সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গণস্বাস্থ্য বিষয়ে পিএইচডি করার সুযোগ পেয়েছেন ডা.তনিমা ইসলাম তৃষা। যেভাবে তাঁর এই পথচলা, তা নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন। অক্সফোর্ডের মতো প্রতিষ্ঠানে পড়ার স্বপ্ন মনের কোনায় ছিল, কিন্তু এর জন্য নিজেকে যোগ্য ভাবা, আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার সাহস ছিল না। তবুও মাত্র ১২ দিন আগে অক্সফোর্ডে আবেদন করে যখন চান্স পেয়ে যাই, সত্যি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
যশোরে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি। সেখানেই পুলিশ লাইনস মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করি। ছোটবেলা থেকে ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সরকারি মেডিকেলে সুযোগ মেলেনি। পরে ঢাকার হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই এবং সেখান থেকে এমবিবিএস পাস করি। উঁচু র্যাঙ্কিংয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য যে যোগ্যতা, ব্যাকগ্রাউন্ড, খরচ লাগে, সেটা নিয়ে যতটুকু জানতাম মনে হতো এ রকম স্বপ্ন দেখা ঔদ্ধত্য। তবু সাহস নিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করি এবং সেখানে পড়ার সুযোগ পেয়ে যাই।
গবেষণার প্রতি আগ্রহ থেকেই অক্সফোর্ড
মেডিকেলে পড়ার সময় ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো দূরবর্তী পরিকল্পনা আমার মধ্যে ছিল না। মেডিকেল ইন্টার্নশিপের সময় কয়েকজন সিনিয়রের গণস্বাস্থ্যের বিভিন্ন প্রজেক্টে এবং স্বাস্থ্য গবেষণায় কাজ করতে দেখে অনুপ্রেরণা পাই। গণস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার জন্য আমার মূল আকর্ষণ তৈরি হয় যখন মেডিকেল ইন্টার্নশিপের শেষে কক্সবাজার রিফিউজি ক্যাম্পে কাজ করার সুযোগ পাই।
এরপর গবেষণার ওপর আইসিডিডিআরবিতে কোর্স ও ইন্টার্নশিপও করি। সেখান থেকেই মূলত গবেষণার প্রতি আগ্রহ অনেক গুণে বাড়তে থাকে। কয়েক মাস পর আমি আইসিডিডিআরবিতে রিসার্চ ফেলো হিসেবে যোগদান করি। এখানেই আমার গবেষণায় হাতেখড়ি বলা যায়। ২০১৯ সালের গণস্বাস্থ্য বিষয়ে বিভিন্ন মাস্টার্স কোর্সে আবেদন করা শুরু করি। তখনো আমি অক্সফোর্ডে আবেদনের চিন্তা করিনি। ২০২০ সালে আমি নেদারল্যান্ডস সরকারের স্কলারশিপে সে দেশের রয়্যাল ট্রপিক্যাল ইনস্টিটিউটে গণস্বাস্থ্য বিষয়ে মাস্টার্স করার সুযোগ পাই। সেখানে আমি ডিস্টিংকশনসহ পাস করি। এরপর নেদারল্যান্ডসে আমার ইউনিভার্সিটি ও আন্তর্জাতিক অর্গানাইজেশনের সঙ্গে কনসালট্যান্ট হিসেবে বিভিন্ন রিসার্চ প্রজেক্টে কাজ করি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অন্যদের সঙ্গে কাজ করে, ভালো ফলাফল করে যখন ভালো ফিডব্যাক এবং উৎসাহ পাচ্ছিলাম, তখনই মূলত নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গেল। শেষ পর্যন্ত অ্যাপ্লিকেশন ডেডলাইনের মাত্র ১২ দিন আগে অক্সফোর্ডে আমার বর্তমান সুপারভাইজরকে প্রথম ই-মেইল করার সাহস পাই। ইন্টারভিউয়ের ৭ দিন পর একসঙ্গে ই-মেইলে অ্যাডমিশন অফার লেটার এবং স্কলারশিপ লেটার এল। তখন সত্যি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না; বরং এখন পর্যন্ত এটা স্বপ্নের মতোই মনে হয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার গবেষণার বিষয় গণস্বাস্থ্য। মূলত স্মৃতিশক্তি হারানো কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় এবং এর সঙ্গে বিষণ্নতার কোনো সম্পর্ক আছে কি না, এটা প্রাথমিকভাবে অনুসন্ধান করব। মানসিক স্বাস্থ্য এবং নিউরোডিজেনেরেটিভ ডিসঅর্ডারের একটি সম্মেলন আমার গবেষণার বিষয়। অনেক আগে থেকে এ বিষয় নিয়ে গবেষণার ইচ্ছা ছিল এবং নিজেকে অসম্ভব ভাগ্যবান মনে করি যে অক্সফোর্ডের মতো জায়গায় গবেষণার সুযোগ পেয়েছি। আমি এটাকে অনেক বড় সুযোগ হিসেবে দেখি এবং ভবিষ্যতে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ প্রায়োগিক ভূমিকা রাখার চেষ্টা করব।
স্বপ্নের পথে অটল থাকুন
আমার জার্নি থেকে এটাই আমার শিক্ষা যে আপনি যেখানেই জন্ম নিন, যে পরিবেশেই বড় হোন, আশপাশের লোকজন যা-ই বলুক, আপনি বড় স্বপ্ন দেখুন এবং সেই স্বপ্নের পথে অটল থাকুন। বাংলাদেশে অনেক মেধাবী এবং যোগ্যতাসম্পন্ন ছাত্রছাত্রী এবং প্রফেশনালস আছে। কিন্তু আত্মবিশ্বাসের অভাবে অনেকেই তাদের কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনই করছে না। অবশ্যই আবেদনের জন্য কিছু যোগ্যতা প্রয়োজন, নিজেকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে জানতে হবে, কিন্তু প্রথমেই আত্মবিশ্বাস থাকাটা জরুরি। এখন তো ইন্টারনেট সবার হাতের মুঠোয়। আপনি যে কোর্সে আবেদন করতে চান, ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে গিয়ে খুব ভালোভাবে সেই কোর্সের বিজ্ঞপ্তিটি পড়ুন। অনেক ইউটিউব-ফেসবুক চ্যানেলও রয়েছে যেখানে শিক্ষার্থী, প্রফেশনালরা, যাঁরা ইতিমধ্যে সাফল্য অর্জন করেছেন তাঁদের সেই অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন। যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ রিসোর্স। সব রিসোর্স কাজে লাগান।
পরিচয়/সোহেল