নিউইয়র্ক     শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সৈয়দ কামরুল

পো কটেজে নির্জন বিকেল

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২৩ | ০৩:৪১ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩ | ০৩:৪১ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
পো কটেজে নির্জন বিকেল

বঝটপট তৈরি হয়ে নিন, চলুন যাই ব্রঙ্কসে, এডগার অ্যালান পো পার্কে। উইকেন্ড বিকেলে ফোন করে এভাবেই ডাক দিল কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। অফুরান প্রাণশক্তি জহিরের, নতুন কিছু না করে থাকতে পারে না একটা দিনও। আমি জহিরের উল্টো, আলস্যপ্রিয়। জহির আসছে আমাকে নিতে। পিক করবে কুইন্স বরোর বাসা থেকে। আমরা দুজন পনের মিনিটের ড্রাইভিং ডিসট্যান্সে থাকি। তিন সপ্তা কোয়ারেন্টিনে থাকার পর খাঁচাদিন খুলে আজ বাইরে যাবো। নিউ ইয়র্কে এডগার অ্যালান পো’র শেষ বাসাবাড়ির উঠোনে কাটাবো একটি বিকেল — ঘুরবো অ্যালান পো মেমোরি পার্ক ও পো কটেজে একটি বিকেল।

এডগার অ্যালান পো — কেউ তাকে দ্যাখেন আধুনিক হরর গল্পের স্রষ্টা হিসাবে। কেউ দ্যাখেন কল্পবিজ্ঞান এবং গোয়েন্দা গল্পের ক্রিয়েটর হিসাবে। তবে, আমি তাকে দেখি আবেগস্পর্শী কবি হিসাবে। পো’র কবিতা আমি পড়ি মুগ্ধমন।

সেই কবে কলেজে পড়েছিলাম এডগার অ্যালান পো। আজ চোখের সামনে, ধুলো সরিয়ে দেখবো তার বাসাবাড়ি পো কটেজ। ভাবতেই দুএক রীল স্মৃতিছবি ফ্ল্যাশব্যাক করে গেল। রীল শব্দটি বলতেই মনে হলো আমি চালকহীন রোবো-কার যুগের হয়েও ওল্ড স্কলাস্টিক লোক। আমাদের সময় সিনেমাটা কতো ভালো তা নির্ভর করতো সেটা ষোল রীল না আরো দীর্ঘতর — তার উপর। এখন ম্যুভি চলে ডিসিপি (ডিজিটাল সিনেমা প্যাকেজ) ফাইলে।

আমরা সাহিত্যেও পুরানো দিনের ভিতর ঘুরপাক খাই।আমরা থাকি আধুনিক যুগে কিন্তু কবিতা লিখি রোমান্টিক এরা’র লিরিক লিরিক বয়ানে ও বুননে। কথা সাহিত্যেও তাই — প্রবৃত্তির মনোসমীক্ষণমূলক ব্যবচ্ছেদ না করে লিখি পেরিফেরাল বর্নণা। পো ছিলেন রোমান্টিক লিরিক্যাল কবি। না, শুধু রোমান্টিক কবি বল্লে সঠিক বলা হবে না। তাঁকে বলা হয় ‘ডার্ক রোমান্টিক’ কবি। তিনি ডার্ক-রোমানেটিসিজম সাবজানরা গড়ে তুলেছিলেন।

যে কোনো ভ্রমণে আমরা যাই বিদ্যমান ভূগোলের অচেনা ভুবনকে দেখার জন্যে। তার দৃশ্যের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে জেনে নিই অজানারে। একজন মনুমেন্টাল কবি ও লেখকের মিউজিয়ম বা যাপিত ঠিকানার কাছে চলেছি অর্থাৎ চেনাজানা সেই প্রিয় লেখকের মনন, কীর্তি ও মীথের কাছে। রোমন্থন করছি তার কাব্য ভাবনা, রিকন্সট্রাক্ট করছি তার oeuvre ওভরা। এই যাত্রা দুটো দু’রকম — আননোন টু নোন বনাম নোন টু আননোন। দুই জায়গায় দরকার মগ্নমন অভিনিবেশ।

আজ বিকেলের আকাশে ছিল হালকা ওভারকাস্ট আকাশ। চৌকস জহির ড্রাইভ করছে ওর লাল অ্যাকুরা সিডান। আমরা চলতে শুরু করেছি। হিলসাইড এভেন্যু থেকে নেমেছি ভ্যান ওয়াইক এক্সপ্রেসওয়ে নর্থে। হোয়াইট স্টোন ব্রীজ পার হয়ে নিয়েছি ইউএস আই নাইন্টি-ফাইভ নর্থ। সেখান থেকে জেরোম এভেন্যু। আসা হতো না। অথচ পো আমার প্রিয় কবিদের একজন।

আধঘন্টার ড্রাইভে আমরা পৌছে যাই ২৬৪০ গ্র্যান্ড কনকর্স, ব্রংক্সে। ওখানেই ‘পো কটেজ’। গ্র্যান্ড কনকর্স সড়কের পাশে এক টুকরো মৌন সাদা বাড়ি। আধ ঘন্টার এই ড্রাইভিং ডিসট্যান্স পার হয়ে আসতে আমার সময় লেগেছে বত্রিশ বছর। তাও জহির টেনে না আনলে হয়তো আসা হতো না।

এই ভাড়া বাড়িটা ছিল এডগার অ্যালান পো’র নিউ ইয়র্কে শেষ ঠিকানা। বাসাটি পো ভাড়া নিয়েছিলেন বছরে একশ ডলারে ল্যান্ডলর্ড ভ্যালেন্টাইন ফ্যামিলির কাছ থেকে। পো কটেজ এর পাশে ভ্যালেন্টাইন এভেন্যু নামে একটা রাস্তা আছে। ওটা রাখা হয়েছে ভ্যালেন্টাইন ফ্যামিলির নামে। পো এখানে উঠেছিল ১৮৪৬ সালে স্ত্রী ভার্জিনিয়াকে নিয়ে। তখন ব্রঙ্কস হয়ে ওঠেনি ব্রঙ্কস। তখন এই জায়গাটির নাম ছিল ফোর্ডহাম ভিলেজ। এটুকুই পো কটেজ এর টপোনম্যাস্টিক্স (toponomastics)। এই পোর্টম্যানট্যু শব্দটি আমি কয়েন করলাম। অনাম্যাস্টিকস এর ম্যাস্টিক্স আর টপোনিম এর টপনো নিয়ে।

এই বাসাবাড়িতে বসে পো লিখেছিলেন তার শ্রেষ্ঠ কিছু লেখা। এখানেই স্ত্রী ভার্জিনিয়ার জন্য লিখেছিলেন ‘অ্যানাবিল লী’ কবিতাটি। ওটাই ছিল পো’র জীবনের শেষ কবিতা। মৃত্যুর দু’দিন পর কবিতাটি বেরিয়েছিল নিউ ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউনে। কবিতাটি পড়তে গেলে বোঝা যায় তার ভিতরে ধ্বনিত, স্বনিত শ্রবণ সুন্দর এক সঙ্গীত। তার গীতলতা টানে আর বেজে যায় হিপনোটিক এফেক্ট। সমালোচকেরা বলতো, পো’র শব্দেরা চেনায় পো’কে। পো বলতেন, শব্দের কোনো ক্ষমতা থাকে না যদি শব্দগুলো তুলে এনে দেখাতে না পারে বাস্তবের বিস্ময়কর ভয়াবহতা। এখান থেকেই পো হয়ে উঠেছিলেন Prohoror (প্রোহরর) লেখক। মার্কিন সাহিত্যে তুলে দিয়েছিলেন ডিটেক্টিভ ফিকশান জানরা। আমরা অনেকেই দ্য র‍্যাভেন কপিতাটি কলেজে বা পাঠতৃষ্ণায় জীবনের কোনো না কোনো সময় পড়েছি। এই কবিতাটি পো’র হারিয়ে যাওয়া অনেক প্রেমের মধ্যে একজন ফারাহ এলমিরা রয়স্টারকে নিয়ে লেখা।


আমরা এসে দাঁড়ালাম পো কটেজের বন্ধ গেটের সামনে। শুক্রবার পো কটেজ খোলা থাকে না দর্শনার্থীদের জন্য। প্রথম দেখায় বাড়িটিকে কিছুটা পরিত্যক্ত মনে হবে। উঠোনে নেই কোন ল্যান্ডস্কেপ পাতাবাহার, নেই বর্ডারলাইন লতাগুল্ম। আছে শুধু আবছা ধুলোর মেঘ, রাত্রির আকাশে যেমন চাঁদের চারদিকে জমে থাকে চাঁদের ধুলো। ভিতরে লাল বাইরে নীল চাঁদের ধুলোকে বলে ‘লুনার হেলো’। একটা অপটিকাল ইলিউশান যার ভেতর দোলে টলোমলো বৃষ্টির মাদল।

পো কটেজ তেমন ছোট না যেমনটা ছিল ‘লস্ট জেনারেশান’ এর গনগনে মার্কিন লেখক, নোবেল লরিয়েট হেমিংওয়ের প্যারীর ভাড়াবাড়ি। বলা হয় সেটা ছিল একটা বালতির চাইতে একটু বড় একটা ঘর। সেখানে কোনো মতে হাডলির (হেমিংওয়ের প্রথম স্ত্রী) সঙ্গে রোমান্স চললেও লেখালেখি করার মতো স্পেস ছিল না। হেমিংওয়ে তাই ৩৯ রু ডেসকার্টে একটা স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করেছিল মাসে ৬০ ফ্রাঙ্কস। হেমিংওয়ের আগে ওখানে ভাড়া থাকতেন ফরাসি সিম্বলিস্ট পল ভার্লেইন।

মানিক বন্দোপাধ্যায় লেখাকে পেশা করার জন্য কোলকাতা বরাহনগরের গোপাললাল ঠাকুর রোডের দীনহীন একতলার ছোট্ট বাসাবাডিতে উঠেছিলেন। বড় লেখক বা ভালো লেখক হতে হলে জীবনকে নানা ঢংয়ে দেখতে হয়। অবর্ণনীয় কস্ট পোহাতে হয়, সংসার ভেঙেচুরে তছনছ করে ফেলতে হয়। হঠাৎ একদিন মনে হলো অমনি লিখতে বসে গেলাম — বই বার করলাম— তাতে কাজের কাজ কিছু হয় না। এক ধরণের সাহিত্যের চড়ুইভাতি করা হয়।

পো শুধু মার্কিন সাহিত্যের যুগান্তকারী কবি ও লেখক না; পো’র কাব্য-ভাবনা ফরাসি সিম্বলিস্টদের ও রোমান্টিক যুগের কবি শার্ল বোদলেয়র, স্টিফেন মালার্মে, পল ভার্সেইন, পল ভ্যালেরি ও অন্যান্য সিম্বলিস্টদেরকে প্রভাবিত করেছিল। ফরাসি সাহিত্যে তার ভূমিকা ছিল একজন কাব্যিক মাস্টার মডেল এবং সমালোচনার গাইড।

দস্তয়েভস্কি প্রভাবিত হয়েছিলেন তার ক্রিটিক্যাল লেখা বিশেষ করে ফিলসফিক্যাল প্রিন্সিপালস এবং শৈল্পিক শৈলীর মধ্যেকার সম্পর্কের লেখা থেকে। কাফকা ও পো’র জীবন ছিল আলাদা কিন্তু কাফকা প্রভাবিত হয়েছিল পো’র লেখার মাধ্যমে। তাদের দুজনের জীবনভঙ্গী ছিল নেতিবাচক।

কবি কাজি জহিরুল ইসলাম আমার কাছে জানতে চায়, জীবনানন্দ কী পো’র টু হেলেন কবিতার আদলে লিখেছিলেন বনলতা সেন। হতে পারে। বনলতা সেন কবিতায় কিটসের অন ফার্স্ট লুকিং ইনটু চ্যাপম্যান’স হোমার সনেট এর প্রভাবও আছে। শুধু বনলতা সেন কেন, সমারূঢ়, হায় চিল এ রকম আরো কবিতা আছে ইংলিশ, আইরিশ কবিদের কবিতার প্রভাবে লেখা। কিন্তু যে কৌশলে জীবনানন্দ দাশ ডাইলিউট করেছিলেন তা অনন্য ও স্থানীয়করণ করা বা স্থানীয় বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত। তাকে কি প্লেইজারিজম বলা যাবো না যৌক্তিক হবে!

সাহিত্য ভাবনা ও আঙ্গিক প্রকরণে প্রভাব বিস্তারের ইতিহাসে কাফকা, কার্পেন্তিয়র, ফকনার প্রভাবিত করেছিল মার্কেজকে। নর্থ্রপ ফ্রেয়ি ওর অ্যানাটমি অব ক্রিটিসিজম কিতাবে তাই বলেন, হিস্ট্রি অব আর্টস অ্যান্ড লিটারেচার ইজ হিস্ট্রি অব মিউটেশান। জহির চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আরেকটি প্রসঙ্গে কথা তোলে। সেটা আমার দ্বৈত সত্তা নিয়ে। — সৈয়দ কামরুল, আপনি সব সময় বিনম্র কিন্তু লেখার সময় রূঢ় ও ক্ষুব্ধ কেনো? জহির জানতে চায়।

শুধু কি আমি একা এরকম দ্বৈত ব্যক্তিত্বের? না, মোটেই না। এই মুহুর্তে আমি ডজন খানেক এ রকম দ্বৈত ব্যক্তিত্ব লেখকের নাম বলতে পারি। কিন্তু তা না বলে একজনের কথা বলি, তিনি এডগার অ্যালান পো। সমালোচনায় পো এতোটা রূঢ়, নির্মোহ, নৈর্ব্যক্তিক ও নিষ্ঠুর ছিলেন যে সবাই তাকে খেতাব দিয়েছিল, “the tomahawk man” (দ্য টমাহক ম্যান) বা “the man with the tomahawk” (দ্য ম্যান উইথ দ্য টমাহক)— ভাবুন তো! এখন আমার নিন্দুকেরা মানলেন তো!

পো সারা জীবন জোর দিয়েছিলেন ভাষা, ছন্দ আর কাঠামোর সঠিকতার ওপর। গুরুত্ব দিয়েছিলেন মুড বা মেজাজের সমন্বয় বা সংহতি অর্জনের জন্য। “থিওরি অব পিওর পোয়েট্রি”র উৎকর্ষ সাধনে পো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন।

উনিশ শতকের মার্কিন সমাজে, অর্থনীতির যাতাকলে পো আত্মধ্বংসী সিদ্ধান্ত নিয়ে লেখাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। তার আশি পঁচাশি বছর পর পশ্চিম বাংলায় এক অমিততেজ লেখক ‘কল্লোলের কুলবধন’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লেখাকে পেশা হিসেবে আঁকড়ে ধরেছিলেন। আত্ম-ধ্বংসের দুঃসাহস! দুজনই খুব অর্থকস্ট পেয়েছিলেন। কষ্টযাপনের মধ্য দিয়ে সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিলেন।

ভাবছিলাম, নিউইয়র্ক কী তার বীরোচিত কবি ও লেখকদের ‘ফেয়ার শেয়ার’ দিয়েছে? কেনো পো-কটেজ পড়ে আছে অমোন দীনহীন! অথচ ক্যারিবীয় দ্বীপদেশে পোর্ট আ প্রিন্সে একজন হাফ মন্ত্রী নিজের পকেট থেকে সাতান্ন হাজার পাউন্ড খরচ করে একটি মিউজিয়ম করেছিলেন ত্রিনিদাদের নোবেল লরিয়েট লেখক ভিএস নাইপল, জামাইকার নোবেল লরিয়েট কবি ডেরেক ওয়ালকোট এবং সেন্ট লুসা’র নোবেল লরিয়েট ইকোনমিস্ট স্যার আর্থার লুইস এর সম্মানে। আকারে ছোট কিন্তু ভালোবাসায় কতো বড়।

পরক্ষণেই আমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই।তাইতো, পুরাতত্ত্বের প্রামাণ্য সততা ধরে রাখতে হলে সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত রাখতে হয় এ রকম নিদর্শন। প্রয়োজন হলে তার একটি রেপলিকা করা যেতে পারে মূল স্থাপত্যকে সংরক্ষণ করে। কিন্তু পো কটেজের বর্ডারলাইনে কিছু পাতাবাহার, উঠোনে কিছু লতাগুল্ম লাগিয়ে দিলে তো আর্কিওজিক্যাল ক্রাইম হতো না। তবে হৃদয় জুড়ে আপ্লুত হওয়ার মতো সেখানে একটা বিষয় আছে। কটেজের সামনে বাংলায় লেখা একটা সাইনবোর্ড আছে দর্শনার্থীদের জন্য। ভাবা যায়!

কলেজ জীবনে রোমান্টিক যুগের যে সব কবি আমাদের সবুজ অন্তরে প্রেমের কবিতা চারিয়ে দিয়েছিল এডগার অ্যালান পো তাদের অনপনেয় একজন। পো’র কবিতার মধ্যে টু হেলেন, দ্য র‍্যাভেন, অ্যানাবেল লী পড়েনি এমন পাঠক খুব কম আছে। কবিতাগুলোর অন্তর্গত সঙ্গীত এতোটা প্রবল, পাঠককে পরাস্ত করে স্মৃতিবন্দী হতে বাধ্য।

পো’র কোলাহলময় প্রেম জীবনের পঙক্তিমালায় লেখা আছে অপূর্ণতার দীর্ঘশ্বাস। প্রেমিকাকে পাওয়ার ঈপ্সা আর না-পাওয়ার কস্ট পো’কে ব্যথিত করেছিল। সেই বেদনার বোধ পো’র কবিতার গভীরে নিহিত। পো আমৃত্যু ছুটেছিল নারীর দিকে নারীর প্রেম পেতে। কখনো সখনো তাদের কারো কারো কাছে কিছু টাকার জন্যও গিয়েছিলেন। বিনিময়ে পো অবশ্য তাদের নিয়ে কবিতা লিখে দিয়েছিলেন। কি সুন্দর বার্টার! সেই ‘বার্টার-সিস্টেম’ এখন অচল। কবিতার বিনিময়ে টাকা? ফগ্গেট্যাবাউটিট!

নারী এসেছিল পো’র জীবনে কখনো প্লাটোনিক, কখনো অসম। যে নারীপ্রেম তার আরাধ্য ছিল মেলেনি তা কখনো। পো’র কবিতার রিকারেন্ট থীম, দ্য ডেথ অব এ ইয়াং, বিউটিফুল, অ্যান্ড ডিয়ারলি বলভেড ওম্যান (the death of a young, beautiful, and dearly beloved woman) তিনি আরো হৃৎস্পর্শী লিখেছিলেন, দ্য ডেথ অব এ বিউটিফুল ওম্যান ক্রিয়েটস আ ডেফিসিট অব বিউটি। (the death of a beautiful woman creates a deficit of beauty) — বোঝা যায় নারীর সৌন্দর্য পো’কে কি বিপুল, কি প্রগাঢ় টেনেছিল।

পো বিয়ে করেছিলেন ফার্স্ট কাজিন ভার্জিনিয়াকে। ভার্জিনিয়া তখন মাত্র তেরো বছরের কিশোরী। এখন অবশ্য বয়সটা কোনো অলঙ্ঘনীয় দেয়াল নয়। দু হাজার বাইশে সাহিত্যে নোবেল পাওয়া ফ্রেঞ্চ লেখিকা অ্যানি ইর্নো প্রেমে পড়েছিলেন তার চাইতে ত্রিশ বছরের ছোট পুরুষের সঙ্গে। একটি তীব্র অর্গাজম এর জন্য অ্যানি মজেছিলেন সেই অসবর্ণ প্রেমে।

একদিন পিয়ানোর ডুয়েট বেঞ্চিতে আঙুলে নিটোল মুদ্রা তুলে ভার্জিনিয়া গাইছিলেন গান। অমনি বুকের ভিতর থেকে উঠে আসা ভাঙা সুরের সঙ্গে ছলকে পড়ে তাজা রক্ত পিয়ানোর সাদাকালো রীডে। তার পাঁচ বছর পর ১৮৪৭ সালে ভার্জিনিয়া চব্বিশ বছর বয়সে মারা যায়।

এডগার তার স্ত্রীর মৃত্যুতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ১৮৪৮ সালে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন রোড আইল্যান্ডের প্রভিডেন্স শহরে কবি সারা হেলেন হুইটম্যান এর কাছে। হেলেনের সঙ্গে পো’র বিয়ে হতে পারতো। সবাই তাকে ‘পো’র হেলেন’ বলে ডাকতো। সেই এষণা, অন্বেষায় ছুটেছিলেন পো। কিন্তু বিয়েটা হলো.না। পরের বছর ১৮৪৯ সালে মারা যান এডগার এলান পো।

তিন বছর বয়সে পো’র মা মারা যান। বাবা তাকে পরিত্যক্ত করে যায়। এমন জীবন তো জীবনের বেনোজলে ভেসে যাওয়ারই কথা। কিন্তু বিস্ময়করভাবে পো’র প্রতিভার পরিধি ও বহুমুখিতা বিশ্ব সাহিত্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। আমার মতো হাজার হাজার পাঠককে সাহিত্যমনস্ক করেছে যেমনভাবে করেছিলেন বিশ্ব সাহিত্যের মনুমেন্টাল লেখকদেরকে।

 

 

পো’র জীবন ছিল ছোট কিন্তু দীর্ঘ ছিল তার অসুখী জীবন। মাত্র চল্লিশ বছরের জীবন ছিল তার। ১৮৪৯ এর একটি বিষন্ন সকালে, রোদ ওঠার আগে ম্যারিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের বাল্টিমোর শহরের রাস্তায় নিথর, নিস্পন্দ পড়েছিলেন পো। পরে, অক্টোবর ৭, ১৮৪৯ এর রোববারে ওয়াশিংটন কলেজ হসপিটালে গহন অচেতন কোমার মধ্যে হারিয়ে যান পো। এডগার অ্যালান পো’র মৃত্যু অভেদ্য রহস্যের অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যায় চিরতরে। রহস্য ফিকশান জানরার মাস্টার পো’র মৃত্যু একটি অনুদঘাটিত রহস্য হয়ে রয়ে গেল। তার অমীমাংসিত মৃত্যু রহস্য নিয়ে একটি কথা বলা হয়, “a fittingly mysterious end for the master of mystery.”(এ ফিটিংলি মিস্টিরিয়াস এনড ফর দ্য মাস্টার অব মিস্ট্রি)। নিউ ইয়র্ক এপ্রিল ২০২৩

সাথী / পরিচয়

শেয়ার করুন