নিউইয়র্ক     শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ফিরে দেখা

সোহানা নাজনীন

প্রকাশ: ০৬ মে ২০২৩ | ১২:০৮ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০৬ মে ২০২৩ | ১২:০৮ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
ফিরে দেখা

প্রায় পয়ত্রিশ বছর পর ডাঃ পুনব্রত কে খুজে পেলাম পেন্সিল্ভেনিয়ার বেলেফন্টে নামের একটা ছোট্ট শহরে। স্কুলের পুরনো বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে যেয়ে ওখানকার বাঙ্গালি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হয়েছিল। আর সেখানেই আবার দেখা ডাঃ পুনব্রত’র সাথে। দূর থেকে প্রথম দেখাতেই চিনতে পারলাম। হাসির তোড়ে বুজে আসা চোখ, তবুও গালের টোলটা নজরে পড়ে। অতিরিক্ত স্বাস্থ্য সচেতনতায় ওজন হারিয়েছেন, সাফল্য আর অভিজ্ঞতার মিশ্রিত ভাব চেহারায় পরিপূর্ণতা এনে দিলেও কৌতুকের অভ্যাসটা যায়নি। সাদা প্লাস্টিকের গ্লাসে ধরা বোরহানিতে চুমুক দিতে দিতে উনি হাস্যকর কিছু একটা বলছিলেন। তাই শুনে আশেপাশের লোকজন অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়ছিল। কাছে এগিয়ে গিয়ে মনে বিশ্বাস রেখে জিজ্ঞাসা করলাম,

“চিনতে পেরেছেন ?”

রসিকতার আসরে হঠাৎ ছেঁদ পড়ায় আমার দিকে ঘুরে তাকালেন। দুচোখে দারুন বিস্ময় নিয়ে উত্তর দিলেন,

“আসলে অনেক রোগী ঠেলেছি তো, মনে পড়ছে না।”

“তা ঠিক, মনে না থাকারই কথা! ওই যে ঈদের দিনে, পুরো হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে আপনি একাই ডিউটি দিচ্ছিলেন…..কোরবানীর ঈদ ছিল ঐদিন…..মনে পড়েছে এবার?”

ভ্রু কুঁচকে তর্জনীটা সামান্য উঁচু করে পুরনো স্মৃতি হাতড়ালেন বার কয়েক। তারপরই উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন,

“হ্যা—– এখন একটু একটু মনে পড়ছে। এপেন্ডিসাইটিসের শেষ মুহূর্তে আপনি এসেছিলেন, খুব সম্ভবত দুপুরে। সার্জারি টেবিলে লম্বা পা আটছিলো না বলে এনেস্থেশিয়ার ডাক্তার খুব হেসেছিলো………”

ফিরে গেলাম উনোনব্বই এর কোরবানী ঈদের দিনে, সময়টা ছিল বছরের মাঝামাঝি। বুকের নীচে পেটের মাঝ বরাবর প্রচন্ড ব্যাথা নিয়ে হাজির হলাম হলিফ্যামিলি হাসপাতালে। ব্যাথাটা কয়দিন ধরেই ভোগাচ্ছিল আমাকে, সবাই বলেছিল লম্বা সময় না খেয়ে থাকার ফল। কিন্তু ব্যাথা বেড়েই চলেছিল, একপর্যায়ে জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা হলে আব্বা ঈদের তোয়াক্কা না করে হাসপাতালে নিলেন। জুলাই মাসের ভ্যাপসা গরম দুপুর ভেসে যাচ্ছে ঝুম বৃষ্টিতে। সেই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই হাসপাতালের গেটে পৌঁছে দেখি শুনশান নীরবতা চারিদিকে। ঈদের দিন থাকায় সারা হাসপাতালে কোন ডাক্তার-নার্স নেই। জরুরী অবস্থার কিছু রোগী বাদে বাকিরা কাগজে সই দিয়ে বাড়ি গেছে। শুধুমাত্র একজন ডাক্তারই আছেন হাসপাতালের দায়িত্বে, সাথে দুজন নার্স।

সন্ধ্যের মুখে আমাকে সার্জারি রুমে নেয়া হল। সামান্য একটা সুইয়ের খোঁচাকে যমের মতো ভয় পাওয়া এই আমি চুপচাপ শুয়ে আছি অপারেশনের টেবিলে। যেন পরাজিত এক সৈনিক, প্রতিবাদের ভাষা হারিয়েছি তুমুল ব্যাথার কাছে। ভীষণ শীতল একটা ঘর, টুংটাং ধাতব যন্ত্রের আওয়াজ পাচ্ছি অদুরে। মাইনাস পাওয়ারের চশমাটা খুলে নেয়া হয়েছিল বলে তেমন কিছু স্পষ্ট দেখতে পারছিলাম না। কিন্তু শুনতে পারছিলাম কেও একজন ভীষণ শান্ত মেজাজে গলায় সুর তুলছিলেন। ভারী গলার সুর, বিশাল উচু ছাদের ঘরে সেই সুর আটকে পড়ে প্রতিফলিত হয়ে ক্রমশ মুল ধ্বনির সাথে মিশে যাচ্ছিল। উনিই সেই পুরো হাসপাতাল একলা পাহারা দেয়া ডাক্তার! ডাঃ পুনব্রত রায়। গোলগাল মাংসল মুখটা নিয়ে কাছে এসে দাড়ালেন বলেই হালকা হাসিটা চোখে পড়েছিল। ভারী গলায় বললেন,

“আপনাকে এখন অজ্ঞান করা হবে, রেডি আছেন তো ?”

এর আগে কখনো এতো বড় শারীরিক সংকট নিয়ে হাসপাতালের দ্বারস্থ হইনি, সার্জারি-অজ্ঞান তো দুরের কথা। আম্মা মাথায় হাত রেখে বললেন, “এগুলো খুব মামুলি ব্যাপার, তুমি কিছুই টের পাবেনা।” কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল ওই ধাতব ছুরির ঠান্ডা স্পর্শ আমাকে কেটে কুটে একশো টুকরো করে দেবে। নাহ! নিজেকে জ্ঞান হারালে চলবে না, জেগে থাকতে হবে যতক্ষণ পারা যায়। সোজা হয়ে ছাদের দিকে তাকালাম, অনেক উঁচু ছাদ, যশোরে দাদাবাড়ীর কড়ি বর্গা দেয়া ছাদটার মত। তাতে সার দিয়ে ঝোলানো উজ্জ্বল অনেকগুলো বাতি। সাধারণত সার্জারি রুমে কোন জানালা থাকেনা, বাইরের আলো-বাতাস আর শব্দের অনুমতি নেই ওঘরে ঢোকার। নাহলে হয়তো দেখতাম সেই সন্ধ্যায় বৃষ্টি নামছে হাসপাতাল চত্বরের কাঠ গোলাপের পাতা চুইয়ে। ঝুম বৃষ্টি না দেখার হাহাকার কিছুক্ষনের মধ্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। মাথার উপরের বাতিগুলো থেকে বিচ্ছুরিত আলোও মোহনার মতো মিশে গেল একে অন্যের সাথে। আমার আর টনটনে জ্ঞান নিয়ে জেগে থাকা হলোনা, শেষমেশ আমি অজ্ঞান হলাম।

মেঝের একটু ওপর থেকে ছাদ অবধি বড় জানালার পাশে লোহার বেডে শুয়ে থাকতে হল পরের তিনদিন। পাশে প্রহরীর মতো দাঁড়ানো স্যালাইনের ব্যাগ, যেখানেই যাই আপদের মতো আমার সাথে হাটতে থাকে। সার্জারির চারদিন পর সেলাই কাটার মুহূর্তে ডাঃ পুনব্রতর সাথে আবার দেখা হল। আমাকে বললেন,

“গতবছর কলেজ থেকে পাশ করেছেন, এরপর কি পড়বেন ঠিক হয়েছে কিছু?”

“ঢাকা ভার্সিটিতে এডমিশন পেয়েছি, এখনও ভাইবা বাকি। ইচ্ছা আছে ফিজিক্স পড়বো, যদিও ভীষন খটমটে রসহীন সাবজেক্ট।“

“ফিজিক্স পড়বেন? সাথে ম্যাথস থাকবে নিশ্চয়? ওখানে প্রফেসর সেলিনা কে আমার কথা বলবেন, ও আমার বান্ধবী। আমরা একসাথে কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়েছিলাম।”

যৌবন শুরুর সেই প্রথম সিঁড়িতে ডাঃ পুনব্রত’র প্রতি হৃদকম্পনের বেতাল অনুভুতি যে ছিলোনা তা অস্বীকার করা হয়তো লঘু পাপ হবে। জীবন-মৃত্যুর মাঝে দাঁড়ানো আমাকে ঐ মুহূর্তে হ্যাঁচকা টানে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন পৃথিবীতে। সেই জন্যেই কি না জানিনা, তবে উনাকে সাক্ষাৎ দেবদূত মনে হয়েছিল। কোমলমতি বয়সের কারসাজি ও হতে পারে, ঐ বয়সে অল্প দোলাতেই হৃদয় দুলবে এটাই স্বাভাবিক। তবে আজ কিন্তু হৃদয় আর দোলেনি। অনেক রাতে যে মুখ দেখে ঘুম ভেঙ্গেছিল আজ তিন যুগ পরে সেই মানুষের সামনে দাড়িয়ে বুঝলাম চারিদিকে মাতাল হাওয়া বন্ধ হয়েছে। আর আমিও এই ফাঁকে গলির মোড়ের গাব গাছটার মত বুড়ো হয়েছি। তবুও কিছু সময় আটকে থাকে, হাসপাতালের বাগানে ক্রটন গাছে কিছু রোদ এখনও পিছলিয়ে পড়ে। মানুষের স্মৃতিগুলো এক অদ্ভুত জিনিশ, মগজের ভাঁজে সুরক্ষিত থাকে নাকি মন নামক অদৃশ্য আলমারিতে সাজানো থাকে? আর সেই স্মৃতির ধারক এবং বাহকেরা গুরু দায়িত্ব পালন করে আমৃত্যু, নাকি স্মৃতিগুলোই তাদেরকে কামড়ে ধরে থাকে জোঁকের মতো? কোনটা? নিউ ইয়র্ক মে ২০২৩

এসএ/এমএএস/এমউএ/টিএ/পরিচয়

শেয়ার করুন