নিউইয়র্ক     শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

সৈয়দ কামরুল

মডেল থেকে রোলমডেল বিবি রাসেল বনাম পাবলিক আর্ট

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ মে ২০২৩ | ১১:২৩ অপরাহ্ণ | আপডেট: ১২ মে ২০২৩ | ১১:৩৭ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
মডেল থেকে রোলমডেল বিবি রাসেল বনাম পাবলিক আর্ট

ফ্যাশন মডেল এরিনায়, ফ্যাশনম্যাগের কভারে এক সময়ের গ্লোবাল আইকন, ফ্যাশানিস্তা বিবি রাসেল ২০১১ সালেঅ্যাস্টোরিয়া, নিউ ইয়র্কে এসেছিলেন। সেখানে বিবির ডিজাইন ও কম্পোজিশনে সাজানো হয়েছিল ‘সন্ধ্যার পিন্ধন’ অর্থাৎ‘ইভনিং অয়্যার’ নিয়ে একটা শো। সেই ক্যাটওয়াকে পাঠ করার জন্য স্ক্রীপ্ট ধরণের একটা যোগানদারি লেখার লেখারফরমায়েশ এসেছিল আমার কাছে। যে ফ্যাশনদূত বায়নাটা এনেছিল সে আমাকে ঠিকঠাক বোঝাতে পারেনি কী তাদের চাই।তাকে দুষে কি হবে! আমরা দর্জি থেকে সফ্টঅয়্যার ডেভেলপার পর্যন্ত যার কাছে যাই কাউকেই ঠিকমতো বোঝাতে পারি না কীআমরা চাই। তবে, তিনি বলেছিলেন এমন কিছু লিখবেন যা বিবির মনঃপূত হয়।

দ্বিধায় পড়ে যাই, কী লিখবো। যে লেখায় পলেমিকস থাকবে না, সাংস্কৃতিক অপেক্ষবাদের প্রতর্ক থাকবে না, তা কেনো লিখবোডক্টর ফস্টাস! এ ধরণের লেখার জন্য ঘোস্টরাইটার হচ্ছে মোক্ষম। ওরা গাহেকের মন পড়তে পটু এবং লিখতে পারে গাহেকের মনজুগিয়ে-জাগিয়ে জবরদস্ত লেখা।

সত্যি বলতে কি আমি তখন পর্যন্ত পেগি রাসেল সম্পর্কে যতোটুকু জানতাম তার সিকিভাগও বিবি রাসেল সম্পর্কে জানতাম না।হোমওয়ার্ক করতে গিয়ে দেখি বিবির একটা বর্ণাঢ্য জীবন রোদেলা ছড়ানো দুই ভুবনে — ঢাকার সেক্যুলার সাংস্কৃতিক পরিবেশআর ট্রান্স-আটলান্টিক ফ্যাশন ভুবনে।

বিবি রাসেল প্রমিত ছন্দের স্পন্দন তুলে শীলিত পায়ে হেঁটেছিলেন প্যারী, মিলান ও লন্ডনের রানওয়ে ও র‍্যাম্পে। মশহুরফ্যাশানম্যাগের কভারে তার ভঙ্গী ছিল দারুণ দাপটের। সেখানে ছিলেন তিনি আমাদের অপরুপ অহঙ্কার, ছিলেন অথেন্টিককালচারাল ডিপ্লোম্যাট। বিবি বড় মাপের পার্সোনা। বড়মাপের মানুষ যাদের ব্যক্তিত্ব আইকনোক্লাস্টিক, পরবাসে নয়দুয়ারী মাধুকরী পড়ে থাকে না কুক্ষণেআচরি।

বিবি ট্রান্স-আটলান্টিক ফ্যাশনের যাদুকরী হাতছানি উপেক্ষা করে একটি চমৎকার সকালে ফিরে গেলেন ঢাকায়। তার ফেরারসঙ্গে ভারতীয় নাটকের এক কিংবদন্তী নাট্যবিদ হাবিব তানভীরের লন্ডন থেকে দিল্লীতে ফেরার একটা মিল দেখতে পাই। যারঅন্তরে রয়েছে স্বদেশ সন্ধান।

হাবিব তার অন্বেষার নাটকের দিশা খুঁজে পেতে গিয়েছিলেন লন্ডনে রয়্যাল অ্যকাডেমি অব ড্রামাটিক আর্টস, সংক্ষেপে যাকে বলাহয়, রাডা। হাবিব রাডা এবং ওল্ড ভিক থিয়েটারে অনেকগুলো বছর নাটকের গবেষণা করেছিলেন। কিন্তু তার এষণা পূর্ণ হলো না। তিনিপেলেন না খুঁজে তার অন্বেষার দিশা।

হাবিব বিলেত ছাড়লেন বিফল মনোরথ। ফেরার পথে স্টপওভার করলেন বার্লিনে। সেখানে বেবে অর্থাৎ বের্টল্ট ব্রেখস্ট এর মঞ্চনাটক দেখে আচমকা পেয়ে গেলেন তার ঈপ্সিত নাটক — মা ও মাটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী নাটক, ইন্ডিজেনাস নাটকের দিশা। ফিরতেফিরতে হাবিব খুলতে থাকলেন রাডা’র অ্যাকাডেমিক নাট্যজ্ঞান, আনলার্ন করতে থাকলেন রাডার তালিম। খুলে ফেললেনরাডার রয়্যাল আলখাল্লা।

হাবিবের মতো বিবিও খুলে ফেললেন তার গা থেকে প্যারীর অওট কটিউর (haute couture) এবং গায়ে জড়িয়ে নিলেন গামছা— লোকজ জীবনের সঙ্গে মিশে যাওয়ার প্রতীকী ইশতেহার। গামছার এ রকম ব্যবহার আগেও দেখেছি বঙ্গবীরের স্তিমিত গ্রীবায়কেশরের মতো টাঙ্গাইলের সস্তা চটকদারী গামছা। একই গামছার দুই ধারা — রাজনীতির ফ্যাশন এবং ফ্যাশনের রাজনীতি।দুটোই ফ্লপ।

ফ্যাশন জগতটা এপলিটিক্যাল সেখানে রাজনীতি যেনো টাবু। মডেল এবং ডিজাইনার — দু’পক্ষকেই থাকতে হয় ‘কুল পার্সোনা’ সেজে। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে ধর্মকে ফ্যাশন-পুলিশ বানিয়ে ফ্যাশন ডিজাইনারদেরকে শাসন করা হয়। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি ডিজাইনারএবং মডেলদের হুকুম করে তারা যেনো পলিটিক্স ও স্যোসাল অ্যাক্টিভিজম থেকে বিরত থাকে।

ট্রান্স-আটলান্টিক ফ্যাশনের যে জগৎ, সেটা এক ধরণের সার্ফডম এবং সেখানকার বাসিন্দা অর্থাৎ মডেল, ডিজাইনার, ফ্যাশন-ম্যাগ, ম্যাগের সম্পাদক ও বিজ্ঞাপনদাতা — সবাই ক্রীড়নক গুটি কতোক বিকারগ্রস্থ লোকের কাছে। ট্রান্স-আটলান্টিক ফ্যাশনবিদেরা ফ্যাশনের নামে নারীরূপ, নারী-সৌন্দর্যকে রি-ডিফাইন করে চলেছে। হাইপারথিন ইমেজ হচ্ছেতাদের চোখে নারী-সৌন্দর্য।

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় ওঁর ‘ফিরোজা’ গল্পে লিখেছেন, ফিরোজার পা দুটো যেনো স্বর্গের সিঁড়ি। সেই চরণ-স্বর্গকে এখন বানানোহচ্ছে পাঠকাঠির মতো লিকলিকে ঠ্যাং। সেই ঠ্যাংয়ের উপরে যে বডি-ট্র্যাঙ্ক, সেখানে বসিয়ে দেয়া হচ্ছে অগমেন্টেড ব্রেস্ট। কার্টুনকরে কয়। যাদের বুকে ওরা সিলিকন ঢুকিয়ে অগমেন্টেড ম্যামপ্লাস্টি করতে পারে না, তাদের বুক ডিজিটাল প্রযুক্তি কৌশলে টেনেহিঁচড়ে খায়েশ মতো বড় বানিয়ে ফ্যাশনম্যাগের কভারে ছাপছে।

এটা কি ধিক্কার দেয়ার মতে ঘটনা নয়?

নারী-মর্যাদায়নের ক্ষেত্রে এটা কি নিন্দনীয় নয়?

নারীর মর্যাদার বিপক্ষে এই অপমানজনক অধোঃগতি যারা করে চলেছে তাদের বিরুদ্ধে বিবি রাসেল কি কখনো কোনো প্রতিবাদকরেছেন? সাতানব্বুইয়ের অক্টোবর সংখ্যা কজমোপলিটান এর প্রচ্ছদে মডেল, অভিনেত্রী এলিজাবেথ হার্লির স্তন ডিজিটালি পাঁচ ইঞ্চিস্ফীত করে ছেপেছিল। হার্লি সেই বিকৃতির প্রতিবাদ করেছিলেন। ওই পর্যন্তই! হার্লির কন্ঠে আর কেউ কন্ঠ মিলিয়ে এগিয়েআসেনি।

কারণ? ওই যে বললাম, ‘কুল পার্সোনা’ সেজে থাকতে হবে ফ্যাশন জগতের সবাইকে। তবে প্রতিবাদ কেউই করে না সেটা বলাযাবে না। কেউ কেউ মৃদু স্বরে প্রত্যুক্তির ললিত বাণী শোনায় বৈকি। ওরা ঝরাপাতা গো ঝরাপাতা। ওরা সব এক সময়ের মডেলডিজাইনার, ফ্যাশানিস্তা। নিজ নিজ ক্ষেত্রে ভাটার টান পড়তেই ওরা রাতারাতি ফ্যাশন-অ্যাক্টিভিস্ট বনে যায় এবং তা‘pleasing sonic aesthetics’ অর্থাৎ ‘আনন্দদায়ক ধ্বনিতরঙ্গ নান্দনিকতার’ মতো শব্দিত হয়। কিন্তু বিরুদ্ধ প্রত্যুক্তি কখনোশাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তন্ময়তার মতো বাজে না।

বিবি রাসেল এখন শুধুই একজন ফ্যাশন মডেল নন; তিনি পুরো মাত্রায় একজন ফ্যাশন-অ্যাক্টিভিস্ট। সম্পূর্ণভাবে একজন ‘কুলপার্সোনা’। প্রশ্ন জাগে, তার অবস্থানটা ব্যক্তিগত নিরাপদ খোয়াড় থেকে ঝুঁকিপূর্ণ সামাজিক প্রতিবাদের কোন্ স্পেকট্রাম বাজায়গায়?

অ্যাক্টিভিজমের শুরুটা ঘটে ব্যক্তিগত বলয়ে পট পাল্টানোর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে। ‘activism is all about taking action to bring about change. It is, ultimately, about disrupting the status quo. Change has to happen with each person individually before we can expect the system to change.’

বিবি রাসেল কি ফ্যাশন জগতের status quo (স্ট্যাটাস কো) ভেঙ্গে সামাজিক প্রতিবাদের কাতারে মিলিত হতে পেরেছেন? ফ্যাশন তো শুধু ফাংশনাল আর্ট নয়; পাবলিক আর্ট বটে। এ কথাটা তো আপা জানেন, design + design-activism = public art. নিউ ইয়র্ক মে ২০২৩।

সুইটি/পরিচয়

শেয়ার করুন