নিউইয়র্ক     শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চীন-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈরথে দেশ ত্যাগের কাফেলায় চীনা প্রযুক্তি উদ্যোক্তারা

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৩ | ১০:৫৬ অপরাহ্ণ | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৩ | ১০:৫৬ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
চীন-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈরথে দেশ ত্যাগের কাফেলায় চীনা প্রযুক্তি উদ্যোক্তারা

উচ্চাভিলাষী চীনা প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসার বিস্তৃতি ঘটানো দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে। এর ফলে, অনেকেই নিজ দেশ ছেড়ে অন্য কোনো দেশকে নিজেদের স্থায়ী ঠিকানা বানানোর আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ২০১৯ সালের আগে চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা করা চীনা কোম্পানিগুলোর বেলায় অল্পসংখ্যক ‘বড় প্রতিবন্ধকতা’ থাকলেও দেশ দুটোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা, বিশেষ করে টেলিকম জায়ান্ট হুয়াওয়ের ওপর ওয়াশিংটনের দেওয়া নিষেধাজ্ঞার পর থেকে বেশ কয়েকটি চীনা কোম্পানি নিজেদের সদর দপ্তর চীন থেকে সরিয়ে অন্য কোনো দেশে স্থাপন করতে শুরু করে। এমন পদক্ষেপে কোম্পানিগুলোর ওপর মার্কিন সরকারের শ্যেন দৃষ্টি তুলনামূলক কম আকৃষ্ট করবে বলে তাদের ধারণার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে রয়টার্স।

চীনের কিছু সংখ্যক প্রযুক্তি ব্যবসার মালিক বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চীনা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে আরোপিত প্রতিবন্ধকতা ও পক্ষপাত এড়ানোর লক্ষ্যে তারা আরও একধাপ এগিয়ে বিদেশে স্থায়ী বসবাস বা নাগরিকত্ব পেতে চান। চীনের প্রতিশোধের ভয়ে নিজের পরিবারের নাম দিতে অস্বীকৃতি জানানো শেনজেন শহরের উদ্যোক্তা রায়ান বলেন, তার তিন বছর বয়সী সফটওয়্যার স্টার্টআপ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রে বিস্তৃতি ঘটার বিষয়টি স্বাভাবিক হিসেবেই বিবেচিত। এরইমধ্যে পূর্ব এশিয়ায় ১০ লাখ ব্যবহারকারী থাকার পাশাপাশি উত্তর আমেরিকায় ব্যবসার শক্তিশালী ভিত্তি রয়েছে তার কোম্পানির।

তবে, যুক্তরাষ্ট্র-চীনা বাণিজ্য বিবাদ ও চীনা কোম্পানিগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রণেতাদের আরোপিত বা প্রস্তাবিত ক্রমবর্ধমান বিধিনিষেধ দেখে নিজের হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।“এটা খুবই বেইনসাফি” –বলেন তিনি। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রে নিজেদের ব্যবসা বিস্তৃতির চেষ্টা চালানোর সময় অন্যান্য দেশের উদ্যোক্তারাএমন সমস্যায় পড়েননি বলেও উল্লেখ করেন রায়ান। “আমরা অনেকটা বিস্কুটের মাঝে ‘স্যানডুইচ হয়ে যাওয়ার’ অনুভূতি পাচ্ছি।” এর সমাধান হিসেবে এশিয়ার অন্য কোনো দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের চেষ্টা করছেন তিনি। চীনের মূল ভূখণ্ডের সাতজন প্রযুক্তি উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

তাদের বেশিরভাগই বিদেশে পড়াশোনা করেছেন, যারা যুক্তরাষ্ট্রে নিজস্ব ব্যবসার বিস্তৃতি ঘটাতে আগ্রহী। সেই লক্ষ্যে অন্য কোনো দেশে স্থায়ী বসবাসের সুবিধা বা নাগরিকত্বের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। তাদের অধিকাংশই হংকং, কানাডা, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরের মতো বিকল্প দেশ খুঁজছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে রয়টার্স। এই সাত উদ্যোক্তার মধ্যে কেবল তিনজন নিজেদের ইংরেজি প্রথম নাম প্রকাশে সম্মত হন। আর চীনের অভ্যন্তরে এর প্রতিক্রিয়ার শঙ্কায় বাকিরা নিজেদের নাম গোপন রাখার অনুরোধ করেন। পাশাপাশি, নিজেদের ব্যবসা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য না দেওয়ার আহ্বানও জানান তারা।

ভরসা নাই !

যুক্তরাষ্ট্র-চীনা উত্তেজনা নতুন করে প্রেরণা পায় ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে। সে সময় চীনের ওপর বিস্তৃতভাবে শুল্ক আরোপের পাশাপাশি চীনা কোম্পানি হুয়াওয়ের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অধীনেও এই উত্তেজনা অব্যাহত আছে। উভয় দেশেরই ‘বৈশ্বিক প্রযুক্তি খাতে নেতৃত্ব দেওয়ার’ লক্ষ্যমাত্রাকে এর কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে রয়টার্স। চীনা প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের এমন সিদ্ধান্ত বিবেচনার পেছনে মুল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, ডেটা সুরক্ষা সংশ্লিষ্ট কারণে চীন থেকে চিপ রপ্তানিতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, মার্কিন সরকারী ডিভাইসগুলো ও গোটা মন্টানা অঙ্গরাজ্যে বাইটডড্যান্স মালিকানাধীন সামাজিক প্ল্যাটফর্ম টিকটকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো বিষয়গুলো।এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে সম্প্রতি বিশ্বের সবচেয়ে বড় মেমরি চিপ নির্মাতা মাইক্রনের পণ্য ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে চীন। এর পাশাপাশি, বিভিন্ন বিদেশী পরামর্শদাতা ও কোম্পানিগুলোর ‘লাগাম টেনে ধরার’ চেষ্টাও করেছে দেশটি।

উদ্যোক্তা ও পরামর্শদাতারা বলছেন, দুই দেশের মধ্যে চলমান ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় যুক্তরাষ্ট্রে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা বা দেশটি থেকে তহবিল অর্জনে আগ্রহী চীনা কোম্পানিগুলোর জন্য তুলনামুলক ‘প্রতিকূল পরিবেশ’ তৈরি করেছে।“ওয়াশিংটন ডিসি ও বেশ কিছু অঙ্গরাজ্যের রাজধানীর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এই ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি যে, চীনের সকল কোম্পানি দেশটির সরকার ও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত ও তাদের নির্দেশে চলে।” –বলেন মার্কিন পরামর্শক সংস্থা ‘অ্যাপকো ওয়ার্ল্ডওয়াইডের’ চীনা অংশের প্রধান জেমস ম্যাকগ্রেগর। যুক্তরাষ্ট্রে চীনা কোম্পানিগুলোর প্রতি এমন আচরণ নিয়ে রয়টার্স যুক্তরাষ্ট্রের বানিজ্য বিভাগের মন্তব্য জানতে চাইলে কোনো সাড়া মেলেনি। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, কোনো কোনো পশ্চিমা দেশ ‘প্রযুক্তির রাজনৈতিক মেরুকরণ’ করতে চায়। ফলে, তারা প্রচলিত প্রযুক্তি ও বাণিজ্য সহযোগিতার বেলায় বাধা তৈরি করে, যাতে কোনো পক্ষই লাভবান হয় না। আর বৈশ্বিক প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বিরূপ প্রভাব ফেলে এটি।

‘কম চীনা’ হয়ে ওঠার চেষ্টা

যুক্তরাষ্ট্রে চীনা ব্যবসায়ীদের বিস্তৃতি বাড়ানো এখন তুলনামূলক জটিল হয়ে উঠলেও রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলা উদোক্তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্যমাত্রা এখনও এটিই। তারা আরও যোগ করেন, আকারের বিষয়টি বিবেচনা সত্ত্বেও চীনের অভ্যন্তরীণ বাজারে মনোযোগ দেওয়া কোনো আকর্ষণীয় বিকল্প নয়। ২০২০ সালের শেষ নাগাদ থেকে চীনের ‘একদা স্বাধীনভাবে পরিচালিত’ প্রযুক্তি খাতে দুই বছরের ক্র্যাকডাউন ও মহামারী চলাকালীন কঠোর ‘জিরো-কোভিড’ ব্যবস্থাকে শি জিনপিংয়ের অধীনে চীনের প্রতি উদ্যোক্তাদের ‘মোহ ভাঙার কারণ’ হিসেবে “মহামারীর সময় সবকিছুই বদলে গেছে” –বলেন উদ্যোক্তা উইলসন। গত বছর চীনা নির্বাচনে শি টানা তৃতীয় মেয়াদে নিরঙ্কুশ জয়লাভের পর থেকেই নিজস্ব সফটওয়্যার স্টার্টআপ বিদেশে স্থানান্তরের উপায় খুঁজছেন তিনি।প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে রয়টার্স।

তিনি আরও বলেন, চীন থেকে ব্যবসা করা অসম্ভব ছিল না। তবে, ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে তিক্ততা এতটাই বেড়েছে যে কোম্পানির ‘কর্মী ও শেয়ার মালিকদের কাছে তার বিদেশে থাকাই’ সহজ উপায় হিসেবে বিবেচিত। চীনের প্রতি উদ্যোক্তাদের এমন মনোভাব নিয়ে রয়টার্স দেশটির সরকারী সংস্থা ‘স্টেট কাউন্সিল অফ ইনফর্মেশন অফিস (এসসিআইও)’ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্তব্য জানতে চাইলে তাদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। ‘নর্থ আমেরিকান ইকোস্টেম ইনস্টিটিউট’ নামের ব্যবসায়িক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চালানো শেনজেন শহরের উদ্যোক্তা ক্রিস পেরেইরা বলেন, কোম্পানিগুলোর সদর দপ্তর বদলাতে চাওয়া এমনকি চীন থেকে বিভিন্ন কোম্পানির মূল কার্যক্রম গুটিয়ে নেওয়া একটি প্রবণতা হয়ে উঠেছে। এদিকে, নিজেদের চীনা পরিচয়ের ওপর জোর দেওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে অনলাইন ফ্যাশন খুচরা বিক্রেতা ‘শিন’, যারা সিঙ্গাপুরভিত্তিক এক কোম্পানিকে নিজেদের ‘ডি ফ্যাক্টো হোল্ডিং কোম্পানি’ বানিয়েছে। অন্যদিকে, মে মাসের শুরুতে নিজেদের সদর দপ্তর সাংহাই থেকে আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনে স্থানান্তর করেছে ‘পিডিবি হোল্ডিংস’ নামে এক ই-কমার্স কোম্পানি।

এই প্রসঙ্গে রয়টার্সকে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি শিন। আর পিডিবির মন্তব্য জানতে চাইলেও কোনো সাড়া মেলেনি। এই বছর এখন পর্যন্ত নিজেদের কার্যক্রম বিদেশে সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে প্রায় একশটির মতো অনুসন্ধানের আবেদন পেয়েছে পেরেইরার কোম্পানি। পেরেইরা বলেন, কীভাবে বিদেশে কার্যকর উপায়ে স্থানীয় হওয়া যায় ও নিজের চীনা পরিচয় মুখোশের আড়ালে রাখার বিপরীতে কোনো কমিউনিটির অংশ হওয়া যায়, সে সম্পর্কে তিনি অনেককেই পরামর্শ দেন। উদ্যোক্তারা বলেন, তাদের প্রতি বেইজিংয়ের সমর্থনের প্রতিশ্রুতিতে ভরসা রাখতে পারছেন না। পাশাপাশি, নিজেদের নাগরিক স্বাধীনতা হারানো নিয়েও তারা শঙ্কিত। চীনে উচ্চাভিলাষী হওয়ার বেলায় প্রায়শই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ বলেন, এটি এমন একটি ধাপ যেটি তারা নিতে চান না।

এদিকে, নিজস্ব পণ্যের ওপর ঘন ঘন সরকারী বিধিনিষেধ আরোপে হতাশ হয়ে নিজের ব্যবসা গুটিয়ে চীন থেকে বিদেশে পাড়ি জমান আরেক উদ্যোক্তা টমি। চীনের আরোপিত বিধিনিষেধ কীভাবে বিভিন্ন ব্যবসার ওপর প্রভাব ফেলে, ওই প্রসঙ্গে রয়টার্স এসসিআইও’র মন্তব্য জানতে চাইলে কোনো জবাব মেলেনি। অন্যদিকে, সাম্প্রতিক ব্যবসায়িক সফরে যুক্তরাষ্ট্রের কাস্টম কর্মকর্তারা টমির মার্কিন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার পরও পরবর্তীতে দেশটিতে নিজস্ব ব্যবসার বিস্তৃতি বাড়ানোর লক্ষ্যে নতুন স্টার্টআপ নিয়ে কাজ করছেন তিনি। এই প্রসঙ্গে রয়টার্স যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা ‘কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রটেকশনের’ মন্তব্য জানতে চাইলে কোনো সাড়া মেলেনি।

এসএ/এমএএস/এমইউএ/টিএ/পরিচয়

শেয়ার করুন