১২ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

অদক্ষতা ও অবহেলার কারণে বাংলাদেশ থেকে ঋণ ফেরত নিচ্ছে বিশ্বব্যাংক World Bank on glass building. Mirrored sky and city modern facade. Global capital, business, finance, economy, banking and money concept 3D rendering animation.

অদক্ষতা ও অবহেলার অনন‍্য নজির গড়েছে ‘প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড ডিজিটাল এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ (প্রাইড)’ শীর্ষক প্রকল্প। দেশের বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও ডিজিটাল উদ্যোক্তা তৈরিতে নেওয়া প্রকল্পটির মেয়াদ সাড়ে চার বছর শেষ হলেও কাজ হয়েছে মাত্র ৯ শতাংশ। প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর। এমন বেহাল অবস্থা দেখে বিশ্বব‍্যাংক ৭ কোটি ৫৪ লাখ ডলারের ঋণ বাতিল করেছে; যা দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ৮৬০ কোটি টাকা।

সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) আয়োজিত প্রাইড প্রকল্পের পরামর্শক কমিটির সভায় এ তথ্য উঠে আসে। প্রকল্পের আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি খতিয়ে দেখার জন্য এই সভার আয়োজন করা হয় বলে ইআরডি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করে ইআরডির এক কর্মকর্তা বলেন, এই প্রকল্পের অর্থায়ন বাতিল হওয়ায় দেশের জন্য বড় ধরনের ক্ষতি হলো। কারণ বড় দুটি প্রকল্পে বিশ্বব‍্যাংকের ৪২ হাজার কোটি টাকা ঋণ পেতে বাংলাদেশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেই প্রকল্প দুটির প্রাথমিক কাজ করতেই বিশ্বব‍্যাংক ৫০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করে। সেখান থেকে ঋণ বাতিল করার ফলে পরবর্তী ঋণ পাওয়া নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হলো।

জানা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা থাকায় প্রাইড প্রকল্পটি বর্তমানে পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। পাশাপাশি, প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব‍্যাংক প্রাইড প্রকল্পের জন্য ২০২০ সালের জুনে এই ঋণ অনুমোদন করে। ঋণের আওতায় মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল, কারওয়ান বাজারের জনতা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক (এসটিপি) পুনর্নির্মাণ এবং এর পাশে আরেকটি নতুন এসটিপি নির্মাণের লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছিল।

প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল ২০২৫ সালের মধ্যে আনুমানিক ২ বিলিয়ন ডলার বেসরকারি বিনিয়োগ আহরণ, ১ লাখ ৫০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং নির্বাচিত অর্থনৈতিক অঞ্চল ও সফটওয়্যার পার্কে সামাজিক ও পরিবেশগত মান উন্নয়ন।

কিন্তু পাঁচ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও বিশ্বব্যাংকের মোট প্রতিশ্রুত ঋণের মাত্র ৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ ব্যবহার হয়েছে। বিশ্বব্যাংক এখন পর্যন্ত ৬ কোটি ৮৭ লাখ ২০ হাজার ডলার ছাড় করেছে, যার মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা দুইটিÑ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) ও বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ (বিএইচটিপিএ) মাত্র ৩ কোটি ২৩ লাখ ১০ হাজার ডলার খরচ করতে পেরেছে। অর্থাৎ অর্থ পাওয়ার পরেও অব‍্যবস্থাপনা ও অদক্ষতার কারণে ৩ কোটি ৬৪ লাখ ১০ হাজার ডলার খরচ করতে পারেনি।

জানা গেছে, বেজা জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এনএসইজেড) উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যার প্রাক্কলিত ব্যয় ৩৯ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। অন্যদিকে, হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ ৩ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে ডিজিটাল উদ্যোগ ও উদ্ভাবন ইকো-সিস্টেম (ডিইআইই) প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। দুই প্রকল্পে মোট ব‍্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৪২ হাজার ২০০ কোটি টাকা অর্থাৎ ৮৯.৮ শতাংশ, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। বাকি অর্থ আসবে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে। এই দুই প্রকল্পের ব‍্যয়ের প্রাথমিক ঋণ ছিল বাতিল হওয়া বিশ্বব‍্যাংকের ওই ঋণের অংশ।

এ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে ইআরডি সচিব শাহরিয়ার কাদির সিদ্দিকী বলেন, এত বড় বাজেট থাকা সত্ত্বেও প্রকল্প দুটি এখন পর্যন্ত মাত্র ৯ দশমিক ২০ শতাংশ আর্থিক অগ্রগতি অর্জন করতে পেরেছে, যা খুবই হতাশাজনক।

তিনি বলেন, যেখানে সাড়ে চার বছরেও প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। এক্ষেত্রে সময় বাড়ালেও কীভাবে বাকি ৯০ শতাংশ কার্যক্রম শেষ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

সভায় ডিইআইই প্রকল্পের সহকারী পরিচালক মাহাবুল আলম জানান, দ্বিতীয় এসটিপি ভবনের চারটি বেজমেন্ট স্তরের ছাদ ঢালাই শেষ হয়েছে। এসটিপি-১ পুনর্নির্মাণ ও উন্নয়নের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে ২০২৫ সালের এপ্রিলে।

তবে ইআরডি সচিব বলেন, এসটিপি-১ ভবন খালি করে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভাড়াটিয়াদের সরে যেতে দীর্ঘ সময় লেগে গেছে, যদিও তাদের চুক্তির মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।

এদিকে, এনএসইজেড প্রকল্পের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ফারুক জানান, প্রকল্পের অধীনে ৮১০ কোটি টাকার কার্যাদেশ বাস্তবায়নের পর্যায়ে রয়েছে। আরও ৩৬০ কোটি টাকার কার্যাদেশ অনুমোদনের পর্যায়ে, ৯৮০ কোটি টাকার কার্যাদেশ মূল্যায়ন পর্যায়ে এবং ৯৫৭ কোটি টাকার টেন্ডার এখনও আহ্বানই করা হয়নি।

তিনি আরও বলেন, সাতটি প্রস্তাবিত পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্যাকেজের একটিরও কাজ শুরু হয়নি। এর মধ্যে তিনটি একত্রিত করে একটি বড় প্যাকেজে রূপান্তর করা হয়েছে।

এ ছাড়া তিনি জানান, মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য পূর্ব পরিকল্পনায় থাকা ডেসালিনেশন প্লান্ট বাদ দেওয়া হয়েছে। পরিবর্তে পানি সরবরাহের জন্য ১৭১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মেঘনা নদী থেকে পানি আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রকল্পে বিলম্ব কেবল বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন সংকোচনের দিকেই নয়, বরং সরকারের সক্ষমতা, প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যবস্থার কাঠামোগত ত্রুটি এবং প্রশাসনিক জটিলতার প্রতিফলন। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে, ডিজিটাল কর্মমুখী বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন কেবল নথিপত্রেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। সংবাদসুত্র দৈনিক প্রতিদিনের বাংলাদেশ