নিউইয়র্ক     বৃহস্পতিবার, ২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

ড. গুলশান আরা

নজরুলের সাম্যবাদ

বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ মে ২০২৩ | ১২:২৩ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ২৭ মে ২০২৩ | ১২:২৩ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
নজরুলের সাম্যবাদ

বাঙালি সাহিত্যিকদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম কবি যিনি সাম্যবাদী চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে সাহিত্য রচনা করেন। মানবতার মহত্ আদর্শে উদ্বুদ্ধ কবি নজরুলের কাব্য-সাধনার এক প্রধান অংশজুড়ে আছে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি কামনা। নজরুল মানসে হিন্দু-মুসলমান বৈপরীত্যের দ্যোতনা না হয়ে পরিপূরক হয়েছে তাঁর অসামান্য সাম্যবাদী চেতনার ফলে। হিন্দু-মুসলমানই শুধু নয়—মহামানবের মিলনকামী কবি উদাত্ত কণ্ঠে গেয়েছেন—

যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান

যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রিশ্চান।’

প্রথম মহাযুদ্ধ উত্তর পাকভারত উপমহাদেশে সাম্যবাদী চিন্তা, খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক মঞ্চে হিন্দু-মুসলমানের সাময়িক সম্প্রীতি। এই দুই আন্দোলনই নজরুলের উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। এসব প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে তিনি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কবি, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তাঁর লেখনী চালনা করেন। সমকালীন হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির পরিবেশে এই সাম্যবাদী চিন্তা একটা ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদের কল্পনায় কবি-প্রাণকে উজ্জীবিত করে। এই দুই প্রধান সম্প্রদায়ের মিলন কামনায় তিনি এতটাই আন্তরিক ছিলেন যে, তাঁর লেখা এই সম্পর্কের চিত্রণ তাঁর পূর্ববর্তী সকল কবির রচনা প্রণালী থেকে ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নমুখী। মৌলিক প্রতিভার দিক থেকে নজরুলের আগে বাঙালি লেখকগণ কেউই অতটা অগ্রসর ছিলেন না। এই নতুন যুগের প্রবর্তনায়—নতুন সাহিত্য রচনার পারদর্শিতা নজরুলের রচনাতেই প্রথম প্রকাশ পায়।

দুঃখের বিষয় এই যে, খেলাফত আন্দোলন এবং অসহযোগ আন্দোলন কেন্দ্রিক হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অল্পকালের মধ্যেই এ সম্প্রীতিতে ভাঙন ধরে এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়। এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নজরুল ইসলাম অত্যন্ত মর্মাহত হন। দাঙ্গা উপলক্ষ্যে সাপ্তাহিক ‘গণবাণী’তে ‘মন্দির ও মসজিদ’ এবং ‘হিন্দু-মুসলমান’ নামে দুটি প্রবন্ধ লেখেন। দাঙ্গা বিক্ষুব্ধ পরিবেশেই ১৯২৬ সালের কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে লেখেন ‘কান্ডারি হুঁশিয়ার’—এখানে কবি তরুণকে তার অমিত যৌবন শক্তি মহাবিদ্রোহীর মতো কাজে লাগাতে আহ্বান করেছেন—

অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ

কান্ডারি! আজ দেখিবো তোমার মাতৃমুক্তি পণ!

‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন?

কান্ডারি! বলো, ডুবিছে মানুষ—সন্তান মোর মা’র!

কাজী নজরুল ইসলাম দেশের তরুণসমাজকে সমস্ত দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে থেকে মানবতার উচ্চাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশসেবায়, মানব কল্যাণে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের মনে রাখতে বলেছেন—‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’

আজ বিশ্বব্যাপী দেশে দেশে যে বিচ্ছিন্নতা হানাহানি মতানৈক্যের দ্বন্দ্ব সে-সবের আবসানে চাই সাম্য। আর এই সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য অন্তত অন্যদিকে দৃষ্টি না ফিরিয়ে যদি মাত্র নজরুলের সাম্যবাদী চেতনাকেই আমরা গ্রহণ করি তাহলেও মুক্ত হওয়া যাবে মতবিরোধের অনাকাঙ্ক্ষিত বেড়াজাল থেকে। যে বেড়াজাল অক্টোপাসের মতো আমাদের জাতীয় জীবনকে স্থবির করতে অষ্টবাহু সংকুচিত করে চেপে মারার উল্লাসে মত্ত। এসব অসুস্থ, অশুভ শক্তি থেকে মুক্তির জন্য জাতীয় কবির সাম্যবাদকে আমাদের নতুনভাবে নতুন মাত্রায় গ্রহণ করা প্রয়োজন।দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে

 

সুইটি/পরিচয়

শেয়ার করুন