নিউইয়র্ক     শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় বিএনপির ‘যৌথ ঘোষণা’

বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৩ | ১২:১৮ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ৩১ মে ২০২৩ | ১২:১৮ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় বিএনপির ‘যৌথ ঘোষণা’

বিএনপি। ছবি : সংগৃহীত

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে ‘যৌথ রূপরেখা’র ৩১ দফার একটি খসড়া তৈরি করেছে বিএনপি, যা সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের যৌথ ঘোষণাপত্র হিসেবে বিবেচিত হবে। এটি এখন চূড়ান্ত হওয়ার পথে রয়েছে। খসড়া রূপরেখায় বলা হয়েছে—একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে জয়লাভের পর সরকার হটানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে একটি ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ বা ‘জাতীয় সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা হবে, যারা রাষ্ট্রের সংস্কারে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের’ দলীয় ২৭ দফা রূপরেখার সঙ্গে নতুন আরও ৪টি দফা সংযুক্ত করে কয়েকদিন আগে ৩১ দফার একটি খসড়া রূপরেখা তৈরি করে বিএনপি। যেটা নিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চ ছাড়া এরই মধ্যে বাকি শরিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে দলটি। সেখানে যুগপতের শরিকরা এ খসড়া নিয়ে নিজেদের আপত্তি বা পরামর্শ তুলে ধরেছেন। এরপর খসড়া এ রূপরেখা নিয়ে গত সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে আলোচনা হয়। ঘোষণাপত্র নিয়ে সেখানে একপর্যায়ে বিতর্কে জড়ান নেতারা। বিএনপি ঘোষিত ২৭ দফার মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চের দাবি সমন্বয় করার পরামর্শ দেন কয়েকজন নেতা। কোনোভাবেই ২৭ দফা বাড়ানো ঠিক হবে না বলে তারা মত দেন; কিন্তু কয়েকজন নেতা এর বিরোধিতা করে গণতন্ত্র মঞ্চের দাবি গুরুত্ব দিয়ে দফা বাড়ানো যেতে পারে বলে মত দিলে বিতর্ক শুরু হয়। তবে বৈঠকে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

এ ইস্যুতে আজ বুধবার গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বৈঠক করবে বিএনপি। মঞ্চের নেতারা ৩১ দফা খসড়ার সঙ্গে সহমত পোষণ করলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির পরবর্তী বৈঠকে ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’টি চূড়ান্ত হতে পারে—যেটি যুগপৎ আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। আর গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা কোনো দফা বা একাধিক দফা নিয়ে আপত্তি জানালে চূড়ান্তকরণের প্রক্রিয়াটি দীর্ঘায়িত হতে পারে। সেক্ষেত্রে যৌথ রূপরেখা চূড়ান্ত করতে স্থায়ী কমিটির একাধিক বৈঠক লাগতে পারে বলে মনে করছেন বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা। তবে মধ্য জুনের আগেই ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ চূড়ান্ত করতে চায় দলটি। আর এই যৌথ রূপরেখার ভিত্তিতেই কোরবানির ঈদের পর ফের মাঠে গড়াবে যুগপৎ আন্দোলন। ঈদুল ফিতরের পর থেকে বিএনপি এককভাবে এবং মিত্ররা যুগপতের ধারায় দলীয় কর্মসূচি পালন করছে।

২৭ দফা হচ্ছে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের বিএনপির নিজস্ব একটি রূপরেখা। ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে কী কী করতে চায়, ওই রূপরেখার মধ্যে সেটা স্পষ্ট করেছে দলটি। এটাকে ভিত্তি ধরে গণতন্ত্র মঞ্চের প্রস্তাবিত ৩৫ দফা ও গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের ১৩ দফার সঙ্গে সমন্বয় করে যৌথ ঘোষণাপত্রের ৩১ দফা খসড়া প্রস্তুত করে বিএনপি। মূলত নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারসহ মঞ্চের কয়েকটি দফায় আপত্তি তুলে এককভাবে এই খসড়া যৌথ রূপরেখা করেছে দলটি। বিএনপির ২৭ দফার কিছু সংযোজন-বিয়োজন এবং এর সঙ্গে নতুন আরও ৪টি দফা সংযুক্ত করে রাষ্ট্র মেরামতের এই যৌথ ঘোষণাপত্রের খসড়া প্রণয়ন করা হয়। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঘোষিত দলের ‘ভিশন-২০৩০’ এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষিত ২৭ দফা কর্মসূচির আলোকে তৈরি করা হয়েছে যুগপৎ আন্দোলনের প্রস্তাবিত ৩১ দফা রূপরেখার এই খসড়া। বিএনপির নেতৃত্বে গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলন শুরু হয়, যেখানে ৩৮টি দল সম্পৃক্ত রয়েছে। ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও যুগপতের লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল কালবেলাকে বলেন, যৌথ ঘোষণাপত্র চূড়ান্তকরণের কাজ চলছে। শিগগিরই এটি ঘোষণা করা হবে। যদিও এটি ছাড়াও আন্দোলন চলমান রয়েছে। তবে যৌথ ঘোষণার পর আন্দোলন আরও গতি পাবে।

৩১ দফার সঙ্গে ২৭ দফার পার্থক্য যেখানে

বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফা রূপরেখায় বলা হয়েছে—প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি, সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচারবিভাগের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের সুসমন্বয় করা হবে। অন্যদিকে যুগপতের প্রস্তাবিত ৩১ দফায় ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি’ শব্দ দুটি বাদ দেওয়া হয়েছে। পরপর দুই টার্মের অতিরিক্ত কেউ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না বলে ২৭ দফায় উল্লেখ করা হয়েছে। আর ৩১ দফায় সেখানে ‘রাষ্ট্রপতি’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে। ২৭ দফায় বলা হয়েছে আস্থাভোট, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধনী বিল এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত এমন সব বিষয় ব্যতীত অন্যসব বিষয়ে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রদানের সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে। আর ৩১ দফায় ‘বিষয়টি’ বিবেচনা করা হবে বলে বলা হয়েছে। তবে গণতন্ত্র মঞ্চের প্রস্তাবিত ৩৫ দফায় বলা হয়েছে, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার করে সরকার গঠনে আস্থাভোট ও বাজেট পাস বিল ব্যতিরেকে সকল বিলে সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মতামত প্রদানের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।

২৭ দফায় ছিল-রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিবিড় জরিপের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হবে এবং তাঁদের যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রদান করা হবে। এই তালিকার ভিত্তিতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কল্যাণার্থে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই করে একটি সঠিক তালিকা প্রস্তুত করা হবে। আর ৩১ দফায় সেখানে প্রথমে ‘১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে যার যার অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে’—এই বাক্যটি সংযুক্ত করা হয়েছে। ২৭ দফায় আছে, বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান নৈরাজ্য দূর করে নিম্ন ও মধ্য পর্যায়ে চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা এবং উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। গবেষণায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করা হবে। অন্যদিকে ৩১ দফায় নতুন করে ‘একই মানের শিক্ষা ও মাতৃভাষায় শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, ভবিষ্যতের নেতৃত্ব গড়ে তুলতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে ক্রমান্বয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হবে’—এই বিষয়টি সংযুক্ত করা হয়েছে।

বিএনপির ২৭ দফা রূপরেখায় বলা হয়েছে, ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এই নীতির ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যের ‘NHS’-এর আদলে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রবর্তন করা হবে। জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করা হবে। আর যুগপতের ৩১ দফায় স্বাস্থ্যনীতির সঙ্গে ‘বিনা চিকিৎসায় কোনো মৃত্যু নয়’ এ ক্লজটি সংযুক্ত করে সবার জন্য স্বাস্থ্য কার্ড চালুর কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া দারিদ্র্য বিমোচন না হওয়া পর্যন্ত সুবিধাবঞ্চিত হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী আরও সম্প্রসারিত করার কথাও সেখানে সংযুক্ত করা হয়েছে। ২৭ দফায় রয়েছে, কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা হবে। প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে হলেও শস্য বীমা, পশু বীমা, মৎস্য বীমা এবং পোলট্রি বীমা চালু করা হবে। কৃষি জমির অকৃষি ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হবে। অন্যদিকে ৩১ দফায় ‘পর্যায়ক্রমে সব ইউনিয়নে কৃষিপণ্যের জন্য সরকারি ক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা হবে’—এই বিষয়টি সংযুক্ত করা হয়েছে।

এদিকে প্রস্তাবিত ৩১ দফায় ২৭ দফার বাইরে নতুন করে ৪টি দফা সংযুক্ত করা হয়েছে। সেগুলো হলো : ১. (২৮নং দফা) দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে সড়ক, রেল ও নৌপথের প্রয়োজনীয় সংস্কার করে সারা দেশে সমন্বিত বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। দেশের সমুদ্রবন্দর ও নৌবন্দরগুলোর আধুনিকায়ন, উন্নয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হবে। ২. (২৯নং দফা). জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট ও ক্ষতি মোকাবিলায় টেকসই ও কার্যকর কর্মকৌশল গ্রহণ করা হবে। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সর্বাধুনিক ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে। নদী ও জলাশয় দূষণ প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং বন্যা ও খরা প্রতিরোধে খাল-নদী খনন, পুনঃখনন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে। সামুদ্রিক সম্পদের বিজ্ঞানসম্মত জরিপ ও মজুতের ভিত্তিতে তা আহরণ এবং অর্থনৈতিক ব্যবহারের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ৩. (৩০নং দফা). তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতকে বৈশ্বিক মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সর্বক্ষেত্রে এর প্রয়োগকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। মহাকাশ গবেষণা এবং আনবিক শক্তি কমিশনের কার্যক্রমের প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রায়োগিক সুযোগসমৃদ্ধ করা হবে। ৪. (৩১নং দফা) এক জাতীয় মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে শহরে ও গ্রামে কৃষি জমি নষ্ট না করে এবং নগরে জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ হ্রাস করে পরিকল্পিত আবাসন ও নগরায়নের নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে। পর্যায়ক্রমে দেশের সব দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আবাসন নিশ্চিত করা হবে। সূত্র : দৈনিক কালবেলা

এসএ/এমএএস/এমইউএ/টিএ/পরিচয়

শেয়ার করুন