরও বাড়বে। বিনিয়োগ না হলে উৎপাদন হবে না, সেই সঙ্গে কর্মসংস্থানও হবে না। ফলে সরকারের যে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, সেটাও অর্জন হবে না।’