তখন ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। চোখে আধো ঘুম আধো জাগরণ। কার্তিকের ঠান্ডা বাতাস বইছে। সকালের শুরুতেই কেমন শীত শীত অনুভূতি। পায়ের কাছে পড়ে থাকা কাঁথাটাকে টেনে নিতে যাচ্ছিলাম, তখনই পাশের ঘর থেকে বারকয়েক কাশির শব্দ শুনে হুড়মুড় করে উঠে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি- বেলা বেশ গড়িয়েছে। আকরাম সাহেবের ওষুধ খাওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। বয়স তার সত্তরে ছুঁই ছুঁই। শরীরে বিভিন্ন রোগ বাসা বেঁধেছে। দেহে যে কটা দিন প্রাণ আছে সুস্থ থাকার জন্য নিয়মমতো ওষুধ-পথ্য খান। তাকে এই রজনী ছাড়া মানে আমি ছাড়া আর কেউ দেখার নেই। বিছানা ছেড়ে উঠে চোখে- মুখে এলোপাথাড়ি পানি দিয়ে ফ্রেশ হয়ে আকরাম সাহেবের ঘরে ঢুকলাম।
দেখি তিনি হাতের ওপর ভর দিয়ে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে বিছানায় বসে আছেন। পরনে সাদা আর ধূসর রঙের চেক লুঙ্গি, গায়ে সাদা হাফ হাতা গেঞ্জি। এক পলক দেখেই মনে হলো, তার দম নিতে কষ্ট হচ্ছে। এখনি বোধ হয় চোখগুলো কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। কাছে গিয়ে বললাম, ‘আপনেরে কি পানি দিব?’
উনি উপর নিচ মাথা নেড়ে ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন,‘ দাও।’
আমি আকরাম সাহেবকে পানি দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলাম। ফ্রিজ থেকে আগের দিন বিকেলে বানানো রুটি বের করে তাওয়ায় ছেঁকে প্লেটে সাজিয়ে নাস্তা দিলাম। শেষে ওষুধ খাইয়ে বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলাম, ‘এখন কেমন লাগছে?’
বসা থেকে বিছানার উপর বালিশে মাথা রাখতে রাখতে বললেন,‘একটু ভালো।’
আচ্ছা বলেই রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। এখন তিনি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবেন। হয়তো টিভি ছেড়ে হাদিস শুনবেন নয়তো কোরআন তেলওয়াত। আপাতত এ বেলার কাজ শেষ। বেশ কিছুটা সময় আমি নিশ্চিন্তে কাটাতে পারবো।
নিজের ঘরে ঢুকে বিছানার মাথার দিকের জানালাটা খুলে দিলাম। সকালের মৃদুমন্দ বাতাসে নীল রঙের পর্দাটা দুলে উঠল। বাইরে বাতাসে গাছের পাতারা তির তির করে দুলছে। আমি বিছানায় রাখা বালিশটা খাটের সাথে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে রইলাম। সকালের কাজের চাপে শরীরটা বেশ ক্লান্ত লাগছে। মনটাও বিষন্ন। আজকাল সবকিছু কেমন শূন্য মনে হয়, তুচ্ছ লাগে। তাছাড়া শূন্যতা ছাড়া আমার আর আছেই বা কি? খুব চেয়েও তো কিছুই আঁকড়ে ধরে রাখতে পারিনি। তবুও নিজেকেই নিজে স্বান্তনা দেই, ভালো আছি। বেশ আছি। এই ভেবে যাতে মনের চারপাশে যে বিষন্নতা ঘিরে রয়েছে তা যেন অন্তঃত এবেলা আমায় ছেড়ে দূরে কোথাও হারায়। কিছুক্ষণ চোখ দুটি বুঁজে থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু আমায় ঘিরে থাকা বিষন্নতারা কোথাও হারায় না। আরো যেন ঝেকে বসে আমারি অর্ন্তজগতে। তখন আমার ক্লানÍ চোখ দুটি মেলে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মাথার উপর ঝুলন্ত ফ্যানটি ঘুরছে। এখন চাইলেই অথবা সুইচ অন করলেই ফ্যানের মাতাল হাওয়া ছোট্ট এই ঘরটা জুড়ে দাপাদাপি করে বেড়ায়। অথচ সেই ছোটবেলায় যখন ঢাকা শহরের ছোট্ট একটা ঘরে আমার বাবা-মা তাদের তিন মেয়ে নিয়ে থাকতো তখন বাবার খাট বা চকি কোনোটাই কেনার টাকা ছিলো না। মাটির উপরেই একটা চাটি আর চাটির উপরেই দুই তিনটা কাঁথা বিছিয়ে আমরা থাকতাম। এই ঢালাও বিছানায় শুধু দুইটা মশারী আলাদা। একটা মশারীর ভিতরে বাবা-মা, অন্যটির ভিতরে আমরা তিন বোন। কিছুটা আড়াল বা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বলতে ছিলো এইটুকুই। গ্রীষ্মের গরমে অসহ্য কষ্ট হতো আমাদের। টিনের চাল। সারাদিন সূর্যের তাপে গরম হয়ে থাকতো আর রাতে সেই তাপটা যেন অসহনীয় হয়ে পড়তো। গরমে কিছুটা প্রশান্তির জন্য বাসায় কোনো ফ্যান ছিলো না। একমাত্র তালপাতার হাতপাখাই ছিল ভরসা। সেই হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে হাতে ফোসকা পড়ার উপক্রম হতো। ছোট বোনটা প্রায়ই বলতো- ‘গরমে অনেক কষ্ট হয়,একটা ফ্যান কিনেন না আব্বা…’
কিন্তু তিন বেলা খাবার যোগাতেই যেখানে হিমশিম খেতে হয় বাবার, সেখানে ফ্যান কিনবেন কোথা থেকে। এখন এটা বুঝলেও তখন সেই অল্প বয়সে এই ব্যাপারটা বোঝার ক্ষমতা ছিলো না আমাদের কোনো বোনেরই। উত্তরে বাবা শুধু হাসিমুখে বলতেন, ‘কিনবোরে মা কিনবো।’
‘কবে কিনবেন?’ ছোট্ট বোন শাহানা পাল্টা জিজ্ঞেস করলে বাবা বলতেন, ‘কয়টা দিন বাদেই কিনমু। হাতে কয়টা পয়সা জমুক!’
বাবার হয়তো আমাদের মিথ্যা আশ্বাস দিতে ভালো লাগতো না কিন্তু এছাড়া আর কিইবা করার ছিল!
একদিন সকালে দেখলাম বাবা মাকে বলছেন, ‘আমি একটু বাজারের দিকে যাইতেছি। জসিমের দোকান থেইকা ঘুইরা আসি।’
‘জসিমের দোকানে কি কাম?’ মা জিজ্ঞেস করলেন।
‘দ্যাখি গিয়া ফ্যানের দাম দর ক্যামন? শুনছি জসিমের দোকানে পুরানো ফ্যানও পাওন যায়। ফ্যানের মোটর, কয়েল এগুলান নষ্ট হইয়া গেলে মানুষ অল্প দামে বেইচা দেয়। যাইয়া দেখি, কিছু একটা ব্যবস্থা যদি করতে পারি! গরমে মাইয়াগুলার অনেক কষ্ট হয়।’
মেজো বোন রুনা তখন স্কুলে যায়। ক্লাস থ্রিতে পড়ে। ক্লাসের অন্যদের সুন্দর স্কুল ব্যাগ, নানা রকম চুল বাঁধার ব্যান্ড দেখে প্রায়ই দিন স্কুল থেকে ফিরে মায়ের কাছে অনেকটা আবদারের স্বরেই বলতো, ‘মা আমারে একটা সুন্দর ব্যাগ কিনা দিবা! জানো মা, আমাদের ক্লাসের মিনা কী সুন্দর সুন্দর ব্যান্ড দিয়া চুল বাঁইধা আসে।,
মা কিছু বলে না। চুপ করে থাকেন।
সারাদিন বাবার পাশাপাশি মাও খেটে মরেন, সংসারটা যেন একটু ভালোভাবে চলে, সেই আশায়। কিন্তু তাতেও লাভ হতো না। বেশিরভাগ সময়ই শুকনো মরিচ পোড়া আর পানি দিয়ে কচলে ভাত খেতে হতো। কথাগুলো মনে পড়লেই সেইসব দিনগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যেন আজো জীবন্ত, বিষাদে ভরা আর করুণ।
ভেবে আমার অবাক লাগে-জীবন কত অদ্ভুত! কতভাবেই না জীবনকে যাপন করতে হয়। কত কিছুই না লুকিয়ে থাকে প্রতিটি জীবনের ভাঁজে ভাঁজে। সে জীবনকে উপলব্ধি না করে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।
তখন মা সারাদিন সেলাই মেশিনে পেটিকোট, বøাউজ সেলাই করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করতেন। সেই টাকা দিয়ে হয়তো বস্তির ভাড়াটা দিতেন কিংবা বাজারে মুদি দোকানের বাকি পড়ে গেলে তার কিছুটা পরিশোধ করতেন। আর সংসারের অন্যসব খরচ বাবার টং দোকানের আয়ের টাকায় কোনোভাবে চলে যেতো। টানাটানির সংসার, কোনোকিছুরই ঠিকঠাক প্রয়োজন মিটতো না। এতো টানাপোড়নের মধ্য দিয়েও একবার মা মেজো বোন মিনাকে কিছু না বলে একটা স্কুলের ব্যাগ কিনে দিয়েছিলেন। সেই ব্যাগ দেখে, সেদিন কি যে খুশি হয়েছিলো মিনা!
কেননা বাবা-মা দু’জনেই চাইতেন, মেয়েদের পড়াশুনা শেখাতে। তারা একটা সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতেন। পড়াশুনা শেষ করে তার মেয়েগুলা প্রাইমারি স্কুলের আপাদের মতো শিক্ষকতা করবে। স্বামি-স্ত্রী দু’জনে মিলে টাকা জমিয়ে গ্রামে এক টুকরো জমি কিনে নিজেদের একটা বাড়ি করবে। এ রকম কত স্বপ্ন!
সারাদিন টং দোকানে গরমের মধ্যে পুড়ে মরতে মরতে বাবার শরীরটা একেবারে ভেঙে পড়লো। অবসাদে, ক্লান্তিতে হাত-পা ভেঙে আসতে চায়। গলা শুকিয়ে যায়। বুকেও থেমে থেমে ব্যথা করে। তাই দুই দিন ধরে দোকান খোলেন না বাবা। শরীর ভালো না থাকলে কাজ করবেন কেমন করে! গরীব মানুষের শরীরটাই তো সব।
এদিকে মায়ের হাতেও কোনো টাকা পয়সা নেই। তবুও মার্কেটের কাজ শেষে যে টাকা পেতেন তা থেকে সংসারের খরচ বাঁচিয়ে বাড়ি ফেরার সময় বাবার জন্য দুইটা বা একটা ফল কিনে নিয়ে আসেন মা। তাতে যদি বাবার শরীরের দূর্বলতা খানিকটা কমে!
একদিন হঠাৎ করেই বাবার খুব জ্বর হলো। সারা শরীর জ্বরের তাপে পুড়ে যাচ্ছিল। বাবা কিছু খেতে পারেন না। শোয়া থেকে উঠতে পারেন না। সপ্তাহখানিক অসুস্থ থাকার পর এক সকালে সংসারের কাজ করতে করতে মা বাবাকে বললেন, ‘কি ব্যাপার, উঠতাছেন না ক্যান? কত বেলা হইয়া গেল!’
বাবা মায়ের কথার কোনো উত্তর দেন না।
হঠাৎ মেঘের গুঢ়গুঢ় আওয়াজ । তখন বাইরের আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে। আলোকজ্জ্বল, স্নিগ্ধ সকালটা নিমিষেই আঁধারের মাঝে হারালো। এতোটাই অন্ধকার নেমে এলো যে, বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় দিনের বেলায় মোমবাতি জ্বালাতে হলো।
মা আবার বাবাকে বলেন, ‘কি অইলো, কথা কন না ক্যান? আইজ কি আপনার শরীরটা বেশি খারাপ?’ বাবা এবারও কিছু বলেন না। কাছে গিয়ে মা আরো কয়েকবার বাবাকে ডাকলেন, ‘রজনির বাপ ও রজনির বাপ!’ কোনো উত্তর না পেয়ে অজানা আশংকায় বাইরের মেঘলা আকাশের মতো মায়ের চোখে মুখেও আঁধার ঘনিভ’ত হয়ে এলো! ঘরের বাইরে তখন প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়া বইছে। মাঝে মাঝে আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মা তাকিয়ে দেখে-দমকা হাওয়ার তোড়ে এতোক্ষণ মোমবাতির সামান্য যে আলোটুকু প্রায় নিভু নিভু করছিলো, তা এখন একেবারে নিভে গেছে। বাতিটির দিকে তাকিয়ে মা তখন ভাবে, এটা কোনো অশুভ সংকেত নয়তো! তিনি এগিয়ে গিয়ে বাবার নাকের কাছে হাত নিলেন, বুকে কান পেতে নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু ততক্ষণে সব শব্দগুলো নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।
বাবা মারা গেলেন! আমার আর পড়াশোনা হলো না। আমি তখন ক্লাস এইটে ছিলাম। সংসারে অভাব তখন ঝাঁক বেঁধে এলো। তিন মেয়ে নিয়ে মা কীভাবে সংসার চালাবেন, কীভাবে আমাদের মানুষ করবেন এই নিয়ে ভীষণ বিপদে পড়লেন। তিনি বাইরে কাজ করতে গেলে আমরা ঘরে একা থাকি। আমাদের একা রেখে বাইরে যেতে খুব ভয় পেতেন মা! তার ভয়টা অন্য বোনদের তুলনায় আমাকে ঘিরেই বেশি ছিল। ভাবতেন, মেয়েটা বড় হয়েছে! একলা ঘরে থাকে! যদি ওর কোনো সর্বনাশ হয়ে যায়! কার মনে কী আছে তা তো বলা যায় না। এসব দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে মা তাড়াতাড়ি আমার বিয়েটা দিয়ে দিলেন।
বিছানায় বসে পুরনো দিনের কথা ভাবতে ভাবতে শুনি দরজায় সুর তুলে বেল বাজছে। এই অসময়ে আাবার কে এলো! বাইরেতো দেখছি নরম রোদ। কত বেলা হলো খেয়ালই করিনি। আলসেমি কাটিয়ে উঠে দরজা খুলে দেখি হকার এসেছে। আমি কিছু বলার আগেই সে বলল, ‘এ মাসের পত্রিকার বিলটার জন্য আসছি।’
‘ও । দাঁড়ান বলে ঘর থেকে টাকাটা নিয়ে হকারকে বিদায় করি।’ সে যাওয়ার পর দরজা লাগিয়ে আমার শোবার রুমে ঢুকে জানালার বাইরে চোখ পড়তেই দেখি, মেঘ পূর্ববর্তী বাতাসে ঘরের পর্দটা এলোমেলো দুলছে। বাইরের ঘন গাছপালাগুলোয় যেন আনন্দের জোয়ার বইছে। বাতাসের তোড়ে বাইরের ধুলাগুলো হুড়মুড় করে জানালা দিযে ঢুকতে লাগলো। আমি জানালাটা বন্ধ করে দিলাম, ধুলাবালিতে ঘর নোংরা হবে ভেবে। কিন্তু বন্ধ কাচের জানালার দুটি পর্দাটা দুই হাত দিয়ে দুদিকে সরিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকালেই মনে হয়, মেঘলা আকাশের সাথে মানুষের মনের একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। হৃদয়ের গহিনে থাকা ভুলে যাওয়া কত স্মৃতিরা জেগে ওঠে সেই মুহুর্তে! আবার কখনো কখনো অকারণেই মন খারাপ হয়। অযথাই কত কি করতে ইচ্ছে করে! ঠিক এরকমই এক মেঘলা দিনে আমার সাথে রাজুর বিয়ে হয়েছিল।
রাজু দেখতে লম্বা, গায়ের রঙ শ্যামলা। বয়সও বেশি না। আমার চেয়ে মাত্র পাঁচ বছরের বড়। তখন ওকে দেখে ভীষণ ভালো লেগে যায়। ওকে খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। ওর হাসি, ওর চাহনি, কথা বলা সবকিছইু ভালো লাগতো। আমার দু’চোখে তখন আকাশ ভরা স্বপ্ন। আমি তখন কোমরে আঁচল গুঁজে কাজ করি ছোট্ট সংসারে। সংসারে সুখ আর সোহাগের কোনো কমতি ছিলো না। শুধু স্বামী আর আমি। বিয়ের পর দিনগুলো বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিল।
রাজু ভালো গাইতেও জানতো। খুব মিষ্টি কন্ঠ তাঁর! এলাকায় গানের একটা সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলো সে। প্রায় সময়ই গানের অনুষ্ঠান থাকলে দলবল নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছুটে যেতো। গভীর রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলতো। ঢাকার বাইরে গেলে কখনো কখনো দুই-তিন দিন পর বাড়ি ফিরতো। আয়-উপার্জন যা করতো তাতে সংসার কোনোভাবে চলে যেতো। এখানে বাবার বাড়ির মতো এতো অভাব ছিলো না। তিনবেলা খাবারের জন্য হা-পিত্যেশ করতে হতো না।
তখন যৌবনের জোয়ারে মাতাল শরীর। দেহের ভাঁজে ভাঁজে ঝরে পড়ে কাম। সময়ে-অসময়ে বাইরে থেকে ফিরেই রাজু আমার শরীরে হাত দিতো। জড়িয়ে ধরতো। আদর করতো। আমার ভালো লাগতো।
একসময় ঘর আলো করে এলো আমাদের মেয়ে রেশমা। কিন্তু রাজু তখন গানের দল নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। সকালে বাসা থেকে বের হলে গভীর রাতে বাসায় ফিরে। বাসায় ফেরার পরও আমার বা রেশমার প্রতি তার তেমন কোনো মনোযোগ ছিল না। অকারণেই রেগে যেতো। সংসারের কোনো প্রয়োজনীয় কথা বললেও বিরক্ত হতো। দিনের পর দিন আমরা যেন তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠছিলাম।
এ অবস্থা থেকে মুক্তির কোনো উপায় না দেখে একসময় মায়ের বাড়িতে গিয়ে উঠি।
কিন্তু তাতে কোনো লাভ হলো না। দুই মাস কেটে যাবার পরও রাজু আমাদের খোঁজ নিতে আসে নি। এদিকে প্রতিবেশী, আত্মীয়- স্বজনেরা নানা কথা বলাবলি করে। তাদের ধারণা রাজু আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। এই ধারণাকেই সত্য মেনে পুরো বস্তি জুড়ে প্রচার চলতে থাকে।
অন্যদিকে একার উপার্জনে দুই বোনকে নিয়ে সংসার চালাতে মায়ের খুব কষ্ট হতো। তার মধ্যে আবার যোগ হয়েছি আমি আর আমার মেয়ে রেশমা। মা বেশ কিছুদিন ধরে পুরনো কাজের পাশাপাশি বাসার কাছেই গাজিপুরের একটা সোয়েটার ফ্যাক্টরী থেকে অল্পস্বল্প কিছু কাজের অর্ডার এনে এলাকায় গরিব মানুষদের দিয়ে করিয়ে নেন। সেইখান থেকে যে কমিশন পান তাতে দু-বেলা মুখে ভাত জোটে। সারাদিন মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে একবার কাজ দিয়ে আসেন আবার তাদের কাজ শেষ হলো কিনা গিয়ে দেখেন! নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ জমা না দিলে পরে আর কাজ পাওয়া যাবে না,তাই কী চৈত্রের রোদ আর কী বৃষ্টি কোনো কিছুতেই ঘরে বসে থাকার কোনো উপায় নেই। মায়ের রোদেপড়া মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যেতো।
মায়ের সংসারের এ অবস্থা দেখে স্বিদ্ধান্ত নেই, স্বামীর সংসারে ফিরে যাওয়ার। অনেকদিন পর নিজ সংসারে ফিরলেও রাজুর কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ল না। একদিন সকালে বাজারে যাবার সময় রাজুকে বললাম, ঘরে চাল নাই, এই বেলা চাল না আনলে না খাইয়া থাকা লাগব। কথা শুনেই রাজু আমার দিকে তেড়ে আসে। মুখের উপর বলে, ‘চাল না থাকলে আমি কি করুম! না থাকলে খাবি না। আর এতো যদি খাওনের শখ হয়, মায়ের বাড়িত থেইকা আইনা গিল! পয়সা-কড়ি ছাড়া তোর মায়ে এক ফকিরনি গছাইছে আমারে, আমি বিয়া না করলে তোরে বিয়া করতো কে শুনি?’
এরপর বহুদিন কেটে যায়, রাজু আমার বিছানায়ও আসে না। হঠাৎ করে মানুষটার যে কি হলো! কীভাবে এতো বদলে গেল! দিনরাত ভেবে ভেবে আমি দিশেহারা।
এক দুপুরে মায়ের কাছে গিয়েছিলাম কিছু টাকা আর কেজিখানিক চাল আনতে। ফিরে এসে দেখি, আমার ঘরের দরজাটা ভেজানো। অবাক হয়ে ভাবলাম, দরজা ভেজানো কেন? আমি তো ঘরে তালা দিয়ে গিয়েছি। তাহলে তালা খুললো কে? দ্রæত পায়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখি, বিছানায় রাজু আর তার সাথে একটি মেয়ে। মেয়েটিকে আমি আগেও দেখেছি। তারা একইসাথে গান করে।ওদের দেখেই আমার বুকের ভেতরটায় কেমন একটা ধাক্কা লাগে। তখন তাদের দু-জনের পরনের কাপড় এলোমেলো। আমাকে দেখেই মেয়েটি তাড়াহুড়ো করে বিছানা থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তখন আর আমার বোঝার কিছুই বাকি রইল না। আমি চিৎকার করে উঠি। দেয়ালে মাথা ঠুকি। বলি, হায় আল্লাহ! কি কপাল আমার! এটাও দেখতে হইল আমারে!
রাজু গলা উঁচিয়ে বলল, ‘বেশ করেছি, আমার ঘরে আমি যারে ইচ্ছা আনবো! তাতে কার কী? তোর ভালো না লাগলে বাহির হইয়া যা। দরজা খোলা আছে। আমারে মুক্তি দে।’
রাজুর আচরণ দেখে তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম। ভাবলাম-এ কি রাজু? এতো বদলে গেল কি করে? দুপুরের এতো আলোর মাঝেও দু’চোখে যেন অন্ধকার দেখতে পাই। মাথাটা ঝিমঝিম করছিলো। মাথার দু’পাশের রগ মনে হলো তখনই ছিঁড়ে যাবে। আমার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে রাজু ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
আমি রেশমার নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবি,বাচ্চাটা নিয়ে আমি এখন কি করব! কোথায় যাবো, জানি না। গলায় দড়ি দিব নাকি পানিতে ডুবে মরব? তাতে হয়তো আমি এ জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচব। কিন্তু আমার মেয়ের কি হবে? ওকে কে দেখবে?
কোনো উপায় না পেয়ে মায়ের কাছে যাই। গরীব মা ছাড়া আমারতো আর কেউ নেই। মাকে সব কিছু খুলে বলি। রাজু যে অন্য মেয়েকে নিয়ে ঘরে এসেছে সে কথাটাও জানাই। আমার সব কথা শুনে রাজুর প্রতি মা’র কোনো রাগতো হয়ইনি উল্টো মা আমাকে বললেন, ‘মাইয়া মানুষের এতো তেজ থাকতে নাই। সামান্য বিষয় নিয়া ঝামেলা কইরা ঘর ছাইড়া আসা তোর ঠিক হয় নাই। যা হওয়ার হইছে। নিজের ঘরে ফিরা যা। আর আরেকটা কথা তোরে জানাইয়া রাখি, আমার এখানে আমি তোরে রাখতে পারুম না।’
সেদিন মায়ের কথায় আমার দু’চোখ জুড়ে অন্ধকার নেমে এসেছিলো। মায়ের কাছে যখন আশ্র্রয় মিলল না তখন কোথায় যাব, কি করবো এরকম ভাবতে ভাবতে দুর সম্পর্কের এক চাচার কাছে যাই। তিনি যদি একটু আশ্রয় দেন, সেই আশায়। সেখানে গিয়ে দেখি তার অনেক বড় বাড়ি। বাড়িতে চাচি আর চাচা ছাড়া আর কেউ নেই। তাদের দুই ছেলে আর এক মেয়ে সবাই বিদেশে স্যাটেল। আমার সব কথা শুনে তিনি দুঃখ করলেন। আমাকে তার ঘরের পাশে ছোট্ট একচালা একটি টিনের ঘরে থাকতে দিলেন। সেখানে ঘর-দোর পরিস্কার করা, থালা-বাসন ধোয়া, সবার কাপড়চোপড় ধোয়া-এসব করে দিন কাটে আমার। তবু ভাবলাম, এভাবেই দিন যদি কেটে যায়,তাতে মন্দ কি? কারো মুখাপেক্ষী তো থাকতে হচ্ছে না। তাছাড়া রেশমাকে চাচি খুব আদর করেন। আমি যখন বাড়ির কাজ করি, তখন চাচিই রেশমাকে সামলান। কোলে তুল নেন, এটা ওটা খেতে দেন।
এ বাড়িতে কোনো কিছুরই অভাব নেই। শুয়ে বসে চাচির দিন কাটে। শুনেছি, চাচির সাথে চাচা গলা চড়িয়ে কথা বলেছেন এমন ঘটনা খুব কম। আর গায়ে হাত তোলাতো অনেক দূরের ব্যাপার। তার মানে যে, চাচা চাচিকে খুব সম্মান করেন বা ভালোবাসেন আমার তা মনে হয় না। আমার মনে হয়, তাকে তিনি যতটা না ভালোবাসতেন তার চেয়ে বেশি ভয় পেতেন। কেননা চাচি ছিলেন চেয়ারম্যানের মেয়ে। তার বাবার টাকাতেই এ বাড়িটি তৈরী করেছেন। তাই শুশুরবাড়ির লোকজন বেড়াতে এলে চাচা তাদের খুব সমীহ করতেন। বাজার থেকে তাজা মাছ, মুরগী এনে রান্না করে খাওয়াতে বলতেন।
তবুও চাচাকে ঠিক বুঝতে পারতাম না। তিনি বরাবরই চুপচাপ থাকতেন। খুব প্রয়োজন না হলে সামনে আসতেন না। তবে পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও তাকে কখনো খারাপ মানুষ মনে হয় নি। কিন্তু চাচার সম্পর্কে আমার এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো কিছুদিন পরেই।
একদিন রাতে বিছানায় শুয়ে আছি। ঘরের আলো তখন নিভানো। দরোজাটা ভেজানো ছিলো। আমার চোখ সারাদিনের ক্লান্তিতে বুঁজে আসছে। হঠাৎ কখন যে চাচা আমার ঘরে ঢুকেছেন তা টের পাই নি। যখন চাচার হাত আলতোভাবে আমার স্তন ছুঁয়ে গেলো, তাঁর ঠোঁট দুটো আমার গাল ছুঁয়ে ঠোঁটে চেপে বসল, আমি তখন চোখ মেলে আবিষ্কার করলাম, এক কামুক পুরুষকে।
এরপর তার অনুসন্ধিৎসু আঙ্গুলগুলো স্তনের বোঁটায় হাত ঘুরাতে ঘুরাতে ক্রমেই আমার উরু হাতড়াতে হাতড়াতে নিচের দিকে নামতে থাকে। আমার সারা শরীর তখন কাঁপতে লাগল। আমি তখন কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। এ দিকে চাচা ক্রমাগত আমার শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে, এ ছুঁয়ে যাওয়া আমায় এক অজানা, অনির্বচনীয় সুখানুভূতি দিয়ে যাচ্ছে। আমি সেই সুখানুভূতিকে অস্বীকার করতে পারি নি সেদিন। যে অনুভূতি অনেকদিন হলো হারিয়ে গেছে আমার জীবন থেকে। মনে হলো, আমার শরীরের দূরাগত কোনো বিন্দু থেকে কোনো পুরুষের স্পর্শে তা নতুন করে আবার জেগে উঠেছে। আমি সেই স্পর্শ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারি নি।
কিন্তু যখন সব শেষ হয়ে গেলো আমার ভিতরে তখন বিবেক জেগে উঠলো। মনে হলো এ আমি কী করলাম, কেন নিজেকে সঁপে দিলাম! আবার মনে হলো, এছাড়া আমার কিইবা করার ছিলো! আমি চিৎকার দিলে, চাচি যদি মনে করতেন তার স্বামিকে ফাঁসানোর জন্য এই গল্প ফেঁদেছি! তাতে কী লাভ হতো! বরং চাচি কষ্ট পেতেন। বিশ্বাস ভাঙ্গার কষ্ট।
আমার তখন মনে হলো, যার আশ্রয়ে থেকে, খেয়ে-পরে আমি আর আমার সন্তানের দিন কেটে যাচ্ছে, তার ঘরে আমি অশান্তির ঝড় তুলতে পারি না। এ বড় অন্যায়! তার চেয়ে এ অমার্জনীয় অপরাধের পুনরাবৃত্তি যেন না হয় আমার সেটাই করা উচিৎ। সিদ্ধান্ত নিলাম, এখান থেকে চলে যাব। কিন্তু কোথায় যাব? কার কাছে যাব? কেউই তো নেই! আর আমার মেয়ে রেশমা, ওরই বা কি হবে! সেদিন আবারো বুঝলাম-সহায় সম্বলহীন কোনো নারীর জীবনের পথ চলাটা সহজ নয়। তাদের ঘর যতটা শৃঙ্খলে আবদ্ধ, বাহির তার চেয়ে ঢের বেশি।
আমি রেশমার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ও ঘুমাচ্ছে! বাইরে চাঁেদর আলোকধারায় ভেসে যাচ্ছে পৃথিবী। জানালার গ্রিল গলে সেই আলো এসে যেন আছড়ে পড়ছে আমার রেশমার মুখে! কী মায়া তার মুখটায়!
একটু পরেই আমি রেশমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। রাত্রির গভীর নীরবতার মাঝে ঘর থেকে বেরিয়ে বট গাছটার মোড় পেরিয়ে যখন সামনে এগোচ্ছি ঠিক তখনই বুকের ভেতরটা হুহু করে কেঁদে উঠল। আমার সন্তানের জন্য। আমার রেশমার জন্য। সেই বাঁধভাঙা নীরব কান্নার জলে গাল ভিজেছিলো সেদিন।
হঠাৎ তখন কোনো বিভ্রান্ত দার্শনিকের মতো মনে হলো, সব মায়া সবার জীবনে মঙ্গল বয়ে আনে না। কিছু মায়া ত্যাগেই হয়তো সুখ লুকিয়ে থাকে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার মাতৃত্বের সবটুকু মমতার বিসর্জনে রেশমার জীবন যদি নিরাপদ হয়, তাতে ক্ষতি কী! যে নিরাপদ জীবন আমি পাই নি, সে নিরাপদ জীবন যদি রেশমা পায়, তাতে যদি ও ভালো থাকে তবে মা হয়ে সন্তানের প্রতি সব অধিকার থেকে নিজেকে স্বেচ্ছায় মুক্তি দিতে আমার কোনো দ্বিধা নেই। হয়তো চাচি রেশমাকে নিরাপদ একটা জীবন দিতে পারবেন। যা আমি ওকে কখনোই দিতে পারবো না।
‘রজনী, কোথায় গেলে?’ আকরাম সাহেবের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। হারানো দিনের স্মৃতির ভাঁজে ভাঁজে নিজেকে যেন এতোটা সময় ধরে হারিয়ে খুঁজেছি। এখন তাকে এক কাপ চা দিতে হবে। প্রতিদিন এ সময়ে এক কাপ চা তার চাই।
তবুও ভালো যে আকরাম সাহেবের মতো একজন মানুষের আশ্রয়ে আমি আছি। অথচ আমিও চেয়েছিলাম, স্বামী, সন্তান নিয়ে আমার ছোট্ট একটা সংসার হবে। হলো না। নিজের বলে আজ আর কিছুই নেই। যা আমার, শুধুই আমার ছিলো, তাও হারিয়ে ফেলেছি। আমার সন্তান আজ অন্য কারো আশ্রয়ে বেড়ে উঠছে। আমি যে তার মা এ সত্যটুকু সে হয়তো কোনোদিন জানবে না। হয়তো আমি আর রেশমা কখনো পাশাপাশি থাকলেও একে অপরকে চিনতে পারবো না। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে হঠাৎ অজান্তেই চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রæ ঝরে পড়লো। চোখ মুছে জানালা দিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকালাম। এতোক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। মেঘমুক্ত ঝকঝকে নীলাকাশ। তার নিচে একটি সোনালী ডানার চিল পাখা মেলে আপন মনে করুণ সুরে ডেকে ডেকে উড়ছে। চক্রাকারে উড়ছে তো উড়ছে। উড়ছে তো উড়ছেই…