নিউইয়র্ক     শনিবার, ৩রা জুন, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ  | ২০শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

ভারতে স্কুল বই থেকে মুছে যাচ্ছে মুঘলদের ইতিহাস

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২৩ | ০১:৩৯ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০২৩ | ০১:৩৯ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
ভারতে স্কুল বই থেকে মুছে যাচ্ছে মুঘলদের ইতিহাস

ভারতে স্কুল বই থেকে মুছে যাচ্ছে মুঘলদের ইতিহাসভারতে ইতিহাস বই থেকে মুসলিম রাজবংশ মুঘলদের ইতিহাস সম্বলিত অধ্যায়টি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে

ভারতের দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বই থেকে মুসলিম রাজবংশ মুঘলদের ইতিহাস সম্বলিত অধ্যায়টি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরও কয়েকটি বদল ঘটানো হয়েছে পাঠ্যবইতে, যা নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। কেন্দ্রীয় সংস্থা জাতীয় শিক্ষা গবেষণা ও শিক্ষণ কাউন্সিল বা এনসিইআরটি সারা দেশের স্কুলগুলোর জন্য পাঠ্যবই প্রকাশ করে। এ বছরের জন্য তারা দ্বাদশ শ্রেণীর জন্য যে বইটি প্রকাশ করেছে, সেই ‘থিমস অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’ তিনটি ভাগে ছাপা হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগের নবম অধ্যায়তেই ছিল রাজা এবং ইতিহাস, মুঘল দরবার অংশটি।

এনসিইআরটির ওয়েবসাইটে নতুন ইতিহাস বইটি ডাউনলোড করার জন্য যে লিঙ্ক আছে, সেখানে মুঘল শাসকদের নিয়ে ২৮ পাতার যে অধ্যায়টি ছিল, তা এখন আর নেই। মুসলমান শাসকদের ইতিহাস পাঠ্যক্রম থেকে সরিয়ে দেওয়ার এই প্রচেষ্টাকে ভারতের ইতিহাস থেকে মুঘলদের মুছে ফেলার চেষ্টা বলেই মনে করা হচ্ছে।


এনসিইআরটির যে পাঠ্যবই থেকে সরানো হয়েছে মুঘল ইতিহাস

তবে এনসিইআরটি যুক্তি দিয়েছে যে ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর থেকে ‘পাঠ্যক্রমের বোঝা কম’ করতেই এই অধ্যায়টি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে বইটিতে এখনও কিছু অধ্যায়ের মধ্যে মুঘলদের উল্লেখ রয়েছে।

পঞ্চম অধ্যায়তে যেমন দশম থেকে সপ্তদশ শতকের ভারতের কথা বলা হয়েছে, আর ষষ্ঠ অধ্যায়তে ভক্তি এবং সুফি পরম্পরা আলোচনা করার সময়েও মুঘল আমলের প্রসঙ্গ আছে। অষ্টম অধ্যায়তে কৃষক, জমিদার ও মুঘল সাম্রাজ্য নিয়ে লেখা হয়েছে।

পাঠ্যবইতে বদলের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন এনসিইআরটি প্রধান দিনেশ সাকলানী

পাঠ্যবই বদল হলো কেন ?

পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তনের পক্ষে বলতে গিয়ে এনসিইআরটির প্রধান দিনেশ সাকলানী সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “মুঘলদের ইতিহাস বাদ দিয়ে দেওয়া হয়নি, ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর থেকে পাঠ্যক্রমের বোঝা কিছুটা কমানো হয়েছে।“

তার কথায়, “আমরা গত বছরই বলেছিলাম যে করোনা মহামারির কারণে ছাত্র-ছাত্রীদের অনেক ক্ষতি হয়েছে, তাদের ওপরে চাপ বেড়েছে। পাঠ্যক্রমের বোঝা তাই কিছুটা কম করা হলো। আর এটা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী করা হয়েছে।“

পাঠ্যবইতে পরিবর্তন শুধু যে ইতিহাসের বইতেই করা হয়েছে, তা নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বই থেকেও বেশ কিছু অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে, যেখানে হিন্দুত্ববাদীদের প্রতি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর নেতিবাচক মনোভাব প্রসঙ্গে লেখা ছিল। গান্ধীর হত্যার পরে যে আরএসএসকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল, সেই অংশটাও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।


নবম অধ্যায়টি নতুন বইতে আর নেই

রাজনীতির অঙ্গনে বিজেপি এবং আরএসএস জওহরলাল নেহরু-ইন্দিরা গান্ধী পরিবারের বিপরীতে বল্লভভাই প্যাটেলকে তুলে ধরতে চায়। গুজরাটে বিশ্বের সবথেকে উঁচু যে মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেটাও বল্লভভাই প্যাটেলের। আবার একাদশ শ্রেণীর সমাজবিজ্ঞানের বই থেকে ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার প্রসঙ্গে দু’টি অধ্যায়ও বাদ দেওয়া হয়েছে।

পাঠ্যবই নিয়ে বিতর্ক

বিজেপিবিরোধী রাজ্যগুলো এনসিইআরটির পাঠ্য বইতে এসব পরিবর্তনের বিরোধিতা করছে, আবার উত্তরপ্রদেশের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলো বলছে যে তারা নতুন বই পড়াবে। এনসিইআরটির সাবেক চেয়ারম্যান জেএস রাজপুত বিজেপি ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।

তিনি বলছিলেন, “এনসিইআরটি একটা বড় প্রতিষ্ঠান। সেখানে বিশেষজ্ঞরা আছেন। তারা যখন কোনো পরিবর্তন করেন, সেগুলো অ্যাকাডেমিকই হয়। ইতিহাসের বইতে যদি কোথাও কেউ নিজস্ব ভাবনা আর তত্ত্ব যোগ করে থাকেন, সেগুলো সরিয়ে দেওয়াই উচিত। কিন্তু মুঘল আমলের ইতিহাস পুরোপুরি সরিয়ে দেওয়া যায় না।”

জেএস রাজপুত বলেন, “কিন্তু আমারও এটা মনে হতো যে মুঘল আমলের ইতিহাস খুব বেশি করে পড়ানো হচ্ছে। যেন শুধু মুঘল আমলেই ভারতবর্ষের অস্তিত্ব ছিল! আবার ইতিহাসের কোনো একটা সময়ের কিছু অংশ বাদ দিয়ে পড়ানোটাও অনুচিত।”

‘ইতিহাসের প্রতি সুবিচার হলো না’

একটা সময়ে এনসিইআরটির দ্বাদশ শ্রেণীর বই মুঘল আমলের ইতিহাসের জন্য স্নাতক স্তরের ছাত্র-ছাত্রীদেরও পড়তে পরামর্শ দিতেন অধ্যাপকরা। পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার উত্তরপাড়া প্যারিমোহন কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রধান, সহযোগী অধ্যাপক শর্মিষ্ঠা নাথ বলছিলেন, “আমি যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হই স্নাতক শ্রেণীতে, এক বিখ্যাত অধ্যাপক বলেছিলেন যে মুঘল আমলের ইতিহাসের ভিত তৈরি করতে হলে এনসিইআরটির পাঠ্যবই পড়বে তোমরা। এতটাই সমৃদ্ধ ছিল বইটা।“

বিএ ক্লাসের ছাত্রী হয়েও দ্বাদশ শ্রেণীর এনসিইআরটির পাঠ্য বই পড়েই শর্মিষ্ঠা নাথের ‘মুঘল আমলের ইতিহাস নিয়ে ভিতটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল’। “এখন মুঘল আমলের ইতিহাস বাদ দিয়ে দেওয়ায় ইতিহাসের প্রতি সুবিচার করা হলো না। মুঘল আমল না পড়লে ছাত্র-ছাত্রীরা ইতিহাসের ধারাবাহিকতা কী করে বুঝবে?”


‘মুঘল আমল না পড়লে ছাত্রছাত্রীরা ইতিহাসের ধারাবাহিকতা কী করে বুঝবে?

অধ্যাপক শর্মিষ্ঠা নাথ বলেন, “বরঞ্চ যেটা করা যেতে পারত, মুঘল আমল সম্বন্ধে নতুন তথ্য, নতুন গবেষণার ভিত্তিতে যা পাওয়া গেছে, যেমন সম্রাট আকবরকে শুধুই ‘দ্যা গ্রেট’ বলে না দেখিয়ে তার নেতিবাচক দিকগুলোও তুলে ধরা, বা অন্যান্য মুঘল সম্রাটদের সমালোচনামূলক দিকগুলো তুলে ধরা – এটা করাই যেত।”

কাল্পনিক ইতিহাস তৈরির চেষ্টা

ঐতিহাসিকরা বলছেন, ইতিহাস তো ইতিহাসই, কেউ চাইলেই তো আর সেটা মুছে ফেলা যায় না। তবে নতুন করে কোনো গবেষণালব্ধ তথ্য পেলে নিশ্চয়ই ইতিহাসকে নতুনভাবে দেখার সুযোগ আছে, সেটা করাও হয়।

ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেসের সচিব অধ্যাপক সৈয়দ আলি নাদিম রিজভি বলেন, “ইতিহাসের পাঠ্যবইতে পরিবর্তন কোনো নতুন ঘটনা নয়, এটা হতেই থাকে। কিন্তু সেই সব পরিবর্তন হওয়া উচিত নতুন কোনো তথ্য, নতুন গবেষণার ভিত্তিতে। এর আগে অটল বিহারী বাজপেয়ীর সরকারের সময়েও ইতিহাস বইতে বদল আনার চেষ্টা হয়েছিল। সেইসব পরিবর্তনগুলো তথ্য আর গবেষণার ভিত্তিতে করা হয়েছিল।’

তিনি বলেন, কিন্তু এখন তো একটা কাল্পনিক ইতিহাস তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে।

এনসিইআরটির ইতিহাস আর সমাজবিজ্ঞানের বইতে পরিবর্তনগুলো নিয়ে অভিযোগ উঠছে যে একটি নির্দিষ্ট চিন্তাধারার ওপরে ভিত্তি করেই এই বদলগুলো করা হয়েছে। সেই ভাবধারা হলো হিন্দুত্ববাদ এবং উগ্র জাতীয়তাবাদ আর মুসলিমবিরোধিতা।

ওই একই চিন্তাধারার ওপরে ভিত্তি করেই বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে রাস্তা, স্টেশন, জেলা বা শহরের নাম পরিবর্তন করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে উত্তরপ্রদেশে। ভারতীয় রেলপথের অতি গুরুত্বপূর্ণ মোগলসরাই স্টেশনের নাম পাল্টিয়ে রাখা হয়েছে পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় স্টেশন, এলাহাবাদ শহরের নাম হয়েছে প্রয়াগরাজ।

বেশ কয়েক বছর আগেই মহারাষ্ট্রের স্কুলপাঠ্য বই থেকে মুঘল আমলকে সরিয়ে ছত্রপতি শিবাজীর ইতিহাস নিয়ে আসা হয়েছে। বিজেপি শাসিত কর্ণাটক রাজ্যেও টিপু সুলতানের ইতিহাস মুছে ফেলার একাধিকবার চেষ্টা হয়েছে।

বিতর্ক যে শুধু ইতিহাসের পাঠ্যবই নিয়ে হচ্ছে, তা নয়। সমাজবিজ্ঞানের বই থেকে গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসের আরএসএস ঘনিষ্ঠতার পরিচয় সরিয়ে দেওয়া নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে। মুসলমান আমল নিয়ে একাধিক ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাস লিখেছেন কলকাতার প্রাবন্ধিক রন্তিদেব সেনগুপ্ত।


গুজরাট দাঙ্গার প্রসঙ্গ বাদ দেওয়া হয়েছে একাদশ শ্রেণীর বই থেকে

তিনি বলছিলেন, “মুঘল আমল বা মুসলমান শাসকদের আমল তো ভারতের ইতিহাসেরই অঙ্গ। তাদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে ভারতের শিল্প, সংস্কৃতিতে। আর বর্তমানে আমরা যে জেলাওয়াড়ী প্রশাসনিক ব্যবস্থায় চলি, সেটাও তো মুঘলদেরই অবদান। সেসব অস্বীকার করব কী করে?

তিনি বলেন, ‘আবার গান্ধী হত্যাকারীর আরএসএস সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করব পাঠ্যবইতে, কিন্তু সবরমতী আশ্রমে গিয়ে চরকা কাটার ছবি তুলবেন প্রধানমন্ত্রী, এ তো দ্বিচারিতা।’

এনসিইআরটির ইতিহাস বইতে পরিবর্তনের কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছেন ভারতের প্রায় ২৫০ জন নামকরা ইতিহাসবিদ ও শিক্ষাবিদ। শনিবার এক বিবৃতি জারি করে ইরফান হাবিব, আদিত্য মুখার্জী, অপূর্বানন্দ, জয়তী ঘোষের মতো শিক্ষাবিদ ও ঐতিহাসিকরা বলছেন, পাঠ্যবইতে এসব পরিবর্তন বিভেদকামী রাজনীতিকে উৎসাহ দেবে। সূত্র : বিবিসি

শেয়ার করুন