এই সময়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিশ্বে সবচেয়ে দৃষ্টিকাড়া একজন সরকারপ্রধান। তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার কারণেই তাঁর প্রতি বিশ্বনেতাদের এতটা আগ্রহ। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধকালে সারা বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছিল। এর আগে বাংলাদেশের নাম বাইরের মানুষের কাছে পরিচিত ছিল না। বাংলা ভূখণ্ড যদিও ইতিহাসে খুব পরিচিত নাম ছিল, কিন্তু ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অধীন হয়ে পড়ে। সেটাও আরেক ধরনের পরাধীনতা ছিল। স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে আমাদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে কেবল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে।
তখনই পৃথিবীর মানুষ বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা শুনতে পায়, দেখতে পায়। যুদ্ধরত মানুষের ছবি সেই সময়ের বিশ্বের গণমাধ্যমের কল্যাণে মানুষ জানার সুযোগ পায়। স্বাধীনতার পর যাঁরা সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে গেছেন, তাঁরাই শুনেছেন বাংলাদেশ ও শেখ মুজিবের এমন পরিচয়ের কথা।
স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষ আমাদের তখন স্যালুট জানাত। কিন্তু তারা এটাও জানত যে শাসন-শোষণে আমরা নির্যাতিত ও বঞ্চিত হয়েছি, যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষই শুধু হারাইনি, দেশটাকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ধ্বংস করে গেছে। তার পরও দুনিয়ার সাধারণ মানুষ নতুন দেশ হিসেবে আমাদের চিনতে পেরেছে, আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধুকেও একজন যুগশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রপিতা হিসেবে সম্মান জানাত।
তবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরোধীরা তখন এই দেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’, বন্যা-দুর্ভিক্ষপীড়িত, পৃথিবীর অন্যতম প্রধান দরিদ্র দেশ বলে উপহাস করত। এই দেশের ভবিষ্যৎ তারা দেখেনি। কিন্তু আমাদের জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘আমার মাটি আছে, মানুষ আছে, তাই একদিন সোনা এ দেশে ফলবেই, প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ডও হবে বাংলাদেশ।’ এ ছিল তাঁর দিব্যদৃষ্টি। তিনি সাড়ে তিন বছরের মাথায় হতদরিদ্র দেশটাকে স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদায় উন্নীত করে গেছেন। আমাদের মাথাপিছু আয় তখন ২৯০ ডলারে উন্নীত হয়েছিল।
’৭৫- এর সব হত্যাযজ্ঞের পর সংবেদনশীল বিশ্ব আমাদের নিয়ে, আমাদের দেশপ্রেম নিয়েই হতাশা ব্যক্ত করেছে। জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ডট তখন তাঁর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছিলেন, ‘বেঙ্গলিজ ক্যান নো লংগার বি ট্রাস্টেড আফটার দ্য কিলিং অব শেখ মুজিব। দৌজ হু কিলড মুজিব ক্যান ডু অ্যানি হায়েনাস থিং।’ (শেখ মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিকে আর বিশ্বাস করা যাবে না। যারা মুজিবকে হত্যা করেছে, তারা যেকোনো জঘন্য জিনিস করতে পারে।) এ ধরনের জাতিগত ও রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের সঙ্গে লজ্জা ও অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যৎই কেবল কল্পনা করা যেতে পারে। কারণ কোনো জাতি এবং রাষ্ট্রই মহান দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী নেতৃত্ব ছাড়া কখনো স্বাধীন হয়নি, উন্নতও হয়নি। আমরা ’৭১-এ স্বাধীন হয়েছি বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সুযোগ্য সহযোগী নেতাদের মেধা, যোগ্যতা ও দেশপ্রেমের কারণে। তাঁদের দ্বারাই কেবল দেশটা উন্নত আধুনিক হতে পারত। কিন্তু তাঁদের সবাইকে হত্যা করা হলো দেশটাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাবাদর্শে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য।
বাংলাদেশ ’৭৫ থেকে ’৯৬ পর্যন্ত গৌরব করার তেমন কিছুই অর্জন করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদিত হলো, যা বিশ্বের দৃষ্টি কেড়ে নিল। গঙ্গার পানিচুক্তি হলো—তা-ও দীর্ঘদিনের এক সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে পেল। দেশের অর্থনীতি পাঁচ বছরে অনেকটাই স্বাবলম্বী হওয়ার প্রমাণ রেখে গেল। কিন্তু তখনো ’৭৫-এর ষড়যন্ত্রকারী ও সুবিধাভোগীরা রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িক অপপ্রচার ও ভারতবিরোধী জিগির তুলে মানুষকে বিভ্রান্তের চেষ্টার ত্রুটি করেনি। তাদের পেছনে ছিল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা গোষ্ঠী, যারা ২০০১-এর নির্বাচনকে ভেতরে ভেতরে কলঙ্কিত করেছিল। এরপর রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শক্তি দেশটাকে জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। তখনই বিশ্বের অনেক দেশ বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র, জঙ্গিবাদী রাষ্ট্ররূপেও অভিহিত করেছিল।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, সেই ভাবনা প্রায় তিরোহিত হতে বসেছিল। ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ড থেকে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করলেন। তাঁর হাতে ছিল বাংলাদেশটাকে বদলে দেওয়ার এক রূপকল্প, যা কেউ কেউ কল্পকাহিনি মনে করত। সে কারণে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করত ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাকে। পদ্মা সেতু, বিদ্যুৎ উৎপাদন, কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, দারিদ্র্যবিমোচন, বড় বড় মেগা প্রকল্প গ্রহণ, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ—সবকিছু নিয়েই একশ্রেণির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পরিচালনাকারীরা তামাশা আর অপপ্রচারের হাঁড়ি খুলে বসেছিল। যেন এসবের কোনো কিছুই বাংলাদেশে কেউ কোনো দিন দেখবে না! পদ্মা সেতুতে উঠলে পড়ে মরতে হবে—এমন কথাও ‘দায়িত্বশীলদের’ মুখ থেকে শুনতে হয়েছিল। বিদ্যুতের রূপকল্প নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ লেগেই ছিল।
শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহ হয়েছিল, ১৩ ও ১৪ সালের নির্বাচন প্রতিহত করার নীলনকশার অন্তরালেও একই পরিকল্পনা ছিল। উইলি ব্রান্ডট আমাদের জাতির ভেতরে লুকিয়ে থাকা এই অপশক্তিকে ’৭৫ সালেই চিনতে পেরেছিলেন। আর এই অপশক্তির অপপ্রচার, বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে শেখ হাসিনা বাংলাদেশটাকে আর্থসামাজিকভাবে বদলে দিলেন। যা কেউ কোনো দিন কল্পনাও করতে পারেনি, তা এ দেশে ১৫ বছরে একের পর এক বাস্তবায়িত হলো। আন্তর্জাতিকভাবে আমরা মর্যাদা লাভ করলাম মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করার। স্বীকৃতি দেওয়া হলো উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার।
বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সব উন্নত দেশের দৃষ্টিকাড়া একটি দেশ। শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই বিশাল সমুদ্রসীমা উদ্ধার করে আনলেন আন্তর্জাতিক আদালত থেকে। এই সমুদ্রসীমা বিশ্বের বড় বড় দেশের কাছে আমাদের অপার সম্ভাবনায় পরিণত হওয়ার বার্তা দিয়েছে। আমাদের মাটিতে এখন সত্যিই সোনা ফলছে। খাদ্য উৎপাদন চার গুণ বেড়েছে; বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আট গুণ বেড়েছে; শিল্প, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য এখন আমাদের এক অপার শক্তিতে পরিণত হয়েছে। সে কারণেই শেখ হাসিনাকে ব্রিকস, জি২০ সর্বত্র বিশ্বের তাবৎ বড় বড় নেতা প্রশংসা করেছেন। বাংলাদেশ ঘুরে যাচ্ছেন ইমানুয়েল মাখোঁর মতো রাষ্ট্রপ্রধানও। বাংলাদেশের এই উচ্চতা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের গুণেই তৈরি হয়েছে।
শেখ হাসিনা সরকারপ্রধান হিসেবে বাংলাদেশকে বদলে দিয়েছেন। স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য দূরকে দেখা তার মতো নেতারই বেশি বেশি প্রয়োজন। তিনি রাজনীতিতে এলেন অনেকটা আকস্মিকভাবেই। চরম প্রতিকূলতা পেছনে ফেলে তিনি কেবলই এগিয়ে গেলেন, দেশটাকেও এগিয়ে নিচ্ছেন। সে কারণেই এখন তিনি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে কেবলই উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর এই উচ্চতা দেশের অনেকেরই চোখে পড়ে না। তারা কেবল দেশ ধ্বংসেরই আওয়াজ দিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে শুধু ব্যর্থতা আর ব্যর্থতাই দেখছে। তাঁর পদত্যাগের দাবি প্রতিদিন শুনতে হচ্ছে। দেড় মাস পরে নতুন নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হতে যাচ্ছে। এখনো দেশে চলছে তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি, জামায়াতসহ ডান, বাম, প্রতিক্রিয়াশীলদের নানা দফা ও এক দফার আন্দোলন। শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলনের পরিণতি কী হবে, তা অল্প কদিন পরেই বোঝা যাবে।
কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে বিরাট অংশের মানুষ এবং আন্তর্জাতিক মহল জানে, শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে যা দিতে পেরেছেন, তা পূর্বের কোনো সরকারই কখনো দিতে পারেনি। বিষয়গুলো সম্পর্কে আওয়ামী লীগ জানে। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে যা দিয়েছেন, দিচ্ছেন, তার কতটা কৃতিত্ব দলের নেতা-কর্মীরা নেওয়ার জন্য নিজেদের তাঁর মতো করে যোগ্য করে তুলছেন, মাঠের নেতা-কর্মীদের মধ্যে তাঁর আদর্শ ধারণ করার চেষ্টা কয়জনই বা করছেন, তা নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন রয়েছে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে পদ-পদবি নিয়ে প্রতিযোগিতার চেয়ে দ্বন্দ্ব যখন বেশি দেখা যায়, তখন তাঁদের আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মী হিসেবে ভাবতে অন্যদের কিছুটা ধন্দে পড়তে হয়। নির্বাচন আসছে। বোঝাই যাচ্ছে, অনেকেই মনোনয়ন পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে নানা ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এমনকি দলীয় প্রধান যাঁদের আগামী দিনের জন্য দলের একান্ত প্রয়োজন বলে বিবেচনা করবেন, মনোনয়ন দেবেন, তাঁদের সবাইকে যে সবাই মনে-প্রাণে গ্রহণ করবে, তেমন আভাস-ইঙ্গিত অনেক জায়গায়ই পাওয়া যাচ্ছে না। এখনো আওয়ামী লীগ এবং এর নানা অঙ্গ-সংগঠনের নেতা-কর্মীদের জীবন ও জীবিকায় দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার আদর্শের তেমন কোনো ছাপ পরিলক্ষিত হয় না। অনেকেই আছেন নানা চাওয়া-পাওয়া নিয়ে।
কিন্তু দল ও দেশকে দেওয়ার জন্য তাঁরা কতটা নিজেকে প্রস্তুত করেছেন, দিতে পেরেছেন, না পারলে কেন পারেননি, সেই হিসাব কজনই বা মিলিয়ে দেখতে প্রস্তুত আছেন? সময়টা ততটাই অনুকূল, যতটা আদর্শ প্রধান বিবেচ্য বিষয়। কিন্তু প্রতিকূলতার বিষয়টিকে মোটেও উপেক্ষা করা যাবে না। শেখ হাসিনার পেছনে যেমন সার্বক্ষণিকভাবে শত্রুর বন্দুক অনুসরণ করছে, আওয়ামী লীগেরও তেমন আদর্শগত শত্রুর সংখ্যা কম নেই। ১৫ বছর টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে দলের ভেতরেই এখন অনেক বিভীষণের গোপন জায়গা তৈরি হয়ে আছে। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব রাজনীতির এক চিরন্তন অনুষঙ্গ। আদর্শের দ্বন্দ্ব ও বৈপরীত্য সমাজ ইতিহাসেরই দেখা পথ। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কতজনই আছেন এসব নিয়ে ভাবেন, সচেতন আছেন? যতই চারদিকে মিছিল আর স্লোগানের প্রদর্শন দেখি না কেন, জনগণের সঙ্গে সম্পর্কের সেতুবন্ধ নেত্রীর যত সব অর্জন আর ভবিষ্যৎ নির্মাণের প্রস্তুতির ধারণাগুলো নিয়ে যাওয়ার তাগিদ গত ১৫ বছরে অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। অনেকেই দলের ভাবমূর্তি স্থানীয় পর্যায়ে তৈরি করার চেয়ে নিজের ক্ষমতা ও শ্রীবৃদ্ধিতেই মনোযোগী ছিলেন। অথচ নেত্রী তৃণমূলের সাধারণ মানুষের জন্য অনেক কিছুই উজাড় করে দিয়েছেন। তৃণমূল কি পেরেছে তার সদ্ব্যবহার করতে? মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট।দৈনিক আজকের পত্রিকা-র সৌজন্যে