নিউইয়র্ক     শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

স্বাধীন সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ হচ্ছে

বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৩ | ০৬:০১ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০৩ মে ২০২৩ | ০৭:১৪ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
স্বাধীন সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ হচ্ছে

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখছেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম। মঞ্চে বসা বাঁ থেকে বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু, নিউ এজের সম্পাদক নূরুল কবীর, ইত্তেফাক-এর সম্পাদক তাসমিমা হোসেন ও সমকাল-এর সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবেছবি: প্রথম আলো

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন স্বাধীন সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে প্রয়োগ হচ্ছে। এটি ভয় দেখানোর জন্যই করা হয়েছে। এখন আইনটির প্রয়োগই অপপ্রয়োগের জায়গায় চলে গেছে বলে মনে করেন দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকেরা। তাঁরা আইনটির বাতিল চেয়েছেন। অথবা আইনটির এমন সংশোধন চেয়েছেন, যাতে স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশ বাধাগ্রস্ত না হয়।

মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভায় এমন মত উঠে আসে। আজ ৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। এ উপলক্ষে গতকাল ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সকল প্রকার মানবাধিকারের চালিকা শক্তি’ শীর্ষক এই আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। আলোচনা সভা থেকে সম্পাদক পরিষদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে পাঁচটি দাবি তুলে ধরেন পরিষদের সভাপতি ও দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম।

দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে: এক. স্বাধীন ও মুক্ত সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে যেসব আইন প্রক্রিয়াধীন আছে, সেটা এখনই স্থগিত করতে হবে। আইনগুলোর খসড়া নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার আগে সাংবাদিক ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিসহ সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। দুই. বিদ্যমান আইনগুলোর মধ্যে গণমাধ্যম ও মুক্ত সাংবাদিকতার প্রতিবন্ধক যেসব ধারা আছে, সেগুলো বাতিল করে আইনের সংশোধন করতে হবে। তিন. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল অথবা এমনভাবে সংশোধন করতে হবে যে এটা কেবল সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। এটা কোনোভাবে মুক্ত গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করবে না। বাতিল বা সংশোধনের আগপর্যন্ত আইনটি স্থগিত রাখতে হবে। চার. সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা সব মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। পাঁচ. মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য সহায়ক হয় এমন তৈরি আইন প্রণয়ন এবং বিদ্যমান ভয়ের পরিবেশ দূর করতে হবে।

আলোচনা সভায় সম্মানিত অতিথি ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু। তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করে গণমাধ্যমবান্ধব করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। একই সঙ্গে তিনি সাইবার জগতের নিরাপত্তার বিধান করার কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। যতক্ষণ না এটি বন্ধ করতে পারছেন, সংশোধন না করতে পারছেন; স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে মামলা দায়ের করবেন। অভিযোগ এলেই গ্রেপ্তার করে চালান দিয়ে কারাগারে পাঠাতে পারবেন না। জামিন পাওয়ার অধিকার থাকতে হবে।’

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভায় বাঁ থেকে বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু, নিউ এজের সম্পাদক নূরুল কবীর, ইত্তেফাক-এর সম্পাদক তাসমিমা হোসেন ও সমকাল-এর সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভায় বাঁ থেকে বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু, নিউ এজের সম্পাদক নূরুল কবীর, ইত্তেফাক-এর সম্পাদক তাসমিমা হোসেন ও সমকাল-এর সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবেছবি: প্রথম আলো

সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, সবাই বলেছেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পর্যালোচনা দরকার। অবশ্যই পর্যালোচনা দরকার এবং সংশোধন দরকার। এটি ঝুলিয়ে রাখা ঠিক নয়। তিনি বলেন, গণমাধ্যমে স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ব্যাপারে কোনো দর-কষাকষি চলতে পারে না। আবার ডিজিটাল জগতের নিরাপত্তা বিধানের জন্যও কোনো রকমের দর-কষাকষি চলতে পারে না। দুটোই থাকতে হবে।

সভাপতির বক্তব্যে দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের প্রায় পাঁচ বছর পর এই উপসংহারে উপনীত হয়েছেন, স্বাধীন সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে আইনটির প্রয়োগ হচ্ছে।

মাহ্ফুজ আনাম বলেন, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে নয়টি আইন বলবৎ আছে, যেগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মুক্ত গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করছে। আরও চারটি আইন প্রক্রিয়াধীন আছে। তার মধ্যে সর্বশেষটি হচ্ছে প্রেস কাউন্সিল আইন। প্রেস কাউন্সিল হচ্ছে গণমাধ্যমের জন্য। কিন্তু গণমাধ্যম জানেই না, আইনের খসড়ায় কী আছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, তিনি নিজে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি হিসেবে প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের কাছে আইনটির খসড়া চেয়েও পাননি।

আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে ইত্তেফাক সম্পাদক তাসমিমা হোসেন বলেন, ‘কণ্ঠ রোধ করার বিষয়টি অনেক পুরোনো বিষয়। যখন ঔপনিবেশিক শাসনে ছিলাম, যখন স্বাধীন হইনি, পরাধীন ছিলাম, তখনো এগুলো দেখেছি।’

সমকাল সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটির প্রয়োগই যে অপপ্রয়োগ, সেটা প্রমাণের জন্য আর অপেক্ষা করতে হয় না। আইনটি ভয় দেখানোর জন্য করা হয়েছে। শিশুদেরও ভয় দেখানো হচ্ছে। মোজাম্মেল হোসেন মনে করেন, পেশাজীবীরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে অনেক সমস্যার সমাধান সহজ হয়ে যাবে।

নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দ্বারা যাঁরা বেশি আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই সাংবাদিক। বিরোধী রাজনৈতিক এবং যাঁরা মুক্তভাবে নিজের মত প্রকাশ করতে চান, স্বাচ্ছন্দ্যভাবে দেশের অসংগতিগুলো পত্রপত্রিকায় তুলে ধরতে চান, তাঁরাই এই আইনের শিকার হয়েছেন।

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অপপ্রয়োগ এবং সাইবার অপরাধ—দুটি বাস্তবতাকেই দেখতে হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল। তিনি বলেন, একটি হলো সাইবার বুলিংয়ের মাধ্যমে নারী-পুরুষকে আক্রান্ত করা হচ্ছে। এটি যেমন রক্ষা করা দরকার, তেমনি সাংবাদিকদের বেলায় অপপ্রয়োগ করবেন, সেটিও গ্রহণযোগ্য নয়। এ জন্য এসব অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা নির্ধারণের জন্য একটি কর্তৃপক্ষ থাকা দরকার।

ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ বলেন, ‘আমাদের বাংলাদেশে বা এশিয়ার বহু দেশে এখন সংবাদপত্রের অবস্থা, সাংবাদিকদের স্বাধীনতার অবস্থা খুবই করুণ বলা যায়। বিশেষ করে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা দুটি পর্যায়ে হরণ করা হচ্ছে। একটি আইনের মাধ্যমে, আরেকটি সাংবাদিকদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে। এটি খুব সূক্ষ্মভাবে করা হচ্ছে।

প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক বলেন, স্বাধীনতা মানেই নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা; শর্ত দিয়ে স্বাধীনতা হয় না। সে জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আইন করা নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে সাংবাদিকেরা এখন অনেক বেশি ‘সেলফ সেন্সর’ বা খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে আত্মনিয়ন্ত্রণ করেন বলে মন্তব্য করেছেন দেশ রূপান্তর–এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোস্তফা মামুন। তিনি বলেন, ‘আমাদের একটা জায়গায় আসা উচিত, সাংবাদিক হলে সাংবাদিকতাই করব। আর যদি প্রচারক হতে চাই, তাহলে সাংবাদিকতা ছেড়ে সে জায়গায়ই যাব।’

আলোচনা অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ।

আন্তর্জাতিক মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার বিকেলে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা বিভাগ আয়োজিত ওয়েবিনারে আলোচকেরা – সূত্র : ইনকিলাব

নাছরিন/পরিচয়

শেয়ার করুন