বিভিন্ন জটিলতার পর সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পে প্রায় সোয়া ৩ কোটি টাকা থোক বরাদ্দের অনুমোদন দিয়েছে সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর এক মাসের মধ্যে এই বরাদ্দের টাকা পাওয়া যাবে বলে আশা করছে বন বিভাগ। সে অনুযায়ী আগামী ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে সুন্দরবনে ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতিতে বাঘশুমারির প্রস্তুতি শুরু করছে সংস্থাটি।
সুন্দরবনে বর্তমানে কতকগুলো বাঘ আছে, তা এই ক্যামেরা ট্র্যাপিং (ক্যামেরার ফাঁদ) পদ্ধতিতে শুমারির মাধ্যমে বের করা হবে। বনের গভীরে গিয়ে এমন সব জায়গায় ক্যামেরা স্থাপন করা হবে, যেখান দিয়ে বাঘ চলাচলের সম্ভাবনা রয়েছে। খুঁটিতে বাঘের আনুমানিক উচ্চতায় ক্যামেরা বসানো হয়। এসব ক্যামেরার সামনে দিয়ে বাঘ বা কোনো প্রাণী চলাফেরা করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছবি উঠবে। ২০১৮ সালের জরিপ অনুয়ায়ী সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১১৪টি, যা ২০১৫ সালে ছিল ১০৬টি।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) ও প্রকল্প পরিচালক ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন জানান, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ৩ কোটি ২১ লাখ টাকা থোক বরাদ্দ দেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ ছাড় পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আগামী এক মাসের মধ্যে এই টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ অবস্থায় বাঘশুমারি শুরু করার জন্য গত সোমবার বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও বাঘ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে প্রস্তুতি সভা করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, সভায় কনসালট্যান্ট নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করা, ক্যামেরা সংগ্রহ, ম্যাপ তৈরি, যে জায়গাগুলোতে ক্যামেরা স্থাপন করা হবে; সেগুলোর তালিকা তৈরি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে বাঘশুমারি করার জন্য প্রস্তুতিমূলক অন্যান্য কার্যক্রমও শুরু হয়েছে।
ডিএফও জানান, বন প্রাণী ব্যবস্থাপনা বিভাগের কাছে কিছু ক্যামেরা আছে। এ ছাড়া ২০১৮ সালের শুমারিতে ওয়াইল্ড টিম নামে একটি বেসরকারি সংস্থা বাঘশুমারিতে সহযোগিতা করেছিল, তাদের কাছেও কিছু ক্যামেরা আছে। সেগুলো সংগ্রহ করা হবে। এর পর যতগুলো ক্যামেরা প্রয়োজন হয়, সেগুলো প্রকল্পের টাকায় নতুন করে কেনা হবে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাঘের হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ ও সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণের জন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় গত ২৩ মার্চ ‘সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প’ শীর্ষক প্রকল্পের প্রশাসনিক অনুমোদন দেয়। প্রকল্পটির মোট ব্যয় হবে প্রায় ৩৬ কোটি টাকা। প্রকল্পটির মেয়াদ চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত। শুধু বাঘশুমারি খাতে ৩ কোটি ২৬ লাখ ৯৬ হাজার টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। তবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সেই ব্যয় সামান্য কমিয়ে ৩ কোটি ২১ লাখ টাকা বরাদ্দের অনুমোদন দিয়েছে।
বাঘশুমারি বা গণনার জন্য ৪ মাসের জন্য আবাসন লঞ্চ ও সাপোর্ট বোট ভাড়া করা হবে। বিশেষ ক্যাটাগরির প্রায় ২০০টি ক্যামেরা, ক্যামেরার ব্যাটারি ও এসডি কার্ড কেনা হবে। বন বিভাগ জানায়, প্রকল্পটির আওতায় আরও প্রায় ৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে বেশ কয়েকটি কার্যক্রম রয়েছে। কিন্তু এই টাকা বরাদ্দে এখনও অনুমোদন মেলেনি। প্রকল্পটির কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে- সুন্দরবনের বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনে ৪৯টি ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিমের ৩৪০ জন সদস্য ও ৪টি রেঞ্জের কমিউনিটি প্যাট্রল গ্রুপের ১৮৫ জন সদস্যকে প্রশিক্ষণ প্রদান, তাঁদের পোশাক সরবরাহ ও প্রতি মাসে বনকর্মীদের সঙ্গে মাসিক সভা করা।
খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো জানান, প্রকল্পের আওতায় বনের যে এলাকায় বাঘ বেশি রয়েছে সেখান থেকে কয়েকটি বাঘ অন্য যে এলাকায় বাঘ কম রয়েছে, সেখানে স্থানান্তর করা হবে। বাঘের পরজীবীর সংক্রমণ ও অন্যান্য রোগব্যাধি এবং মাত্রা নির্ণয় করা হবে।
তিনি জানান, বাঘের আবাসস্থল সুন্দরবন প্রায় প্রতিবছর আগুন লেগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুস্ক মৌসুমে সুন্দরবনের যে অংশে আগুন লাগার প্রবণতা বেশি, সে জায়গায় দুটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ ও সুন্দরবনে আগুন লাগলে যাতে তাৎক্ষণিকভাবে আগুন নেভানো যায়, সে জন্য আগুন নেভানোর যন্ত্রাংশ, পাইপ ও ড্রোন ক্রয় করা হবে।
সুন্দরবনে বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনে গ্রামসংলগ্ন এলাকায় নদী ও খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় বাঘ গ্রামে প্রবেশ করে জানমালের নিরাপত্তা হুমকি হয়ে থাকে। ওই ৬০ কিলোমিটার অংশে নাইলনের বেড়া নির্মাণ করে বাঘ-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
সুন্দরবনে ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডর, ২০০৯ সালে আইলা ও ২০২১ সালে ইয়াসের মতো বড় বড় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বনের সব এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। তখন বনের বাঘ ও বাঘের শিকার প্রাণী আশ্রয়ের জন্য লোকালয়ে প্রবেশ করে। এসব প্রাণীর ঘূর্ণিঝড়ের সময় আশ্রয়ের জন্য সুন্দরবনে ১২টি মাটির কিল্লা স্থাপন করা হবে। সূএ : সমকাল