নিউইয়র্ক     বৃহস্পতিবার, ২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

বাজেট নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় যা বললেন অর্থনীতিবিদরা

বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৩ | ১১:২৯ অপরাহ্ণ | আপডেট: ০১ জুন ২০২৩ | ১১:৩৫ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
বাজেট নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় যা বললেন অর্থনীতিবিদরা

২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। প্রস্তাবিত এ বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ শতাংশ। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ঠিক করা হয়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ।

সরকার প্রস্তাবিত এ বাজেটে মূল্যস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য ঠিক করেছে তা বাস্তবসম্মত নয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রবৃদ্ধি অর্জনসহ বাজেটে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন বার্তা নেই। ঘোষিত বাজেট চলমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে গতানুগতিক বলে মনে করেছেন অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা। বৃহস্পতিবার (১ জুন) জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করার পর এক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এসব কথা বলেন অর্থনীতিবিদরা। জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে নতুন অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট সংসদে পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে বড় ধাক্কা আসবে

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাজেটের আকার বড় হলেও অন্যান্য দেশের তুলনায় এমনকি দেশের জিডিপির অনুপাতেও বাজেটের আকার অনেক ছোট। তারপরও বলবো সেটা কোন বিষয় না, বিষয় হচ্ছে বাস্তবায়ন। ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে বড় ধাক্কা আসবে। অর্থাৎ বেসরকারি খাত প্রয়োজনীয় ঋণ পাবে না। আর যদি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় তাহলে তা মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়বে


সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

তিনি বলেন, প্রতি বছরই বাজেটের আকারের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বিশেষ করে, এডিপি বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে যেসব প্রকল্প নির্ধারণ করা হয়, প্রথম ৭ থেকে ৮ মাসে এর ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আর শেষের দিকে তাড়াহুড়া করে ৮০ বা ৮০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হয়। এক্ষেত্রে কাজের মান ঠিক থাকে না, অনেক সময় কাজ না করেও ঠিকাদারদের বিল পরিশোধ করা হয়ে থাকে। তাই জনগণের কল্যাণে বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ সুষ্ঠভাবে ব্যবহার করার পরামর্শ দেন তিনি।

বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রেও আমাদের চরম ব্যর্থতা রয়েছে। তারপরও প্রতি বছরই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হচ্ছে। এবারো রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে বাজেটে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা বাস্তবসম্মত নয়। এক্ষেত্রে বড় রকমের কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব নয়। এসব সমস্যা দূরীকরণে এবারের বাজেটে তেমন কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি। তিনি আরও বলেন, বাজেটে যে বড় আকারের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, সেটা মেটাতে ব্যাংকের উপরই নির্ভর করছে সরকার। এক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে বড় ধাক্কা আসবে। অর্থাৎ বেসরকারি খাত প্রয়োজনীয় ঋণ পাবে না। আর যদি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় তাহলে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়বে।

পরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই, বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব নয়

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরকে বলেন, খোঁড়া ঘোড়াকে যদি জোরে দৌড়াতে বলা হয়, তাহলে কি তা সম্ভব? আমাদের রাজস্ব আদায়ের যে কৌশল, সেটা আসলে সেরকমই। রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা তা অর্জন করা সম্ভব হবে না। ফলে সরকারকে ব্যয়ের লক্ষ্যও কমাতে হবে। অর্থাৎ সরকার যে বাজেট প্রস্তাব করেছে, তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। কারণ সরকারের পরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই।

পিআরআইবির নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর

তিনি বলেন, বাজেটের যে ঘাটতির কথা বলা হয়েছে, সেটা মেটানোর সামর্থ্য আমাদের আছে কি-না, সেটাও বড় প্রশ্ন। আমি মনে করি, আগে বাজেট ঘাটতি আমাদের ৫ শতাংশ বা তার একটু বেশি হলেও সমস্যা হতো না। কিন্তু বর্তমানে আমাদের সেই সক্ষমতা নেই। কারণ সরকারের আয় আসে রাজস্ব থেকে। সেই রাজস্ব সক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। ফলে রাজস্ব আদায় কমে গেছে। ধার করা সামর্থ্য তো প্রকৃত সামর্থ্য না। তিনি আরও বলেন, রাজস্ব সক্ষমতা কমার কারণেই আমাদের আর্থিক খাত দুর্বল হয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, আর্থিক খাতকেও ধ্বংস করা হয়েছে। এতে আমাদের আমানত প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। আর আমানত কমে যাওয়ায় সরকারের ধার করার ক্ষেত্রও কমে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেশি ধার করবে, হাই ভ্যালু মানি হিসেবে যা সরাসরি মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলবে।

বাজেট ঘাটতি পূরণের সক্ষমতা আমাদের নেই মন্তব্য করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আমাদের বৈদেশিক ক্ষেত্রে ধার করার সক্ষমতাও কমে গেছে। আন্তর্জাতিক ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান মুডিসও বাংলাদেশের ঋণমান একধাপ কমিয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও আমাদের বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ১২ বিলিয়ন ডলার বা এক লাখ কোটি টাকারও বেশি আমাদের বিদেশ থেকে ধার করতে হবে। সেটাও সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না।

বাজেটে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য কিছুই নেই

বাজেটে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য কিছুই নেই বলছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। চলমান পরিস্থিতির সঙ্গে প্রস্তাবিত বাজেটের কোনো সামঞ্জস্য নেই। এক কথায় বলতে গেলে এটা ‘চ্যালেঞ্জের মুখে গতানুগতিক বাজেট’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

বাজেট প্রতিক্রিয়ায় তিনি জানান, দেশের চলমান পরিস্থিতির সঙ্গে প্রস্তাবিত বাজেটের কোনো সামঞ্জস্য নেই। মূল্যস্ফীতি কমানোর পদক্ষেপ, খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য স্বস্তির বার্তা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই বাজেটে। সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এবার ব্যাংক খাত থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। কিন্তু যেই বাজারে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের উপরে, সেখানে সরকার যদি ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নেয় তাহলে মূল্যস্ফীতি কমানো অসম্ভব। মূল্যস্ফীতি প্রক্ষেপিত লক্ষ্য ৬ শতাংশে আসবে কীভাবে আমার জানা নেই।

তিনি বলেন, ব্যাংক থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে তার প্রভাব পড়বে। নেতিবাচক প্রভাব পড়বে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে। অতিদরিদ্রদের জন্য সামান্য কিছু থাকলেও খেটে খাওয়া মানুষের জন্য কিছুই নেই। এসব খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ বাড়ালে কর্মসংস্থান বাড়ত। সঙ্গে বৃদ্ধি পেত উৎপাদন। মূল্যস্ফীতিও কমে আসত। এক কথায় বলতে গেলে এটা ‘চ্যালেঞ্জের মুখে গতানুগতিক বাজেট’।

বাজেট বাস্তবতা বিবর্জিত, অর্জন করা সম্ভব নয়

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত বাজেটে স্বীকৃতি ও সমাধান দুটোই অপ্রতুল। সামষ্টিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রস্তাবিত বাজেটে যেসব প্রস্তাব করা হয়েছে, তা বাস্তবতা বিবর্জিত। সেগুলো অর্জন করা সম্ভব নয়। মূল্যস্ফীতির চাপ ও পণ্যের লাগাম টেনে ধরার জন্য বাজেটে যেসব সমাধান দেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব নয়

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন

তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির চাপ ও পণ্যের লাগাম টেনে ধরার জন্য বাজেটে যেসব সমাধান দেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এমনকি মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার যে কথা বলা হয়েছে সেটাও এই বাজেটের মাধ্যমে করা সম্ভব হবে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় যে পণ্যগুলো আমদানি করা হয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে যদি করের হার কমানো হতো, তাহলে জনগণ স্বস্তি পেত। তার প্রতিফলনও বাজেটে দেখা যায়নি। সূত্র : ঢাকা পোস্ট

এসএ/এমএএস/এমইউএ/টিএ/পরিচয়

শেয়ার করুন