ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ঘিরে তৈরি হয়েছে এক নতুন সংকট। “জাতীয় নিরাপত্তা” রক্ষার নামে ভারতে শুরু হয়েছে এক চরম বিতর্কিত ও মানবাধিকারবিরোধী অভিযান- যেখানে কোনো রকম আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই বহু মানুষকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। এদের বেশিরভাগই মুসলিম, অনেকেই ভারতেই জন্মগ্রহণকারী- যারা এখন নিজেদের পরিচয় প্রমাণ করতে না পেরে পরিচয়হীন রাষ্ট্রহীনতার মুখোমুখি।
গুজরাটের সুরাট শহরের বাসিন্দা হাসান শাহ, যিনি দাবি করেছেন তিনি সেখানেই জন্মেছেন ও বসবাস করেছেন দীর্ঘকাল, হঠাৎ এক সকালে পুলিশ তাকে টেনে হিঁচড়ে তুলে নিয়ে যায়। কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নেই, কোনো শুনানি নেই- সোজা চোখে কাপড় বেঁধে তুলে দেওয়া হয় সমুদ্রপথের একটি নৌকায়। তিনদিন ভাসানোর পর তাঁকে পানিতে লাফ দিতে বাধ্য করে বন্দুকের হুমকিতে।
পরে তাকে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড উদ্ধার করে সাতক্ষীরায় নিয়ে যায়। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। কিন্তু শাহের পরিচয়পত্র, মোবাইল, ভোটার আইডি- all gone. আর পরিবারের সঙ্গেও কোনো যোগাযোগ নেই। তার বর্ণনায় উঠে এসেছে, ‘আমি ভারতের ভোটার ছিলাম। আমার সবকিছু ছিল, এখন আমি কিছুই না।’
এই ঘটনা ব্যতিক্রম নয়। দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের অনুসন্ধান বলছে, গত মে ও জুন মাসেই প্রায় ১,৮৮০ জনকে এভাবে ভারত থেকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। গুজরাট, আসাম এবং কাশ্মীর অঞ্চলে এই অভিযানের মাত্রা ছিল ভয়াবহ। মুসলিম অধ্যুষিত বস্তিগুলোতে চালানো হয়েছে তল্লাশি, গ্রেপ্তার, নির্মাণ ভাঙা, নারী ও শিশুসহ শত শত মানুষকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
অভিযান চলার সময় ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হর্ষ সাংভি ঘোষণা দেন, “সব অনুপ্রবেশকারীকে খুঁজে বের করে তাড়ানো হবে।” এরপরেই চাঁদোলা লেক এলাকায় প্রায় ১২,৫০০ ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এর পেছনে যুক্তি দেওয়া হয়- “জাতীয় নিরাপত্তা“।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, কে ঠিক করেছে- কারা অনুপ্রবেশকারী? যারা ভারতেই জন্মেছে, ভোট দিয়েছে, স্কুলে পড়েছে- তাদের পরিচয় কে মুছে দিল?
আবদুর রহমান নামের ২০ বছর বয়সী আরেক যুবক জানান, তাকে শুধু গৃহ থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করাই হয়নি- তাকে মারধর করে জোর করে স্বীকার করানো হয় সে বাংলাদেশ থেকে এসেছে। এরপর চোখ বেঁধে বিমানে, তারপর নৌকায়। তিন দিন নির্যাতনের পর তাকে সমুদ্রপথে জোর করে পানিতে ঠেলে দেওয়া হয়। ভাগ্যক্রমে, সে বাংলাদেশে এসে প্রাণে বেঁচেছে। কিন্তু তার পরিবার, ভবিষ্যৎ, পরিচয়- সবই আজ অনিশ্চিত।
তার পিতার দেওয়া নথিপত্রে প্রমাণ মেলে- রহমান আহমেদাবাদেই জন্মেছেন, সেখানে স্কুলে পড়েছেন। অথচ এসব কিছুই ধোপে টেকে না এক ‘অপারেশন পরিচয় মুছো’র সামনে।
এই অভিযানে সবচেয়ে মর্মান্তিক যে দিকটি উঠে এসেছে তা হলো- নারী ও শিশুদেরও ছাড় দেওয়া হয়নি। ২৮ মে, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী লালমনিরহাটে ৭২ বছর বয়সী মিসমা খাতুনকে ভারতীয় বাহিনী রাতের অন্ধকারে ঠেলে দেয়। তাকে দেখা গেছে অনুনয় করতে, “আমার তো একটা জীবন আছে” কিন্তু কিছুতেই কাজ হয়নি। পরে ভারত তাকে ফের নিয়ে গেলেও- এরপর তিনি নিখোঁজ। তার ছেলে বলছেন, তিনি প্রতিদিন খোঁজ নিচ্ছেন কিন্তু কোনো উত্তর নেই।
এই ধরনের নীরব ‘নির্বাসন‘, বিচারবহির্ভূত বহিষ্কার এবং ঘরবাড়ি ধ্বংস করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। তা সত্ত্বেও, ভারত সরকার কোনো দায় স্বীকার করছে না।
সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা বিএসএফ এই ইস্যুতে কোনও মন্তব্যই করেনি।
লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ মোহসিন আলম ভাট বলেন, “এটা শুধু নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন নয়- এটা আন্তর্জাতিক আইনও ভাঙছে। সংবিধান, মানবিকতা, বিবেক-সবকিছু এ অভিযানে ক্ষতবিক্ষত।”
গুজরাট, যেখানে নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক উত্থান শুরু, সেই রাজ্যে আজ মুসলমানরা ‘জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি’ হয়ে উঠেছেন। আর এই ধারণা জনসচেতনায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ-এর মুজাহিদ নাফিস বলেন, “মানুষ ভয় পাচ্ছে কথা বলতে। কারণ কেউ কথা বললেই তার গায়ে ‘দেশবিরোধী’ তকমা জুটে যাচ্ছে।”
শুধু যাদের নির্বাসন করা হয়েছে তারাই নয়, পরিবার, সন্তান, প্রতিবেশী- সবার জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কেউ জানে না আর কতদিন এই অভিযান চলবে, আর কতজন ‘অদৃশ্য’ হয়ে যাবে এই মারণ নীতির কবলে।
এই অভিযান ভারত ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে নতুন চাপ তৈরি করছে। বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতকে একাধিক বার্তা দিলেও- পরিস্থিতির উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। সবচেয়ে ভয়াবহ সত্য হলো- এই নির্মম বাস্তবতায় যাদের ভাগ্য সাগরের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁচার, তারা নিজের দেশেই যেন পরবাসী হয়ে পড়েছেন।
এই ভয়ংকর মানবিক বিপর্যয়ের সামনে প্রশ্ন একটাই- আপনি কোথায় দাঁড়াবেন? মৌন থেকে এই অন্যায় মেনে নেবেন, নাকি বলবেন- না, এটা চলতে পারে না?