নিউইয়র্ক     বৃহস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সৈয়দ কামরুল

জিপসি জার্নালঃ কবিতায়নের কোলাজ

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২৩ | ১২:৫৯ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২৩ | ০১:০৩ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
জিপসি জার্নালঃ কবিতায়নের কোলাজ

গাজী রকেট তার ব্রবডিংনাগিয়ান আকৃতির প্যাডেল হুইলে রাতভর নদীজল কেটে খুব ভোরে পৌছে গিয়েছিল চন্দ্রদ্বীপ বরিশালে। সন্ধ্যা থেকে রাত্তিরের কিছুটা সময় গাভিন গাভীর মতো হেলেদুলে চলছিল ব্রুক এর চাইতে বড় রূপসার চাইতে ছোট কিন্তু গহীন এক লম্বা নদীতে সুন্দরবনের পাশ ঘেসে, গরাণ বনের দুদিকে কার্লাইল অ্যান্ড ফ্রিঞ্চ কোম্পানীর তৈরি সার্চলাইটের আলো ফেলে, হরিণেরা যেভাবে ঘাড়টাকে এপাশ ওপাশ ঘুরিয়ে বনভূমি নিসর্গের সচল, অচল — দুধারে চলে।

একটা জায়গায় আলো গিয়ে পড়ে কচি ঘাসে মোড়া এক চিলতে চরের মতো বাড়তি নদীকুলে। সেখানে একপাল ছোটবড় চিত্রা হরিণ সান্ধ্যচারণে নেমেছিল বুঝি! ওরা জিরাফের মতো গলা তুলে তাকিয়েছিল গাজীর দোতলা বরাবর ক্যাপ্টেন ব্রীজের দিকে — যেমন করে বনভূমি, গাছের মাস্তুল তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে, কজমিক প্রেমের মৌন মোহন চোখ।

হরিণগুলো সার্চ লাইটের আলোর অভিঘাতে হতচকিত হয়ে দৌড়ে না পালিয়ে তাকিয়েছিল গাজীর দিকে সপ্রতিভ। হয়তো গাজীর অবয়ব ও আলো সম্পাত ওদের অনেকদিনের চেনা। এমনিতে যা কিছু চলিষ্ণু, হরিণেরা তাদেরকে ভাবে প্রিডেটর, ভাবে ব্যাধ ও নিষাদ। তাদের যে কাউকে দেখলেই ওরা দৌঁড়ে পালায়। কিন্তু গাজী রকেটের তীব্র আলোর মুখোমুখি ওরা পালিয়ে গেল না; বরং বিস্তৃত খোলা চোখ চেয়ে রইল অপলক।

হরিণগুলোর চোখে সার্চলাইটের আলো পড়তেই কেমন একটা অপার্থিব নীল আলোঝাঁক ছিটকে পড়ল বন-নদীর জলে। হরিণের চোখ থেকে ছিটকে পড়া নীল আলো বনভূমির মতোই রহস্যময় নেচে গেল বিশাল প্যাডেলের কোপে এফোড় ওফোড় সফেন জলের ঢেউয়ে। কৃষ্ণপক্ষ রাতে নদীজল ও সমুদ্রে জাহাজের সার্চ লাইট আর মরুভূমিতে জীপের হেড লাইট সুন্দরবনের মতোই অপার্থিব রহস্যরূপ তৈরি করে।

পনের ষোল বছর আগে তেমনি আলোর নীলাভ রূপ দেখেছিলাম মরুভূমির রহস্যময় পথে জর্ডান আর ইরাকের মরু সীমান্ত রুৎবা, আকাশাৎ এর ধুধু বিরাণ রাতে। মাঝেমধ্যে মধ্যরাতে মরুভূমিতে অ্যাডভেঞ্চার ড্রাইভে যেতাম। দেখা মিলত ভেড়া ও দুম্বা পালের। রাতের মরুভূমিতে গোল হয়ে থাকত ভেড়া ও দুম্বার পাল। তাদেরকে পাহারা দিত বেদুঈন রাখালের কয়েকটি প্রশিক্ষিত ওয়াচডগ।নেটিভ আর্বী কুকুর আর হায়েনার ক্রসব্রিড পয়দা সে সব দুর্ধর্ষ শংকর কুকুর।যেমন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে মাইক্রো-মনিটরিং করার জন্য হিংস্র সজাগ জেগে থাকে পরাশক্তির ওয়াচডগ ইহুদিদেশ।

গাড়ির গতি প্রায় জিরো মাইলে নামিয়ে এনে নিরাপদ দূরত্ব থেকে ভেড়া ও দুম্বার চোখে গাড়ির হেডলাইটের আলো ফেলতাম। ওদের অজস্র চোখের মনিতে গাড়ির হেডলাইট পড়তেই নীল আলোর স্রোত ছুটে আসতো। আকাশাৎ ও রুৎবার মরুভূমিতে দুম্বার চোখ থেকে ঠিকরে পড়া নীল আলো হরিণের চোখের নীলতার মতো ঐকবাহী।

মধ্যরাতের আকাশাৎ, রুৎবার রহস্যময় নীল জ্যোৎস্নায় স্নান করে ফিরে আসতাম ক্যারাভ্যানে। ফেরার পথে গাড়ির জানালার কাঁচটা ইঞ্চি খানেক নামিয়ে ফুল ভল্যুমে অডিও ক্যাসেট বাজাতাম লেবাননের ফাইরুজ, মিসরের উম কুলতুম, আব্দেল হালিম হাফেজ, ফরিদ আল আতরাস, ‘দ্য আলজেরিয়ান রোজ’ ওয়ার্দার গান। শেষরাতে মুরভূমিতে ছড়াতাম আর্বী গানের মেলোডি মূর্ছনা। মরুচারী কুকুরেরা সেই সুরের পিছনে হুঙ্কার তুলে ছুটে আসতো। সুরের বিরুদ্ধে অসুরের এই ঘেউ চিরকালের।দাঁতগুলো সব পড়ে গেলেও কুকুরের ঘেউ বন্ধ হয় না।

রুৎবা, আকাশাৎ ছেড়ে এসেছি আশির দশকে। তারপর তছনছ হয়ে গ্যাছে মরুদেশ। অপ্রতিরোধ্য আবেগ আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিল একটি কবিতা। তার ক’একটি লাইন :

“আকাশের পিছনে ওড়ে পোড়া কালো অফুরান আকাশ

একেকটা আকাশ যেনো দোজখের আগুন পৃষ্ঠা

যায় না পড়া – জ্বলে চোখ দৃষ্টিভূক কুয়াশার চশমা

মৃত পায়রার মতো রুৎবার উঠোনে ঝরে ঝাঁকঝাঁক নক্ষত্র পালক।

উটের গন্দমে ওঠেনা জিকির আল্লাহর।

বারুদ বালুর লু-বাতাস টানে মরুর জাহাজ

দমে দমে অঝোর ঝরে ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম

নতমুখ বিষজল বহে যায় দজলা ফোরাৎ

জলের অর্কেস্ট্রা বাজেনা আর জলের এস্রাজ।

মুনরুফ তাক করে এ্যক্রিলিক আকাশের রদেভুঁ—লুটোয় চাঁদের লাশ — অথৈ বারুদ আকাশ —

লাল কুয়াশায় ভেজা সকালের কাঁচ।

শেষ ক্যাকটাস হারায় সবুজ

কুঁজ খুলে বোকা উট মুখবুজে চেটে নেয় লাল ওয়েসিস।

নি:শব্দে করে খুন ভার্জিন মরুভূমি!

মরুজ জীবন কাঁন্দে !

যে জীবন ঘুমায় সিজদায় – জাগে যে আযানে, জায়নামাজে

কেন তারে করো জর্জর — বর্বর বোমারু বিমানে ও কামানে!”

 

গাজী রকেট সারারাত এক নদী থেকে আরেক নদী পার হলো। ‘রকেট’ কোনো আসমানী ব্যোমযান নয়; রকেট হচ্ছে যাত্রীবাহী স্টিম ইন্জিন, প্যাডেলহুইল মার্চেন্টস স্টিমার, জলযানের জেনেরিক নাম। খুলনা টু ঢাকা ভায়া বরিশাল রুটে তখন চারটে রকেট ছিল। অস্ট্রিচ, কিউই, ল্যাপচা ও গাজী। এদের মধ্যে গাজী ছিল সেরা রকেট। গাজীর aft থেকে bow পর্যন্ত সবই ছিল আমার চেনাজানা।রকেটগুলোর ফার্স্ট ক্লাস ক্যাবিন ছিল সামনে। প্রতি ক্যাবিনে ছিল দুটো করে বড় বেড, হাতমুখ ধোয়ার সুদৃশ্য সিঙ্ক, আরাম-আয়েশে বসে সিনিক বিউটি দেখার জন্য দরোজার সামনে থাকতো ইজি চেয়ার। দোতলার ডেকে মাঝখান বরাবর ছিল ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ ও ডিনারের জন্য ক্লাসিক স্যালুন। মেন্যুতে ওয়েস্টার্ন ও দেশি খাবার থাকতো। আমরা সেকেন্ড ক্লাসের যাত্রী ছিলাম। পার-হেড এক্সট্রা ফি দিয়ে ফার্স্ট ক্লাসের স্যালুনে ডিনার খেয়েছিলাম। কি সুন্দর পোর্সিলিন অয়্যারের বাসনকোসন।ডায়নিং টেবিলের ডেকর্সে আর্টস অ্যান্ড অ্যাসথেটিকস। বাবুর্চি ও খানসামাদের গায়, মাথায় বৃটিশ মনার্কী স্ট্যান্ডার্ডের বেশভূষা। ওদের চিকেন ও ডাল ভুনা ছিল ইয়ামি, ডেলিসিয়াস! পদবীতে ওদের বাবুর্চি না বলে ফুড কন্যিওসর বা রসনাপন্ডিত বলা উচিত। একবার গাজীর স্যালুনে যে খেয়েছে, ইয়ামি ইয়ামি সে ঘুরে ফিরে সেখানেই খেতে গিয়েছে, তা সে গাজীর নোঙরে বা ভাসমান দরিয়া যাত্রায় হোক।

দেশ ছেড়েছি প্রায় তিরিশ বছর। সম্প্রতি জেনেছি, জল থেকে সব কটি রকেটকে তুলে নিয়ে শিপ-ব্রেকিং ইয়ার্ডে অনেকত্রিত করা হয়েছে। কোথাও কোনো জলে বা ডাঙ্গায় গাজী আর নেই। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না তাকে। গাজী এখন স্মৃতির জলে এলিজি-জাহাজ।গাজী এখন স্মৃতির ভিতর স্তরীভূত গাজী। আমাদের ফেলে আসা জন্ম ও বেড়ে ওঠা শহরের, বাড়ি-ঘরের ল্যান্ডস্কেপ ও মানুষ পাল্টে গেছে। কোথাও মিলবে না ফেলে আসা সেই স্মৃতির শহর। আমি এক লুপ্ত নগরের স্টেটলেছ নাগরিক হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিলোকের বাসিন্দা। আমি বাঁচি যূথবদ্ধ সংস্কৃতির বিছানা বালিশে বাঁচি। জ্যাক্সন হাইটসে রোজ সন্ধ্যায় চেচাই দেশ নিয়ে মূর্খমুখ। বাঁচি,পরাবাস্তব বাঁচি।

বরিশাল জাহাজ ঘাটে সকালটা ছিল কুয়াশার ঘোমটা জড়ানো সকাল। কুয়াশার নীল স্কার্ফে ঢাকা টেমস নদীর মতো। গাজী রকেট বরিশাল জেটিতে নোঙর ফেলার আগেই জলচারী ফেরিঅলাদের ছৈ খোলা ডিঙি গুলা গাজীর রেলিঙ ঘেসে ভিড়বার জন্যে গলুইয়ের ডগায় ডগায় ঠেলাঠেলি করছিল। জলগলুইয়ের লড়াইটা ছিল অনেকটা মোরগের যুদ্ধের মতো। মনে হচ্ছিল এই বুঝি উল্টে যায়, ডুবে যায়। তেজী জল তুফানের বিরুদ্ধে বেড়ে ওঠা জীবন ওদের। জলে ওদের কিসের ডর! প্রতিকূলতার মুখোমুখি যারা বেড়ে ওঠে, সাহস ও কৌশল তাদের একটু বেশিই থাকে। পরিযায়ী পাখি, উন্মূল অভিবাসী আর উপকূলের মানুষেরা নিষ্ঠুর প্রকৃতির বিরুদ্ধে, ইমিগ্রেশন আইনের দেয়ালে মাথা ঠুকে ম্যান্যুভারিং করে বাঁচতে জানে বলেই ওদের কম্ব্যাটিং দক্ষতা বেশি।

হৈচৈ সোরগোলের মধ্যে একটা লোক কলা ও বনরুটি চাইল। কিশোর জলফেরিঅলা বরিশালের ডায়ালেক্টে বললো, আগে টাহা দ্যান হেইয়ার পর ক্যালা লয়েন। আরেখাপ এ্যাক মাসসায়িবে ক্যালা রুডি লইয়া ভাগজে — কি বিছরান বিছরাইলাম! কোরা কাগজের মতো কিশোরের বিশ্বাসে বয়স্ক লোক লেপে দিয়েছিল অবিশ্বাসের অনপনেয় কালিমা। মানুষ এভাবেই সিনিক ও স্কেপটিক হয়ে ওঠে, বিপন্ন বিস্ময়ে জীবন কাটায়। ছবিটা আমার সাদা মনজমিনে লেপ্টে যায়। আমি এই সব চিত্রাবলীর কোলাজ নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকি।ছবিগুলোর গা ঘেষে অচিন দেশের ভাষা, সিম্যানটিক্স কথা কয়ে যায়। গাজী থেকে নেমে আলতু মিয়ার এমএল ভোলা-৩ মোটর লঞ্চে চড়লাম। কীর্তনখোলার জলদঙ্গল কেটে আগুনমুখা নদী ছেড়ে পড়লাম গিয়ে রাগীনদী কালাবদরের ঢেউয়ে।

গাজী রকেটের তুলনায় লঞ্চটি ছিল লিলিপুশিয়ান। গাজী পার হয়ে এসেছিল ছোট আর মাঝারি সাইজের নদী, এই লঞ্চটি পাড়ি দিচ্ছিল আদিগন্ত জলধি কি যে বিশাল সব নদী। চিমনির গা ঘেসে একজন যাত্রী বোগলে চেপে ধরে এক ব্যান্ডের সাদা ট্রানজিস্টরে সবটুকু ভল্যুম দিয়ে শুনছিল নিঘাত সীমা, বশির আহমেদের গান। ফুল ভল্যুমে গান শোনে স্কিযোফ্রেনিক শ্রবণ। যাদের অডিটরি হ্যাল্যুসিনেশানে মাথায় ড্রাম পিটানোর মতো আওয়াজ তোলে তারা কানে জোরালো শব্দ ঢুকিয়ে ভিতরের শব্দদানবকে তাড়াতে চায়। যারা হাইড্রোফোবিক, নদী ভ্রমনে ভয় পায়, তারাও বাইরে আওয়াজ তুলে দরিয়ার গর্জনকে তাড়াতে চায়।লোকটার ট্রানজিস্টরে গানগুলো দক্ষিণ সমুদ্রের হাওয়ার ডানা বেয়ে উড়ে উড়ে আসছিল আর মিলিয়ে যাচ্ছিল হাওয়ার ডানায়। চিমনির ধোঁয়ার পিছনে সীগাল যেমন ঢেউয়ের মতো ডানা মেলে ডাইভ দেয়, ওঠানামা করে ওড়ে, তেমনি সেই গানগুলো, সুরগুলো হাওয়ার ডানায় ওঠানামা করে একবার আসছিল আবার চলে যাচ্ছিল। কালাবদরের পাগলা জলের তুঙ্গী তোড়ে আমরা সবাই এর ওর কাঁধে ধাক্কা খাচ্ছিলাম, ভেঙে পড়ছিলাম। সুন্দরবনের সুঠাম গাছের মাস্তুলের মতো আমাদের মা আল্লাহমুখি হাতে মোনাজাত ধরে বসেছিল — জানালার বাইরে তাকিয়েছিল আকাশমুখি। বাবা কেবলই জলনবী খোয়াজ খিজিরকে ডাকছিল ডরে।

আমার মা-বাবার আত্মজ, কালাবদরের রাগী ঢেউয়ের চাইতে অধিক রাগী ঢেউয়ের বিরুদ্ধে চলেছে রূপসা, শিবশা থেকে টাইগ্রিস, ইউফ্রেটিস, চায়না সাগর হয়ে আটলান্টিক, প্যাসিফিকের বৈরী স্রোতে। বৈরীতার বিরুদ্ধে তাকে নিরাপদ রাখতে মায়ের সেই মোনাজাত নেই, বাবা ডাকে না জলনবীকে। একা একা পাড়ি দিচ্ছে সে লাগাতার শত্রুসময়। নিউ ইয়র্ক এপ্রিল ২০২৩

বেলী / পরিচয়

শেয়ার করুন