নিউইয়র্ক     বুধবার, ২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যেভাবে মোবাইল ফোন আমাদের মস্তিষ্ককে পরিবর্তন করছে

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৩ | ০৬:০০ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২৩ | ১০:১৯ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
যেভাবে মোবাইল ফোন আমাদের মস্তিষ্ককে পরিবর্তন করছে

বর্তমান সময়ে মোবাইল ফোনে সময় অপচয় করার মতো মানুষ অগণিত। আর এই অপচয় করার পর সেটি নিয়ে আফসোস করার মতো মানুষের সংখ্যাও কম নয়।

অনেকেই অপচয় কমানোর জন্য বাসার অন্য রুমে মোবাইল ফোন রেখে আসেন। কিন্তু দেখা যায়, কিছুক্ষণ পরেই সেই রুমে গিয়ে আবারো ফোন ব্যবহার শুরু করেছেন। এর একটা কারণ হতে পারে, অনেককিছুই আরও ভালোভাবে ও সহজভাবে করার উপায় সেই মোবাইল ফোনই। বিল পরিশোধ করা? ফোন। কোনো বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করা? ফোন। দূরে থাকা কোনো আত্মীয়ের সাথে যোগাযোগ করা? ফোন। ছবি বা ভিডিও করা, গান শোনা, ক্যালকুলেটর ব্যবহার করা এমনকি টর্চ জ্বালানোর মতো কাজ করতেও আমাদেরকে সেই ফোনটিকেই হাতে নিতে হয়।

এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি দিনে গড়ে ৩৪৪ বার অর্থাৎ প্রতি ৪ মিনিটে একবার মোবাইল ফোন চেক করেন। গড়ে প্রতিদিন তিন ঘণ্টা মোবাইলের পেছনেই ব্যয় করেন তারা। মোবাইল ফোনের একটি বড় সমস্যা হলো, আমরা মোবাইল ফোনে কোনো ছোটখাটো কাজ সম্পন্ন করতে গেলেও অন্য কাজ শুরু করে দেই; ইমেইল চেক করি কিংবা সামাজিক মাধ্যমের অতল নিউজফিডের স্ক্রলিংয়ের মধ্যে হারিয়ে যাই।

মোবাইল ফোনের একটি বড় সমস্যা হলো, আমরা মোবাইল ফোনে কোনো ছোটখাটো কাজ সম্পন্ন করতে গেলেও অন্য কাজ শুরু করে দেই; ইমেইল চেক করি কিংবা সামাজিক মাধ্যমের অতল নিউজফিডের স্ক্রলিংয়ের মধ্যে হারিয়ে যাই।

এটা এক দুষ্টচক্র। আমাদের ফোনগুলো যতটাই কাজের উপযোগী হয়ে ওঠে, আমরা তত বেশি এটা ব্যবহার শুরু করি। আর যতবার এটা ব্যবহার করি, ততবারই আমাদের মস্তিষ্কে ‘যেকোনো কাজের জন্য মোবাইল একটি কার্যকরী বস্তু,’ এই ধারণাটি গেঁথে যেতে শুরু করে। আর এর ফলে আমাদের ফোনে কোনো কাজ না থাকলেও আমাদের হাত নিশপিশ করতে থাকে বারবার মোবাইল ফোন হাতে নেওয়ার জন্য। সামাজিক মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার আর অতিবাস্তব বিউটি ফিল্টার আমাদেরকে ক্ষতি করছে সেটা সর্বজনবিদিত। কিন্তু মোবাইলের প্রতি আমাদের এই অতিনির্ভরতা আমাদের মস্তিষ্কের ওপর কী প্রভাব ফেলছে? এটি কি আমাদের জন্য কেবল ক্ষতিকর? নাকি এর কিছু ভালো দিকও আছে?

ডিভাইসের সাথে আমাদের সম্পর্ক প্রতিবছরই ক্রমাগত হারে বাড়ছে এবং আর এই পরিবর্তন এতটাই যে গবেষণার সংখ্যাও এর সাথে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। এখনো পর্যন্ত আমরা যা জানি তা হলো ফোন চেক করা কিংবা নোটিফিকেশন আসতে দেখা আমাদের মস্তিষ্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটা আশ্চর্যজনক কিছু নয়, কারণ মাল্টিটাস্কিং স্মৃতি এবং পারফরম্যান্স দুটোই কমিয়ে দেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো ড্রাইভিং করতে করতে ফোন ব্যবহার করা। এক গবেষণায় দেখা যায়, টেক্সট নয়, ফোনে কথা বলাও ড্রাইভারদের রাস্তায় মনোযোগের পরিমাণ কমিয়ে দেয় এবং তাদের রিঅ্যাক্ট করার গতি কমে আসে। একইভাবে অন্যান্য ছোট ছোট কাজের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আরেক গবেষণায় দেখা যায়, নোটিফিকেশনের ‘ডিং’ শব্দটিও কল বা টেক্সটিং করার মতোই সমানভাবে কাজ করার গতি কমিয়ে দেয়।

অর্থাৎ, কেবল মোবাইল ফোনের ব্যবহারই নয়, ডিভাইসটির উপস্থিতিও আমাদের কাজের ওপর, আমাদের চিন্তার ওপর প্রভাব ফেলে।

আরেকটি গবেষণাতে অংশগ্রহণকারীদেরকে বলা হয় তাদের মোবাইল হয় তাদের পাশে টেবিলের ওপর (যেখানে রাখলে তারা দেখতে পাবে) অথবা অন্য রুমে (যেখানে রাখলে তারা দেখতে পাবে না) রেখে আসার জন্য। এরপর অংশগ্রহণকারীদেরকে বেশ কিছু কাজ করতে দেওয়া হয়, যার মধ্যে রয়েছে তথ্য প্রসেস করা কিংবা মনে রাখা, সমস্যা সমাধান করা এবং ফোকাস ঠিক রাখার মতো পরীক্ষা।

দেখা যায়, ফোন অন্য রুমে রাখলেই তারা চোখের সামনে থাকার চেয়ে আরও ভালো পারফর্ম করছেন, ফোন চোখের সামনে বন্ধ থাকুক কিংবা অন থাকুক। অংশগ্রহণকারীদের সবার মধ্যেই এই প্রভাব দেখা গিয়েছে, যদিও প্রায় সবাই দাবি করেছেন চোখের সামনে থাকা অবস্থায় তারা সক্রিয়ভাবে মোবাইল ফোনের কথা ভাবেননি।

ফোন আমাদের পাশে থাকলেই সেটি আমাদের ‘ব্রেন ড্রেইন’-এ অবদান রাখে। আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের ফোন চেক করার আকাঙ্ক্ষাকে বাধা দেওয়ার জন্য অবচেতনভাবে পরিশ্রম করতে থাকে। অনেকসময় আমাদের ফোন চেক করা উচিৎ কিনা তা দেখার জন্য প্রতিনিয়ত পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে (যেমন: নোটিফিকেশনের শব্দের জন্য অপেক্ষা করা)। যেটাই হোক না কেন, মনোযোগ হারানোর ফলে আমাদের কাজের গতি ও কর্মদক্ষতা উভয়েই কমে যায়। এটি ঠিক করার একমাত্র উপায় হিসেবে গবেষকরা যে পদ্ধতি খুঁজে পেয়েছেন, সেটি হলো ডিভাইসটিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রুমে রেখে আসা।

এই গবেষণার ফলাফল দেখে মোবাইল ফোন সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা করাটাই স্বাভাবিক। তবে সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় গবেষকরা আমাদের ডিভাইস নির্ভরতার কিছু ইতিবাচক দিকও দেখতে পেয়েছেন।

যেমন: একটি জনপ্রিয় ধারণা হলো আমাদের ফোনের ওপর নির্ভরতা আমাদের মনে রাখার ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এটা এরকম একপাক্ষিক ফলাফল নাও হতে পারে। একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদেরকে মেমরি টেস্টের জন্য একটি পরীক্ষা করা হয়। প্রথমেই অংশগ্রহণকারীদেরকে সংখ্যা লেখা কিছু বৃত্ত দেখানো হয়, যেগুলো মোবাইল স্ক্রিনের যেকোনো একপাশে ড্র্যাগ করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। অংশগ্রহণকারীদের কাজ হলো কোন সংখ্যার বৃত্ত কোনপাশে যাচ্ছে তা মনে রাখা। যে যত উঁচু সংখ্যার সঠিক দিক মনে রাখতে পারবে, সে তত বেশি টাকা পাবে। প্রথমার্ধে তারা তাদের মোবাইল স্ক্রিনে সেটি লিখে রাখার সুযোগ পেল, দ্বিতীয়ার্ধে তাদের মনে রাখার অস্ত্র কেবল তাদের স্মরণশক্তি।

মোবাইল ফোনে লিখে রাখার অংশে তারা যে বেশি টাকা আয় করতে পেরেছিল তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কিন্তু এখানে বিষয় হলো, মোবাইল ফোনে লেখার সময় তারা কেবল উঁচু সংখ্যা নয়, সব সংখ্যাই লিখে রেখেছিল। অন্যদিকে, কেবল স্মরণশক্তি ব্যবহার করার সময় তারা কেবল উঁচু সংখ্যাগুলোকেই মনে রাখার চেষ্টা করেছিল। এর অর্থ, উঁচু সংখ্যাগুলোকে মনে রাখার ভার তারা যন্ত্রের ওপর ছেড়ে দিয়ে নিজেদের স্মরণশক্তিকে তারা অন্য কাজে লাগানোর সুযোগ পেয়েছে।

আমাদের ইচ্ছাশক্তি আর স্মরণশক্তির ওপর আমাদের মোবাইল নির্ভরতা কতটুকু প্রভাব ফেলছে তা জানতে হলে আরও বহু বছরের গবেষণা প্রয়োজন। এই ফাঁকে আমরা এর বাজে প্রভাব কমিয়ে আনার জন্য একটা পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারি।

এক সাম্প্রতিক গবেষণায় পূর্ববর্তী আরেকটি গবেষণা থেকে পাওয়া ফলাফলকে প্রশ্ন করেছে। আমাদের ধারণা অনুয়ায়ী, আমরা যদি আমাদের ইচ্ছাশক্তিকে অবচেতনভাবে ফোন চেক করা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করি, তাহলে আমরা আমাদের শক্তির সামগ্রিক রিজার্ভ ‘ক্ষয়’ হয়ে যায় এবং অন্য কাজে মনোনিবেশ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এটা সত্যি হতে পারে। তবে গবেষকদের মতে এটা মূলত আমাদের বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে।

যারা মনে করেন যে আমাদের মস্তিষ্কের শক্তি ‘সীমিত’, তাদের মধ্যে এই ফলাফল প্রদর্শন করার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু যারা মনে করেন, আমাদের মস্তিষ্কে সীমাহীন শক্তি রয়েছে এবং আমরা যত বেশি এই প্রলোভনকে প্রতিরোধ করব, ততই আমাদের প্রলোভন প্রতিরোধ করার ক্ষমতা শক্তিশালী হয়ে উঠবে, তাদেরকে আবার মোবাইল ফোন তেমন নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে না।

আরও চমকপ্রদ বিষয় হলো, আমাদের মস্তিষ্কের ক্ষমতা সীমিত নাকি সীমাহীন, এই ধারণা অনেকটা সাংস্কৃতিক। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যক্তিরা নিজেদের মস্তিষ্ক ব্যবহারের ক্ষমতা সীমিত মনে করলেও ভারতের মতো অন্যান্য সংস্কৃতিতে একে সীমাহীন মনে করা হয়।

এই গবেষণাগুলোর ফলাফল থেকে কী শিক্ষা নেওয়া যায়? প্রথমত, মোবাইলকে অন্য ঘরে রেখে ফোকাস বাড়ানো, কর্মদক্ষতা বাড়ানো। এবং দ্বিতীয়ত, বারবার মনে করা যে, আমাদের মস্তিষ্কের ক্ষমতা সীমিত নয়, বরং আমাদের ধারণার চেয়েও বেশি ক্ষমতা রয়েছে। এবং প্রতিবার আমরা আমাদের ফোন চেক করার প্রলোভন থামাতে পারলে আমাদের মস্তিষ্কে নতুন নিউরাল পথ তৈরি হবে যেটি আমাদেরকে মনে করাবে যে ফোন চেক না করেও থাকা সম্ভব। এটি বারবার চেক করা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। সূত্র: বিবিসি ফিচার।

শেয়ার করুন