নিউইয়র্ক     শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

আবু আহমেদ

আইএমএফের সব কথা শুনতে নেই

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ মে ২০২৩ | ০৭:০২ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১৯ মে ২০২৩ | ০৭:০২ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
আইএমএফের সব কথা শুনতে নেই

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে এত তড়িৎগতিতে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ দিল কেন এটা ভাবার বিষয়। তবে আমাদের জ্ঞান এটাই বলে যে বাংলাদেশ তাদের জন্য ভালো গ্রাহক বা কাস্টমার, তাই তারা বেশি প্রশ্ন উপস্থাপন না করে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে বাংলাদেশকে ঋণ দিতে সম্মত হয়। সে বিচারে অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো আইএমএফও একটি ঋণ বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। বিশ্বব্যাপী তারা উপযুক্ত গ্রাহক খোঁজ করে কোন দেশের কাছে ঋণ বিক্রি করতে পারে। তাদের ঋণের চাহিদা তখনই বাড়বে, যখন দেশগুলো তাদের বৈদেশিক দায় মেটাতে হিমশিম খায়। আইএমএফের ঋণের গ্রাহক বিশ্বের অনুন্নত অর্থনীতিগুলো যারা বৈদেশিক মুদ্রায় তথা ইউএস ডলারে বৈদেশিক দায় মেটাতে গিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হয়। বৈদেশিক দায় বা বিদেশ থেকে পণ্য ও সেবা কিনতে গেলে স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ করা যায় না। এটা পরিশোধ করতে হয় ডলার-ইউরো-ইয়েনে যেসব মুদ্রা আইএমএফ কর্তৃক রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃত। আর ডলারের প্রাধান্য স্বীকার করা হয়েছিল ব্রেটন উডস সম্মেলনের মাধ্যমে ১৯৪৪ সালে। তখন যুক্তরাষ্ট্র গ্যারান্টি দিয়েছিল যে তাদের ডলারের বিপরীতে স্বর্ণ মজুদ আছে। অর্থাৎ ডলার দিলে প্রতিজ্ঞা মতো স্বর্ণ পাওয়া যাবে।

সেই অর্থে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও বিনিময়ের ক্ষেত্রে এক ধরনের স্বর্ণমান বজায় ছিল। কিন্তু সেটা ১৯৭১ পর্যন্ত। ওই বছর যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্য ঘোষণা করে যে তারা ডলারের বিপরীতে প্রতিজ্ঞামতো স্বর্ণ দিতে পারবে না। এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারও হয়ে পড়ল বিশ্বায়নের মুদ্রা যাকে অর্থনীতিশাস্ত্রে বলে ফিয়াট মানি। ফিয়াট মানির বিপরীতে কোনো কিছু মজুদ নেই। আছে শুধু বিশ্বায়ন। এখন বিশ্বের অন্য মুদ্রার মতো ডলারও আরেকটা মুদ্রা। তবে ডলারের পেছনে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি আছে। তারা বলে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ফেড) অতি দায়িত্বশীল। কখনো মুদ্রা ছাপিয়ে বিশ্বকে ফ্লাড করে দেবে না। আবার তারা এও বলে তাদের মুদ্রা ডলার পূর্ণাঙ্গভাবে পরিবর্তনযোগ্য। ডলার ধারণে আনা-নেয়ায় কোনো বাধা নেই। এর অন্য অর্থ হলো তাদের ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট পূর্ণাঙ্গভাবে বিনিময়যোগ্য। ডলার ফিয়াট হওয়ার পর এ মুদ্রা আর ইউরো-ইয়েন-ব্রিটিশ পাউন্ড-কানাডিয়ান ডলার-অস্ট্রেলিয়ান ডলারের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। বিশ্বের অধিকাংশ লোক ডলার পছন্দ করে; এটি বহনে স্বস্তি বোধ করে, সেজন্যই ডলারের এই আধিপত্য। বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোয় আগে রিজার্ভ মুদ্রার ৬০ শতাংশ ডলারে ধারণ করা হতো। আর আন্তর্জাতিক লেনদেনের ৫০ শতাংশ আজও ডলারে মেটানো হয়। তবে ডলারের এই একচেটিয়া প্রভাব সাম্প্রতিক বছরগুলোয় হুমকির মুখে পড়েছে। চীনা মুদ্রা ইউয়ানও এখন রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃত। আইএমএফের এসডিআরে এই মুদ্রা কয়েক বছর আগেই স্থান করে নিয়েছে। এর অর্থ হলো ইউয়ান এখন আইএমএফ কর্তৃক একটি স্বীকৃত রিজার্ভ কারেন্সি। তবে ইউয়ানের ব্যবহার এখনো সীমিত। কচ্ছপের গতিতে এগোচ্ছে অবশ্য। সামনের দিনগুলো ইউয়ান ডলারের হিস্যাতে ভাগ বসাতে যাচ্ছে। চীন হলো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। সেই তুলনায় আন্তর্জাতিক লেনদেনে ইউয়ান এখনো অনেক পিছিয়ে। যা-ই হোক, অবস্থা যা দেখা যাচ্ছে ব্রেটন উডসের অর্থ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। দেশগুলোর মধ্যে লেনদেন এখন স্থানীয় মুদ্রায় হওয়ার সম্ভাবনাও দেখা দিচ্ছে। মূল কথায় আসি, আইএমএফের ঋণ যারা নেয় সেসব দেশ অন্য দেশের মুদ্রার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক দেনা পরিশোধ করে। যেমন গ্রেট ব্রিটেনের (জিবি) আইএমএফের ঋণের প্রয়োজন পড়ে না। তারা চাইলেই ব্রিটিশ পাউন্ডে আন্তর্জাতিক দেনা পরিশোধ করতে পারে। অর্থের দরকার হলে ব্রিটিশ সরকার তাদের দেশের জনগণ অথবা কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ব্যাংক অব ইংল্যান্ড) থেকে ঋণ নিতে পারে। কোনো দেশের মুদ্রা রিজার্ভ মানের হিসাবে স্বীকৃত হলেই যে ওই দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্ট নিজেদের পক্ষে থাকবে এমন নয়। বাণিজ্য ঘাটতি এসব দেশেরও হয়, তবে তারা ঘাটতিজনিত দায় মেটাতে হন্যে হয়ে ডলারের খোঁজে দৌড়ে নেমে যায় না। তাদের নিজ মুদ্রাই তো স্বীকৃত রিজার্ভ মুদ্রা, যত সমস্যা বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিগুলোর জন্য। বাংলাদেশ যদি বাণিজ্য ঘাটতির সম্মুখীন হয় দায় মেটাতে হবে ডলার-ইউরোতে বা অন্য রিজার্ভ মুদ্রায়। তবে সেই সব রিজার্ভ মুদ্রা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে যথেষ্ট থাকলেই তো হতো। সমস্যা হলো বৈদেশিক দায় মেটানোর জন্য যথেষ্ট রিজার্ভ মুদ্রা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ হিসাবে আজকে যদি ৬০ বিলিয়ন ডলার থাকত, তাহলে বাংলাদেশ হেসেখেলে আরো বেশি আমদানি করতে পারত। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৬ বিলিয়ন ডলার। আর বাণিজ্য ঘাটতির দরুন সেই হিসাব যখন ৩০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এল, তখন বাংলাদেশ নড়েচড়ে বসল। তবে তা যদি ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসত, তাহলে হাঁটু কাঁপুনি শুরু হতো। আর তখন আইএমএফও এত ঋণ বাংলাদেশকে দিত কিনা তা সন্দেহ ছিল।

যে অর্থনীতি ঋণ ফেরত দিতে পারবে না সেই অর্থনীতিকে আইএমএফ সহজে ঋণ দিতে চায় না। উদাহরণ তো শ্রীলংকা-পাকিস্তান। পাকিস্তান শর্তের মাধ্যমে হলেও আইএমএফের ঋণ পাচ্ছে না। আইএমএফ দেখছে পাকিস্তান ঋণ ফেরত দিতে পারবে না। আজকে পাকিস্তানের অবস্থা হলো এক ঋণ নিয়ে আরেকটা ঋণ শোধ করছে। বাংলাদেশে অর্থনীতি এখনো ভালো আছে। তবে সামনের ব্যাপারে সংকট আছে। বাংলাদেশকেও অনেক ঋণ বৈদেশিক মুদ্রায় শোধ করতে হবে। আরো ঋণ সামলাতে হবে। তাই তো আইএমএফ নিজ স্বার্থেই বলছে তোমাদের রিজার্ভ বাড়াও। কিন্তু কীভাবে? রিজার্ভ বাড়াতে গেলে হয় আমদানি আরো কমাতে হবে, নতুবা রফতানি বাড়াতে হবে। নতুবা বিদেশ থেকে আরো ঋণ নিতে হবে, নতুবা একজোট হয়ে এনবিআর (নন-রেসিডেন্ট ব্যাংক) বা প্রবাসীদের আরো বেশি করে রেমিট্যান্স পাঠাতে হবে। এখন তারা বছরে ২৫ বিলিয়ন ডলার পাঠায়। তারা যদি ৩০ বিলিয়ন ডলার পাঠায়, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকে কিছু বাড়তি রিজার্ভ মুদ্রা জমা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে কতটা রিজার্ভ মুদ্রা জমা থাকবে তা নির্ভর করছে এই মুদ্রার চাহিদা-সরবরাহের ওপর। সরবরাহ বা জোগান আসে রফতানি আয়, রেমিট্যান্স আর বৈদেশিক বিনিয়োগ থেকে। আর রিজার্ভের চাহিদা হয় আমদানি দায় মেটাতে, বাংলাদেশীরা বিদেশে গিয়ে ব্যয় করলে, বিদেশী কোম্পানিগুলো মুনাফা ও মূলধন বাংলাদেশের বাইরে নিতে গেলে। বিদেশে বিনিয়োগের জন্যও রিজার্ভ মুদ্রার প্রয়োজন পড়ে, তবে সেটা বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো অনুমোদন দেয়নি। অনুমোদন দিয়েছে কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে অতি সীমিত আকারে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ সামনের দিনগুলোয় রিজার্ভ মুদ্রার জোগান দেয়ার ক্ষেত্রে টানাপড়েনে থাকবে। কারণ অব্যাহতভাবে রিজার্ভ মুদ্রার চাহিদা বৃদ্ধি। এই বৃদ্ধি বড় রকমের ঘটবে বৈদেশিক ঋণের দায় মেটাতে। বাংলাদেশকে বৈদেশিক ঋণ নিতে অবশ্যই রিজার্ভ থাকতে হবে। পেলেই বৈদেশিক ঋণ নিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। একসময়ে ১ ডলার ৮৫ টাকা করেই কিনতে হতো, আজকে সেই ডলার কিনতে হচ্ছে ১০৭ টাকায়। এর অন্য অর্থ যারা ডলারে আয় ধারণ করেছে তারা টাকার অংকে লাভবান হবে। সামনের দিনগুলোয় বিনিময় হার আমাদের পক্ষে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। বিনিময় হার যতই আমাদের বিপক্ষে যাবে ততই অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি ঘটবে। আজকে যে পণ্যমূল্য দ্রুত বাড়ছে; তার অন্যতম কারণ ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য হারানো। ডলার-টাকার বিনিময় বাজার খোলা বা প্রতিযোগিতামূলক নয়। এটা অনেকটা সীমিত বাজার। বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যবেক্ষণে রাখে। ব্যাংকিং বাজার ছাড়াও ডলার-ইউরো বিনিময়ের ক্ষেত্রে আরেকটি বাজার আছে। যে বাজারের মূল্য আরো বেশি। সে বাজার ছিল, আছে এবং থাকবে। আমরা তো মূলধনি হিসাবকে এখনো বিনিময়যোগ্য করিনি। ফলে লোকে বড় আকারের আয় সরাতে গেলে কথিত হুন্ডি মার্কেটের শরণাপন্ন হয়। অতিধনীরা বিদেশেই বাংলাদেশীদের থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে বিদেশের ব্যাংকে অর্থ রাখতে এবং টাকায় বাংলাদেশীদের দেশেই সেই অর্থের বিনিময়মূল্য পরিশোধ করছে। এর অর্থ, যে আয় বৈদেশিক মুদ্রায় দেশে আসত তা আসছে না। যা-ই হোক অর্থের ভাষায় বিনিময়মূল্য এবং খরচ নিয়ে আরো অনেক কথা আছে। আমার মনে হচ্ছে, বৈদেশিক ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে বেশি উদার নীতি গ্রহণ করে চলেছি। এর ভার সম্পর্কে আমরা সজাগ। ঋণ পেলেই নিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। ঋণ বিক্রেতারাও চাইবেই আমরা যেন ঋণ নিই। গরিব লোকের ঋণ নেয়ার আকাঙ্ক্ষাকে পুঁজি করে অনেক এনজিও দেশের গরিব লোকদের ঋণের জালে আবদ্ধ করে ফেলেছে। ভালো কথা হলো ঋণ করতে নেই। বিশ্বের অনেক অর্থনীতি প্রজেক্ট অর্থায়নের নামে ঋণ করে ঘি খেয়েছে। আজকে তাদের অবস্থা অনেক খারাপের দিকে। ভালো হলো নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী চলা। দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ করলে সেই ঋণের বোঝা তুলনামূলকভাবে কম থাকে। কিন্তু বৈদেশিক সূত্র থেকে ঋণ করলে সেই ঋণের বোঝা অনেক বেশি। আইএমএফ ঋণ দিতে গেলে অবশ্য তারা কিছু দেখবে। দেখার মধ্যে আছে আমরা অর্থনীতিতে কোথায় কোথায় ভর্তুকি দিচ্ছি। আমাদের ট্যাক্স কালেকশন কেমন, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি কেমন, আমাদের আর্থিক ব্যবস্থা কতটা মজবুত ইত্যাদি। এসব দেখার বিষয় তাদের বইয়েই লেখা আছে। প্রায় প্রতিটি অর্থনীতির ক্ষেত্রেই যেখানে তারা ঋণ দিচ্ছে এসব সাধারণ বিষয় দেখে। অর্থনীতিকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে তাদের একঝাঁক অর্থনীতিবিদ আছে, যাদের বলা হয় স্টাফ ইকোনমিস্ট। স্যুট-টাই আর কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে তারা দেশে দেশে গিয়ে অর্থনৈতিক ম্যানেজমেন্টের দুর্বলতাগুলো বা অর্থনীতির খুঁতগুলো তালাশ করে। তারপর বলে তোমাদের ঋণের কিস্তি পেতে হলে এই এই করতে হবে। তারা মনে করে এসব অনুন্নত অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা অতিশয় দুর্বল এবং এসব অর্থনীতি অতি ব্যয় ও ভর্তুকি প্রদানকে ভালোবাসে। বিশ্বে এমন কোনো অর্থনীতি নেই, যেখানে অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় এ পণ্ডিতরা ত্রুটি বের করতে পারবে না। আইএমএফ বলে তোমার ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত কম। আরো ট্যাক্স কালেকশন করো, এ অনুপাতকে বাড়াও। কিন্তু বাংলাদেশের মতো নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে ট্যাক্স-জিডিপি বাড়ানোর পক্ষে আলাদা কোনো অর্থনৈতিক মূল্য নেই। ট্যাক্স বাড়ালে অর্থ ব্যক্তি বা প্রাইভেট খাত থেকে বর্ধিত হারে সরকারের হাতে যাবে। প্রশ্ন হলো, অর্থের ভালো ব্যবহারকারী কে? সরকার না ব্যক্তি? যদি অর্থের ভালো ব্যবহার ব্যক্তির হাতে তুলনামূলক ভালো হয়, তাহলে তো অবশ্যই কম ট্যাক্সের পক্ষেই যুক্তি দেব। ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত অনেক ওপরে আছে এমন দেশগুলোয় আমাদের তুলনায় লোকের মাথাপিছু আয় ১০ গুণ বা আরো বেশি। ওইসব দেশে বেশি ট্যাক্স সরকার নিলেও ট্যাক্সের ভারটা তারা ততটা অনুভব করে না। বাংলাদেশের আয়ের অবস্থান এখন যে পর্যায়ে আছে তাতে ট্যাক্স বাড়ালে বিনিয়োগ কমবে, ট্যাক্স ফাঁকি বাড়বে এবং ভোক্তা ব্যয় কমবে। এমনিতেই বাংলাদেশে ট্যাক্স হার আমাদের এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। ট্যাক্স হার আরো বৃদ্ধি করা বা আরো বেশি ট্যাক্স কালেকশনের অর্থনৈতিক বিষয়টি ভেবে দেখা উচিত। আমাদের অর্থনীতি দুর্বল হলে ট্যাক্স সংগ্রহও কমবে। দুর্বল আয়ের অর্থনীতিতে বেশি করে ট্যাক্স কালেকশন করতে গেলে জনজীবনে দুর্ভোগ আরো বাড়বে। আইএমএফ ভর্তুকিগুলো দিতে বলে। সব ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিতে হবে এমনও নয়। ভর্তুকি অর্থনীতিকে দুর্বল করে। সম্পদের অদক্ষ ব্যবস্থাপনাকে উৎসাহ দেয়। তবে সব ক্ষেত্রে ভর্তুকি তুলে দেয়া ঠিক হবে না। যেমন কৃষিতে, অন্য বিষয় হলো জ্বালানিতে ভর্তুকি দিলে অর্থনীতিতে তার ফল ইতিবাচক হয়। যে ভর্তুকির ফলে অর্থনীতি জোরে এগোবে সেই ভর্তুকি অবশ্যই সমর্থনযোগ্য। জ্বালানি ভর্তুকি হলো এমন একটা ভর্তুকি। এক্ষেত্রে আইএমএফয়ের পরামর্শই সর্বশেষ শিরোধার্য ভাবা ঠিক হবে না। বাংলাদেশ প্রায় দুই যুগ ধরে ম্যাক্রো অর্থনৈতিক ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে সফলতা দেখিয়েছে। আমরা এখন ভয়ের মধ্যে আছি আমাদের ম্যাক্রো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা আরো না দুর্বল হয়ে পড়ে। মূল্যস্ফীতি রোধ করা এটাই বড় বেশি হওয়া উচিত। সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি রোধ করা যাবে না। বরং তাতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। বিদেশী সুদের হার বাড়ছে বলেই বাংলাদেশ ব্যাংককেও সেই দিকে দৌড়াতে হবে এমন কোনো কথা নেই। সুদের একাধিক হার হওয়াটাই স্বাভাবিক। শেষ কথা হলো, আমাদের ম্যাক্রো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা যদি ভবিষ্যতে হুমকির মুখে পড়ে, তবে সেটা ঘটবে আমাদের বৈদেশিক ঋণের দেনা মেটাতে গিয়ে। সময় থাকতে বাংলাদেশ সরকারকে কোমরের বেল্ট টাইট করতে হবে। নাহলে পরে আরো বড় দুঃখ পেতে হবে। আবু আহমেদ: শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। বণিকবার্তার সৌজন্যে

নাছরিন/পরিচয়

শেয়ার করুন