২৭শে আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

কমিউনিটি

আগষ্টে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় মুক্তি পাচ্ছে জয়া আহসান অভিনীত ‘ডিয়ার মা’

আগষ্টে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় মুক্তি পাচ্ছে জয়া আহসান অভিনীত ‘ডিয়ার মা’

ভারতের দুইবার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরীর নতুন ছবি ‘ডিয়ার মা’। এই ছবিটিতে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের অভিনেত্রী জয়া আহসান। ‘ডিয়ার মা’ সম্পর্কে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছেন অমিতাভ বচ্চন। ছবিটি ভারতে মুক্তি পেয়েছে ১৮ জুলাই। নিউইয়র্কসহ আমেরিকায় ও ক্যানাডায় মুক্তি পাবে আগস্ট মাসে। আমেরিকা ও ক্যানাডায় ‘ডিয়ার মা’ মুক্তি দেবে বায়োস্কোপ ফিল্মস । বায়োস্কোপ ফিল্মস সিইও রাজ হামিদ জানান একটি পরিত্যক্ত শিশুকে কুড়িয়ে পেয়ে বড় করে তুলে ভালোবাসা ও মায়ার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক তৈরি হওয়ার কাহিনী ডিয়ার মা। শিশুটির একটি ‘মা’ ডাক তার নতুন মাকে বিপুলভাবে আলোড়িত করে। রাজ হামিদ জানান, ভয়ংকর বিদ্বেষ, হিংসা আর স্বার্থপরতার এই পৃথিবীতে এ রকম রক্ত সম্পর্কহীন ভালোবাসার কথা বলতে চেয়েছেন নির্মাতা অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী। রাজ হামিদ এই ছবিটি দেখার জন্য আগে থেকেই অনুরোধ জানিয়েছেন বাংলাদেশীদের।

যশোদা-দেবকীর টানাপড়েনের উপাখ্যান, চোখের পাতা ভিজিয়ে দেয় ‘ডিয়ার মা’

এই ছবির গল্প সবথেকে মন ছুঁয়ে যাবে সেই বাবা-মায়েদের যারা সন্তান দত্তক নিয়ে বড় করছেন। এক অনিশ্চয়তা, এক ভয়, এক চাপা আতঙ্ক যেন জড়িয়েই থাকে দত্তক নেবার অন্তরালে। সেই অন্তরাল যদি সরে যায়?

ছবি : ডিয়ার মা। অভিনয়ে : জয়া আহসান, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, চন্দন রায় সান্যাল, সোনালী বসু, পদ্মপ্রিয়া, অহনা, নন্দিকা । পরিচালনা : অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী।

ঈশ্বর এ তোমার কেমন বিচার, যার সন্তানকে তুমি কেড়ে নাও, কেন তাঁর শরীরে রেখে যাও গর্ভধারণের যন্ত্রণা। এরচেয়ে তুমি সেই মাকে একা করে দাও, সে যন্ত্রণা সেই মা সহ্য করে নেবে। এসে নিয়ে যাও, দয়া কর সেই মাকে।

অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরীর সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘ডিয়ার মা’ দেখালো সন্তান দূরে সরে গেলে গর্ভধারিণী মায়ের চেয়েও পালিকা মায়ের যন্ত্রণা কিছু কম নয়। রক্তের সম্পর্কে সে গর্ভধারিণী মা হতে পারেনি, কিন্তু রোজকার যাপনে পালনে স্পর্শে সে হয়ে উঠেছে হৃদয়ে কাছাকাছি গর্ভধারিণী মা। মাম্মা আর মা , দুটি ডাকের মধ্যে বিস্তর দুরত্ব। ছবির প্রোটাগনিস্ট বৃন্দার মা হয়ে ওঠার সফর নিয়েই এই ছবি এক মন কেমন করা রেশ বইয়ে দিল। অনেকদিন পর নিটোল গল্পের সুন্দর ছবি দেখে মন ভাল হয়ে যায়। ‘ডিয়ার মা’ যেন পর্দায় কবিতা। যা চোখের পাতা ভিজিয়ে দেয় প্রতিটি দর্শকের।

এই ছবির গল্প সবথেকে মন ছুঁয়ে যাবে সেই বাবা-মায়েদের যারা সন্তান দত্তক নিয়ে বড় করছেন। এক অনিশ্চয়তা, এক ভয়, এক চাপা আতঙ্ক যেন জড়িয়েই থাকে দত্তক নেবার অন্তরালে। সেই অন্তরাল যদি সরে যায়? দত্তক সন্তান যদি পৌঁছে যায় তাঁর আসল বাবা-মায়ের কাছে তাহলে পালিকা মায়ের মনে কোন যন্ত্রণা চলে! সে তো এত বছরে গর্ভধারিণীর থেকে কম কিছু নয়। শ্রীকৃষ্ণের জীবনে দেবকীর থেকেও তো যশোদা মায়ের গুরুত্ব অনেক বেশি ছিল। পরিচালক অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর এক কঠিন সত্যকে অনুভূতির স্পর্শে দুরন্ত ভাবে তুলে ধরলেন পর্দায়। বর্তমানে দশ মাস দশ দিন সময় দিয়ে মা হওয়ার সময় ব্যস্ততমা নারীদের নেই। সারোগেসি বা দত্তক তাঁদের মা হবার পথ অনেকের কাছেই।

ছবির শুরু হয় স্কুলে গিয়ে ঝিমলির হারিয়ে যাওয়া থেকে। মেয়েকে খুঁজতে খুঁজতেই এক মায়ের লড়াইয়ের গল্প উঠে আসে। অতীতের গল্প পরতে পরতে আসতে থাকে ছবির ফ্ল্যাশব্যাকে।

গল্পে বৃন্দা মিত্র (জয়া আহসান) স্টার্টআপ-এর কোফাউন্ডার, তাঁর স্বামী অর্ক (চন্দন রায়সান্যাল) চায় তাদের সন্তান আসুক এবার পৃথিবীতে। কিন্তু বৃন্দা একেবারেই মা হতে চায় না। স্বামীর সঙ্গে মিলনের আশ্লেষ নিতে সে চায়, কিন্তু বৃন্দা আর অর্কর মাঝে এসে পড়ে শিশ্ন আবরণীর আড়াল।

শেষ অবধি অর্ক আর বৃন্দা দত্তক নেয় এক ফুটফুটে কন্যা সন্তান। সন্তান চাওয়া অর্কই বাবা-মা একাধারে হয়ে ওঠে ঝিমলির। ঝিমলির তিনটি বয়স ধরা হয়েছে ছবিতে। একটি দত্তক সন্তানের নিজের পরিচয় নিয়ে টানাপোড়েন কতখানি হতে পারে তা ঝিমলির তিনটি বয়সে বাস্তব হয়ে উঠেছে পর্দায়। কিন্তু অর্ক খেলার ছলে মজা করে ঘুমিয়ে পড়লে ঝিমলি ভয় পেয়ে যায়। সেই আতঙ্ক সত্যি হয়ে যায় অর্কর মৃত্যুতে। তখন ঝিমলির দরকার ছিল মায়ের। কিন্তু ব্যস্ত বৃন্দা মেয়েকে সময় দিতে পারে না। অনলাইনে সবকিছু অর্ডার করলেই ভাবে মেয়েকে আদর করা হবে। ঠিক তখন ছোটবেলার পোলিও কার্ড থেকে ঝিমলি জানতে পারে তার আসল মায়ের নাম অহনা নায়ার (পদ্মপ্রিয়া)। মেয়ে বৃন্দাকে বলে তাকে ভালবাসে না। বৃন্দা তার মাম্মা, মা নয়। বৃন্দা মেয়েকে বলে ‘যে মা তোমাকে ফেলে দিয়েছিল, তুমি তাদের অনাগত সন্তান বলে, তাকেই তুমি ভালবাসো বলছ!’ আদৌ কী মেয়েকে ফিরে পায় বৃন্দা।

পরিচালক রূপে এক দশক পর বাংলা ছবিতে সফলতার সঙ্গেই ফিরলেন অনিরুদ্ধ টনি রায়চৌধুরী। ছবি নয় কবিতা লিখেছেন তিনি পর্দায়। ছবির বিরতির হলেও কিন্তু সিট ছেড়ে ওঠা যায় না। শেষ অবধি দেখে যেতে হয়।

জয়া আহসান একটি একটি করে নিজের অভিনয়ের তুরুপের তাস বার করেছেন। কখনও তিনি প্রেমিকা, কখনও স্ত্রী, কখনও মা, কখনও চাকুরিরতা। ‘ডিয়ার মা’ র জয়া আটপৌরে মা নয়, স্বামীর উষ্ণ সান্নিধ্য চাদরের তলায় মোহময়ী, ততটাই তিনি স্মার্ট, আবেদনময়ী। সন্তানকে হারাবার মায়ের আতঙ্ক ফুটে ওঠে মুখের প্রতিটি অভিব্যক্তিতে। অন্যদিকে ঝিমলির আসল মা অহনার চরিত্রে পদ্মপ্রিয়া এক দশকের বেশি পর বাংলা ছবিতে। অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর ‘অপরাজিত তুমি’ ছবিতেই পদ্মপ্রিয়া ডেবিউ করেছিলেন বাংলা ছবিতে। আবার সেই পরিচালকের ছবিতেই ফিরলেন। অনবদ্য পদ্মপ্রিয়া। তবে বহু বছর পর অনাগত সন্তানের দেখা পেয়ে আসল মায়ের মুখে কোনও প্রতিক্রিয়া হয় না। এখানে পিছিয়ে পদ্মপ্রিয়ার অভিনয়। তবে তিনি এতদিন পর যে ফিরলেন তা ভাল লাগল।

অন্ধকার সময়ে আরও এক হ্যান্ডসাম হাঙ্ক বাংলা ছবিতে ফিরলেন সায়ণ মুন্সি। বেশ সপ্রতিভ। আরও বাংলা ছবিতে তাঁর যেন দেখা মেলে। আর ছবিতে কমেডি সিরিও অ্যাক্টিং অনবদ্য করলেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। সংসার, বাড়ির রাতের মেনু,ছেলের গিফট কেনার মাঝে কেস সলভ করার দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন শাশ্বত। তিনি এ ছবির আর একটি বলিষ্ঠ স্তম্ভ। আর জয়ার স্বামী অর্কর চরিত্রে কী ভীষণ সাবলীল অভিনয় করলেন চন্দন রায়সান্যাল। স্নেহ, মায়া আর রোম্যান্সে গড়া একটি অনবদ্য চরিত্র। চন্দনের একটি শ্রেষ্ঠ অভিনয় হয়ে থাকল। সাতের দশকের নায়িকা সোনালি গুপ্ত বসু জয়ার মায়ের চরিত্রে খুব মন ছুঁয়ে গেলেন। সেই আভিজাত্য আজও সোনালির। জয়ার বাবার চরিত্রে বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী একদম বাস্তব। বাবা-মায়ের সঙ্গে পুলিশের কথায় প্রথম জানা যায় জয়া যে দত্তক সন্তানের মা।

জয়া চন্দনের কলেজের শিক্ষকের চরিত্রে ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ের উপস্থিতি যেন ভরসার। তবে ‘ডিয়ার মা’ ছবির শো স্টপার ঝিমলি চরিত্রে তিন শিশুশিল্পী। একদম শিশু ঝিমলি বেশ কিউট। তারপর ছোট্ট ঝিমলির রোলে অহনা এককথায় অপূর্ব। ছোট মেয়েটি এত দাপুটে অভিনেতাদের মাঝেও নজর কেড়ে নিয়েছেন। মিষ্টি হাসির মাঝেই লুকিয়ে তার অস্তিত্ব সংকট। মাম্মা আর মায়ের তফাত সে বোঝে। আর টিনএজার ঝিমলির চরিত্রে নন্দিকা ভীষণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে তার ক্ষত বিক্ষত মনটাকে। মাম্মা আর মায়ের মধ্যে আসল মাকে সে খুঁজে বেড়ায়। আর ভীষণ ভাবে জয়ার বাড়ির সাহায্যকারিণী নির্মলার চরিত্রে দাগ কাটলেন অনুভা ফতেপুরিয়া। যে বলে ঝিমলিকে মাম্মাকে এভাবে অপমান করছ! এক চড় খাবে ঝিমলি। পরিচারিকারাও তো অভিভাবক হয়ে যায়।

অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী ও শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য টানটান কাহিনি চিত্রনাট্যে ছবিটি সবার দেখা উচিত। অনবদ্য সংগীতে অনেকদিন পর বিক্রম ঘোষ। বিশেষত জয়ার টানাপোড়েন ঝড়ের রাতে শুভা মুদগলের গানটি অনবদ্য প্রয়োগ। মন কেমন করা গান পাপনের কণ্ঠে ‘মা’। ‘ক্যায়সে কাহুন’ প্রস্মিতার গলায় প্রাণ জুড়োয়।

অর্ঘ্যকমল মিত্রর সম্পাদনা আর একটু ছবিটির দৈর্ঘ্য কমাতে পারত। তাহলে আরও টানটান হত ছবিটি। কিছু দৃশ্য বাড়তি মনে হয়। অভীক মুখোপাধ্যায়ের সিনেমাটোগ্রাফি এ ছবির সম্পদ। যা মুগ্ধ করে।

হ্যাম স্যান্ডউইচ থেকে ভেজ স্যান্ডউইচে জয়ার বিবর্তন যেন তাঁর মাম্মা থেকে মা হয়ে ওঠার মতোই প্রতীকী রেশ রেখে যায় দর্শকের মনে।- দ্য ওয়াল এর সৌজন্যে