৩০শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

জোহরান মামদানির নিউ ইয়র্ক জয়ের স্বপ্ন, কতটা বাস্তব?

নিউ ইয়র্কের আসন্ন মেয়র নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসেবে জোহরান মামদানির উত্থান বিশ্ব রাজনীতিতে বামপন্থার অবস্থান নিয়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। মার্কিন রাজনীতিতে খুব বেশি পরিচিতি না থাকা সত্ত্বেও ডেমোক্র্যাট প্রাইমারিতে তার জয় অনেকের কাছেই বিস্ময়কর মনে হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক নির্বাচনি ইশতেহার নিয়েও তিনি যেভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এগিয়ে এসেছেন, তা তার অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞারই পরিচয়। বর্তমান বিশ্বে যখন মানুষ শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের উন্নতির চেয়ে সাম্প্রদায়িক প্রতিযোগিতায় বেশি আগ্রহী, তখন মামদানির এই ধরনের নির্বাচনি ইশতেহার বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ তৈরি করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলে ডেমোক্র্যাটদের দীর্ঘদিনের আধিপত্য রয়েছে, অন্যদিকে মাঝের অংশে রিপাবলিকানদের প্রভাব বেশি। নিউ ইয়র্কের মেয়র পদে বর্তমানে ডেমোক্র্যাটরাই রয়েছেন এবং বর্তমান মেয়র হলেন এরিক লেরয় অ্যাডামস। মামদানি ২০২১ সাল থেকে নিউ ইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলিতে ডেমোক্র্যাটদের প্রতিনিধিত্ব করছেন, যা তার জন্য একটি বাড়তি সুবিধা।

তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিণত গণতন্ত্রে কঠোর নিয়ম-নীতি নিয়ে বেশ আলোচনা হয়। এখানে প্রাইমারিতে জয়ী হওয়াও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দলের মধ্যে কে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে লড়বেন, তা এই প্রাইমারিতে নির্ধারিত হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে দলের সদস্য ও সমর্থকদের মতামতের ভিত্তিতে প্রার্থী নির্বাচন সম্পন্ন হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে মামদানির প্রচারণায় নিপীড়িত মানুষের কথা উঠে এসেছে, যা তার দলের এবং বাইরের প্রার্থীদের কাছেও প্রশংসা কুড়িয়েছে।

এখন ডেমোক্র্যাট প্রার্থীদের মধ্যে সমীকরণটি একটু বোঝা যাক। বর্তমান মেয়র অ্যাডামস এবার প্রাইমারিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, যার কারণে নিউ ইয়র্কের সাধারণ মানুষ তার ওপর ক্ষুব্ধ। তিনি যদি এবার নির্বাচনে দাঁড়াতেন, তাহলে তার পক্ষে জেতা কঠিন হতো। তবে নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে তিনি মাঠে নামলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত। ডেমোক্র্যাট প্রাইমারিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকারকারী অ্যান্ড্রু মার্ক কুওমো ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত নিউ ইয়র্কের গভর্নর ছিলেন (এটি মেয়র পদের থেকে ভিন্ন)।

এবার আসা যাক জোহরান মামদানির পারিবারিক পরিচয়ে। মামদানির পূর্বপুরুষরা ভারত থেকে গিয়ে প্রথমে উগান্ডা এবং পরে আমেরিকায় বসবাস শুরু করেন। তার বাবা মাহমুদ, যার পূর্বপুরুষ উগান্ডার ছিলেন, বর্তমানে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনি তানজানিয়া ও উগান্ডায় পড়াশোনা করেছেন। মামদানির মা মীরা নায়ার একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রপরিচালক। মীরা নায়ারের জন্ম ভারতের উড়িষ্যাতে বাঙালি অধ্যুষিত শহর রাউরকেল্লাতে—আর তিনি বড় হয়েছেন ওই রাজ্যের রাজধানী ভুবনেশ্বরে। মীরা ১৯৮৯ সালে ‘মিসিসিপি মসালা’ সিনেমার গবেষণার কাজে উগান্ডার কাম্পালায় গেলে মাহমুদের সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং পরে তারা বিয়ে করেন।

মামদানির জন্ম ১৯৯১ সালের ১৮ অক্টোবর। যদি তিনি জয় হন, তাহলে আগামী বছর ৩৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই নিউ ইয়র্ক শহরের মেয়র পদে অধিষ্ঠিত হবেন। উগান্ডায় জন্ম নেওয়ায় মার্কিন নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি কখনও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। তবে ৪ নভেম্বরের নির্বাচনে নিউ ইয়র্কের মেয়র পদে বসতে পারলে সেটিও কম কিছু হবে না, কারণ এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী পদ।

উল্লেখ্য, মায়ের পাশাপাশি জোহরানের বাবা মাহমুদ মামদানিও বেশ বিখ্যাত মানুষ। তার ‘গুড মুসলিম, ব্যাড মুসলিম: আ পলিটিক্যাল পারস্পেকটিভ অন কালচার অ্যান্ড টেররিজম’ বইটি আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন ও পাকিস্তানের প্রেক্ষাপট নিয়ে লেখা একটি আলোচিত গ্রন্থ।

মামদানির নির্বাচনি প্রচারণায় ছিল প্রত্যেক নিউ ইয়র্ক বাসীর জীবন উন্নত করার প্রতিশ্রুতি। তিনি ‘আধুনিক প্রগতিশীল’ স্রোতে গা না ভাসিয়ে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর ওপর জোর দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে বিনামূল্যে বাস পরিষেবা, ৩০ ডলারের ন্যূনতম মজুরি, বাড়ি ভাড়া কমানো এবং শিশুদের যত্নের মতো মৌলিক বিষয়। তার প্রচারে সরকারি স্কুলে বাচ্চাদের পড়াশোনা, উচ্চ শিক্ষায় খরচ কমানো, নিম্নবিত্ত মানুষকে সস্তায় বা বিনামূল্যে পরিবহন ব্যবস্থার সুযোগ করে দেওয়ার মতো বিষয়ও স্থান পেয়েছে। নিউইয়র্কে ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে যাওয়া বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি উচ্চবিত্তদের ট্যাক্স বাড়ানোর কথাও তিনি বলেছেন।

তার পক্ষে তরুণ ও নিবেদিতপ্রাণ স্বেচ্ছাসেবকদের একটি দল ঘরে ঘরে গিয়ে প্রচারণা চালিয়েছে। তার পক্ষে উল্লেখযোগ্য প্রচারণা চালিয়েছেন বাংলাদেশী আন্টিরাও। সোশ্যাল মিডিয়ার শক্তিশালী প্রচারে এতটাই ব্যাপক সাড়া মিলেছে যে, ডেমোক্র্যাট প্রার্থী অ্যান্ড্রু কুওমো লক্ষ লক্ষ ডলার ব্যয় করেও প্রাইমারি দৌড় থেকে পিছিয়ে পড়েন। জোহরানের এই জয় শুধু তার নিজের দলকেই নয়, ক্ষমতাসীন রিপাবলিকানদেরও বিস্মিত করেছে। রিপাবলিকানরা সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনি প্রচারণার নতুন কৌশল দেখে অবাক হয়েছেন। সহজ কথায়, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত মানুষের উন্নতির কথা বলে মামদানি রাজনীতির মাঠে এগিয়ে এসেছেন।

মামদানির ওপর আক্রমণের দুটি দিক রয়েছে—একজন মার্কিন নাগরিক হয়েও তিনি ‘শ্বেতাঙ্গ’ অভিবাসী নন এবং দ্বিতীয়ত, তিনি একজন মুসলিম। তাই বর্ণবাদ এবং ইসলামোফোবিয়া একসঙ্গে কাজ করেছে। তবুও, তার নির্বাচনি প্রচারণা এত সুপরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে যে, ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান উভয় শিবিরের প্রচারকরা অবাক হয়ে গেছেন। কেউ কেউ তার এই জয়কে ‘অতি বাম’ প্রবণতা হিসাবে বর্ণনা করছেন, আবার কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্রে ‘সামাজিক গণতন্ত্র’ চালু করার চিন্তাভাবনা আছে কিনা, তা নিয়ে ভাবছেন। একইসঙ্গে তার মুসলিম পরিচয় এবং ফিলিস্তিনিদের দুঃখ-কষ্টের কথাও তার প্রচারে উঠে এসেছে। জোহরান নিজের মুসলিম পরিচয় লুকিয়ে রাখার কোনো চেষ্টা করেননি, বরং বুক ফুলিয়ে আরবি-ফারসিতে প্রচারণা চালিয়েছেন।

প্রাইমারিতে মামদানির এই জয় এশিয়ার বাম দলগুলোকে বেশ উচ্ছ্বসিত করছে, কারণ তাদের আদর্শ পুঁজিবাদী দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এই বছরের নভেম্বরে আসন্ন নির্বাচনে নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র পদের জন্য মামদানি অন্যতম দাবিদার। তবে তার দৃঢ় ফিলিস্তিন নীতির অবস্থান তার জয়ের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে বলে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন। যদিও এ বিষয়ে ভিন্ন মতও রয়েছে। নিউ ইয়র্ক সিটি ঐতিহ্যগতভাবে ইহুদিদের একটি শক্ত ঘাঁটি এবং ‘ইহুদি-বিদ্বেষ’-এর বিরুদ্ধে এখানে বেশ শক্ত জনমত রয়েছে। পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, উদারবাদী ভাবনার চারণক্ষেত্র হলেও নিউ ইয়র্ক কিন্তু পুঁজিরও পীঠস্থান। আর তা নিয়ন্ত্রণ করে গত শতকে ইউরোপ থেকে যুক্তেরাষ্ট্রে পাড়ি দেওয়া বেশ কয়েকটি ইহুদি পরিবার। এর ওপর ডনাল্ড ট্রাম্প এই ইস্যুগুলো সামনে রেখে বেশিরভাগ মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে তহবিল বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন, যা পুরো পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

মামদানির কৌশলগত জয় ভবিষ্যতে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নির্বাচনি প্রচার পদ্ধতিতে আরও পরিবর্তন আনবে তা মোটামুটি নিশ্চিত। ফিলিস্তিনপন্থী অবস্থানের জন্য তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে মামদানির দক্ষতা রিপাবলিকান পার্টিতেও উদ্বেগের কারণ হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে ‘ইহুদি-বিদ্বেষের জন্মস্থান’ হিসেবে চিহ্নিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর যে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা পর্যালোচনা করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিকভাবে, বাম এবং সমাজতান্ত্রিক শক্তিগুলো উৎসাহিত হতে পারে। এশিয়ার সমাজতন্ত্রীরা হয়তো মামদানির জয়কে কঠিন সময়ে আশার আলো হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন, যখন গোটা বিশ্ব ডানপন্থায় মোড় নিচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত ফ্যাসিবাদের ধারা আবিষ্কৃত হচ্ছে। সেখানে এই জয় টনিকের মতো কাজ করতে পারে।

একদিকে দক্ষিণপন্থী পুঁজিবাদী ভাষ্য, আর অন্যদিকে উদারবাদী বামপন্থা—এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব যথেষ্ট প্রকট আজকের মার্কিন মুল্লুকে। এই দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতির একদিকে ট্রাম্পের আস্ফালন, অন্যদিকে উদারবাদী বামপন্থী ভাবনায় পুষ্ট বুদ্ধিজীবী বাবা-মায়ের অভিবাসী সন্তান নিউ ইয়র্কের রাজনৈতিক মঞ্চ কাঁপাচ্ছেন। উল্টো দিকটাও মাথায় রাখতে হবে, যেখানে অনেকে ট্রাম্পকে মনে করছেন নতুন যুক্তরাষ্ট্রের রূপকার আর জোহরান এক আপদ। সময়ই হয়তো এই দুই মতাদর্শের জয়-পরাজয় নির্ধারণ করে দেবে। মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও—এর বাইরেও কিন্তু সে দেশের ইতিহাস আছে, যা গণতন্ত্রকে রক্ষা করার ইতিহাস, যেখানে মানুষ পথে নামেন ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে, যেখানে উদারবাদী গণতন্ত্রের স্লোগান হারিয়ে যায় না ট্রাম্পের রাজত্বেও, যেখানে আজও শোনা যাচ্ছে প্রতিবাদীর কণ্ঠ।

আরেকটা বিষয় বলা ভালো যে, মামদানির এই জায়গায় পৌঁছাতে চেষ্টা করেছিলেন বার্নি স্যান্ডার্সও। কিন্তু ২০২০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ডেমোক্র্যাটদের প্রাইমারিতে জিততে পারেননি তিনি। তবে অবাক করা বিষয় হলো সেখানে এবার আরও বেশি বাম-মনস্কতা নিয়ে প্রচারে নেমেছেন জোহরান কোয়ামে মামদানি। এটা ঠিক নিউ ইয়র্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর কিন্তু এটি গোটা যুক্তরাষ্ট্রের মেজাজকে প্রতিফলিত করে না। যদিও এটি সত্যি যে ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি অনেকেরই এখন মোহভঙ্গ হতে শুরু হয়েছে। মামদানি ট্রাম্পের ইসরায়েলপন্থী অবস্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস দেখিয়েছেন। তার আদর্শগত অবস্থানও প্রশংসার যোগ্য। মার্কিন সমাজে এই রকম দৃশ্যমান পরিবর্তন বা কম কি? তাই এই বিশ্ব ব্যবস্থায় মামদানির প্রাইমারিতে জয়কেও একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ হিসেবে মেনে নেওয়াটা যুক্তিযুক্ত।