ড. হোসেন জিল্লুর রহমান অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের চেয়ারপারসন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ, আগামী নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট অচলাবস্থা, ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ সাম্প্রতিক আলোচিত নানা বিষয়ে দৈনিক কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা।
প্রশ্ন: দেশের বর্তমান রাজনীতিকে কীভাবে দেখছেন? চলমান প্রেক্ষাপটে জনগণ কোথায় যাবে?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: গণতন্ত্রের স্বার্থেই বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতির সুষ্ঠু সমাধান প্রয়োজন। এমনকি অর্থনৈতিক কারণেও এর সমাধান প্রয়োজন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এক ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। একটি ঝুঁকি হলো সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা। ধারাবাহিকভাবে সুশাসনের ঘাটতির ফলে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য এবং আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় পৌঁছেছে। এর সঙ্গে সরকারে উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং বেহিসাবি ব্যয়ের সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেছে। বৈশ্বিক মানদণ্ডে আমাদের প্রকল্প ব্যয় অত্যধিক বেশি এবং এসব প্রকল্পে প্রচুর দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে রাজনীতির সমাধান কী হবে সেটা জনগণেরই নির্ধারণ করা উচিত। কেননা রাজনীতিতে সবসময় জনগণের সম্পৃক্ততা থাকে। আরও ভালোভাবে বলতে গেলে জনগণের জন্যই রাজনীতি।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা কেমন দেখছেন?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: অর্থনীতির কয়েকটি অবস্থা আছে। যেমন সামষ্টিক অর্থনীতি, মধ্যম অর্থনীতি এবং ব্যক্তি অর্থনীতি। সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে, বিশেষ করে আর্থিক খাত খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে, পরিসংখ্যানগুলোই তা বলছে। টাকার মান কমে গেছে, ডলার সংকট তৈরি হয়েছে, আমদানিও কমিয়ে দিতে হয়েছে। আমাদের প্রবৃদ্ধি এখন প্রশ্নের মধ্যে পড়ে গেছে, রিজার্ভ কমে গেছে এবং ঋণ পরিশোধের বোঝাগুলো আরও ভারী হয়ে উঠছে। মধ্যম অর্থনীতির পর্যায়ে, শিক্ষিত তরুণদের বেকারত্ব বিশাল আকার ধারণ করেছে। কর্মসংস্থানের দিকে তাকালে খুবই ধাঁধার মতো লাগে। ২০১৬ ও ২০২২ সালের শ্রম জরিপে দেখা যাচ্ছে, এ সময়কালে শিল্প ও সেবা খাতে কর্মসংস্থান কমে গেছে। বেড়েছে কৃষি খাতে। প্রবৃদ্ধির বিষয়টি আসলে কী হচ্ছে, কোথায় হচ্ছে—এর ব্যাখ্যা আমাদের খুঁজতে হবে। এখানে ব্যবসায় মন্দাভাব দেখা দিয়েছে, বেসরকারি বিনিয়োগ কমে গেছে। আবার অনেক প্রবৃদ্ধিও হয়েছে; কিন্তু এর ফসল কার ঘরে গেছে? সব মিলিয়ে বাংলাদেশ বড় ধরনের একটি অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। গোষ্ঠীস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে যে মডেলে দেশের অর্থনীতি পরিচালিত হচ্ছে তার পরিবর্তন প্রয়োজন।
আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় প্রবৃদ্ধি স্থবির হয়ে পড়ছে। কর্মসংস্থানেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সামষ্টিক অর্থনীতির বিপর্যয় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ঝুঁকির একটি নিদর্শন। সাধারণ মানুষ দৈনন্দিন জীবনমানে এক ধরনের ভয়াবহ সংকটের মধ্যে রয়েছে। একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অন্যদিকে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে। অর্থনীতিতে কর্মসংস্থানের জায়গাও অত্যন্ত দুর্বল। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে জর্জরিত সাধারণ মানুষ। ফলে আমাদের দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্যমাত্রা, পুষ্টির লক্ষ্যমাত্রা, শিক্ষার লক্ষ্যমাত্রাসহ এসডিজির অনেক সূচকে আমরা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছি। খাদ্যকে প্রাধান্য দেওয়ায় মানুষকে অন্য চাহিদা বাদ দিতে হচ্ছে। খাদ্যের মধ্যে আমিষকে বাদ দিতে হচ্ছে।
রাজনৈতিক আলোচনা হচ্ছে এবং এটা জরুরিও বটে। তবে এর চেয়েও জরুরি বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। সামষ্টিক এবং ব্যক্তি—উভয় পর্যায়েই নিরাপত্তা প্রয়োজন। অর্থনীতির ঝুঁকি তৈরির কারণ খুঁজতে গেলে শুধু অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। এখানে রাজনৈতিক আলোচনা চলে আসবে এবং সেটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। আর্থিক খাত বিশৃঙ্খলার মধ্যে রয়েছে বলেই সামষ্টিক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। আর্থিক খাত বিশৃঙ্খলার মধ্যে রয়েছে তার কারণ—সুশাসনের ঘাটতি। সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক নীতি পরিচালনার ওপর কিছু গোষ্ঠীস্বার্থ সিকান্দারের ভূতের মতো চেপে বসে আছে। সুতরাং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ঝুঁকির একটি অন্যতম কারণ হিসেবে সামনে চলে এসেছে।
প্রশ্ন: বড় প্রকল্প উদ্বোধন করা হচ্ছে। এগুলোর ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আপনার মন্তব্য কী?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: নীতি প্রণয়নই করা হচ্ছে দুর্নীতির স্বার্থে। যেমন ব্যাংকের জন্য আইনগুলো করা হচ্ছে গোষ্ঠীস্বার্থকে প্রাধান্য দিতে। আরেকটি হচ্ছে আমাদের দেশে অবকাঠামোর প্রয়োজন আছে, এটি অনস্বীকার্য; কিন্তু একটি প্রবণতা গত এক দশকে বিশেষ করে দেখা যাচ্ছে এবং তা হচ্ছে মেগা প্রজেক্ট বা অবকাঠামো নিয়ে বেহিসাবি ও উচ্চমাত্রার পাবলিক ব্যয়। এই ব্যয় ঋণনির্ভর এবং সুদের হারও উচ্চ। বড় ধরনের দুর্নীতির ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে এ ধরনের প্রকল্প। বহু অবকাঠামো আছে, যেগুলোর ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করে প্রকল্প নির্বাচন ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যার একটি উদাহরণ হতে পারে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন। সম্ভাব্যতা যাচাই ও মনিটরিংয়ের নামে বেহিসাবি অর্থ খরচ করা হয়েছে। কোন প্রকল্প অগ্রাধিকার দিতে হবে, তা মানা হয়নি। আগে আমরা দুর্নীতি বলতে বুঝতাম কিছু টাকা সরিয়ে রাখা। এখন নীতি প্রণয়নই করা হচ্ছে দুর্নীতির উদ্দেশ্যে।
প্রকল্প গ্রহণে তাড়াহুড়ার মানসিকতাও দেখা যাচ্ছে। যার ফলে সম্ভাব্যতা যাচাই, প্রকল্পের মান যাচাই ও সুষ্ঠু বাস্তবায়ন পরিকল্পনা ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। এটি সামষ্টিক অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। ঋণের বোঝা অব্যাহতভাবে বাড়ছে এবং ঋণ পরিশোধের সময় এগিয়ে আসছে। সামষ্টিক অর্থনীতি যে ঝুঁকির মধ্যে আছে, তা ডলারের মূল্যমানসহ বিভিন্ন সূচকে স্পষ্ট।
এখন বিশ্বে দ্রুত ঋণ পাওয়ার অনেক সহজ উৎসও তৈরি হয়ে গেছে, যারা ঋণ দিচ্ছে সেই টাকা দিয়ে কী করা হচ্ছে, তা নিয়ে তারা চিন্তিত নয়। ফলে ১০ টাকার প্রকল্প এক হাজার টাকায় করা হচ্ছে। এখানে নিশ্চয়ই ভাগ-বাটোয়ারার বিষয় আছে; কিন্তু এই ঋণের টাকা তো ভবিষ্যতে আমাদের শোধ করতে হবে। আরেকটি বিষয়, প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কাদের নির্বাচন করা হচ্ছে? আমরা ভেবেছিলাম ই-টেন্ডারের মাধ্যমে একটি বড় পরিবর্তন আসবে; কিন্তু ঘুরেফিরে তো কিছু নামই আসছে। এখানেও গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষা করা হচ্ছে।
প্রশ্ন: একদিকে উন্নয়ন হচ্ছে, অন্যদিকে বৈষম্য বাড়ছে। কভিড-পরবর্তী নতুন দারিদ্র্য আজ একটি বাস্তবতা বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে মানুষ কষ্টে আছে বলেও গবেষণা উঠে এসেছে। এসবের পেছনে কারণ কী?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: একটা সময় মূল্যস্ফীতির একটি ব্যাখ্যা ছিল বিশ্ব অর্থনীতির দোলাচলে। কিন্তু সেই ব্যাখ্যাটা এখন আর কাজ করছে না। শ্রীলঙ্কাসহ যত দেশ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছিল তারাও মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে এনেছে। কিন্তু বাংলাদেশে সেটা হচ্ছে না। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। কারণ গোষ্ঠীস্বার্থ। সামষ্টিক অর্থনৈতিক ঝুঁকি এবং ব্যক্তি অর্থনীতির ঝুঁকি দুটিই নিয়ন্ত্রণে আসছে না শুধু রাজনৈতিক কারণে। আর এর অন্যতম কারণ রাজনৈতিক ইচ্ছার অনুপস্থিতি। গোষ্ঠীস্বার্থ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই মুহূর্তে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
দারিদ্র্যের পরিসংখ্যান, প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান, মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যানসহ প্রতিটি পরিসংখ্যানই অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ঝুঁকিকেই প্রকাশ করছে। কিন্তু এই সংকটকে রঙিন চশমা দিয়ে দেখা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বে যারা রয়েছেন, যারা নীতি পরিচালনা করছেন এবং দেশ চালাচ্ছেন তারা সবাই এক ধরনের রঙিন চশমা পড়ে বসে আছেন। উন্নয়ন ছাড়া আর কিছুই তাদের চোখে পড়ছে না। তারা ঢাকা শহরে ভিখারিও দেখতে পান না। অথচ রাস্তাঘাটে হাঁটলেই চারপাশে নতুন দরিদ্রের উপস্থিতি দেখা যায়। এসব সমস্যা সমাধানে নীতি উদ্যোগ নেই। অন্যান্য অনেক দেশও অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়েছিল। সঠিক নীতি এবং উদ্যোগ গ্রহণ করে তারা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছে। তারা সংকট কাটিয়েও উঠেছে। বাংলাদেশে সমাধানের কথা বলা হচ্ছে আরও বেশি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে এবং আরও বেশি ঋণ নিয়ে। তাদের মধ্যে সমস্যাকে স্বীকার করার কোনো মনোভাব নেই। ক্ষমতাসীনদের রঙিন চশমা এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতা—দুটি মিলে দুটি ভিন্নজগৎ তৈরি হয়েছে।
এ মুহূর্তে রাজনৈতিক নবায়ন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। ক্ষমতাসীনরা চোখে রঙিন চশমা লাগিয়ে এখন যেভাবে অর্থনীতিকে পরিচালনা করছেন এবং এটিই যদি অব্যাহত রাখার মানসিকতা থাকে তবে সেটা চরমভাবে মানুষের স্বার্থকে হরণ করবে। এই মানসিকতা নিয়ে যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সমাধানের উদ্যোগ জনস্বার্থ বিরুদ্ধ হবে। ব্যক্তি এবং সামষ্টিক অর্থনীতিতে নিরাপত্তার যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে তার রাজনৈতিক সমাধান জরুরি হয়ে পড়েছে। এই সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে, শাসকদের বাস্তবতাকে স্বীকার করতে হবে। রাজনৈতিকভাবে এখন যে অর্থনীতি পরিচালিত হচ্ছে তাতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে রাজনৈতিক নবায়ন জরুরি।
প্রতিষ্ঠান ও ফোরামগুলোর শানশওকত বাড়ছে। কিন্তু নীতি পরিচালনায় তারা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। অর্থনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছার অনুপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। কারণ, কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন ও গোষ্ঠীস্বার্থ অনেকটা একাকার হয়ে যাচ্ছে। সার্বিকভাবে এই শাসনের যারা প্রতিভূ, তারা সবাই এক ধরনের রঙিন চশমা পরে বসে আছে। এই রঙিন চশমায় তারা একটা অন্য জগৎ দেখছে। সারা বাংলাদেশের মানুষ একটি বাস্তবতা দেখছে আর রঙিন চশমা পরা কর্তৃত্বপরায়ণ শাসকগোষ্ঠী অন্য আরেকটা বাস্তবতা দেখছে, যেখানে সবকিছু ভালো, সেখানে কোনো ভিক্ষুক নেই, কারও কোনো সমস্যা নেই, শহরগুলো বিশ্বের অন্যান্য উন্নত শহরের সঙ্গে তুলনীয় হয়ে উঠছে।
প্রশ্ন: স্বাধীনতার ৫১ বছর পার হয়েছে। এখনো আমরা গণতন্ত্রের সংকট কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সংকট থেকে উত্তরণের পথ কী হতে পারে?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: গণতন্ত্রের সংকট কাটিয়ে উঠতে তিনটি বিষয় জরুরি। প্রথমটি হলো, প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি নিশ্চিত করা। প্রত্যেকে প্রত্যেককে সুযোগ দেবে সেই আনুষ্ঠানিক গ্যারান্টি থাকতে হবে। ক্ষমতাসীন হলেই তাদের মধ্যে ভিন্নমতের প্রতি এক ধরনের চরম অসহিষ্ণু মনোভাব দেখা যায়। প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি এবং মানুষের ভোট দেওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, দেশের অর্থনীতিকে দক্ষভাবে পরিচালনা করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং রাজনীতি একে অন্যের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। এবং তৃতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক গ্যারান্টি তৈরি করতে হবে। মানুষের ভোটের অধিকার যে নেই তার অনেক উদাহরণ আমরা দেখেছি। ভোটের অধিকার হরণের ফলে কী হয়েছে সেটাও আমরা দেখেছি। ভোট দেওয়ার শতকরা হার নিচে নামতে নামতে এখন সেটা সিঙ্গেল ডিজিটে চলে এসেছে। ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন এবং চট্টগ্রামের উপনির্বাচনে আমরা সেটা দেখেছি।
আজকের পৃথিবীতে গায়ের জোরে ক্ষমতায় থাকাটা গ্রহণযোগ্য নয়। এতে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উভয় রকমের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বের একটি সহানুভূতি রয়েছে। নানা ধরনের দুর্যোগ অতিক্রম করে বাংলাদেশের মানুষ এগিয়েছে। এটা একটি বহুমাত্রিক অর্জন। আর এখানে সবথেকে বেশি কৃতিত্বের দাবিদার দেশের সাধারণ মানুষ। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বের সেই সহানুভূতির জায়গায় পরিবর্তন আসছে। তবে সাধারণ মানুষের ওপর তাদের সহানুভূতি এখনো আছে। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে তারা বিরক্ত। বিদেশিরা চায় বাংলাদেশ রাজনৈতিক নবায়নের মাধ্যমে নিজের ধারায় ফিরে আসুক। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত না করে গায়ের জোরে ক্ষমতায় থেকে এক ধরনের মনগড়া ব্যাখ্যা দেওয়ার মাধ্যমে দেশ এগোতে পারে না। এটা কারও কাছে গ্রহণযোগ্যও নয়। যারা এসব করছেন তাদের কাছে প্রশ্ন করা দরকার—তারা কী বিশ্বদরবারে এভাবেই চিহ্নিত হতে চান?
দেশের রাজনীতিকে ধ্বংস করার ফল আমরা বিভিন্নভাবে দেখতে পাচ্ছি। তরুণরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মেধাগুলো বাইরে চলে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বিদেশে অর্থ পাচার করছে। এভাবে আমরা এগোবো কী করে? বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ হিসেবে আমি বলব, বাংলাদেশ এরই মধ্যে ব্যক্তি ও সামষ্টিক উভয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। আর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ঝুঁকির অন্যতম কারণ রাজনীতি। রাজনৈতিক নবায়ন ছাড়া এর কোনো সমাধান নেই। এই সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে প্রতিযোগীদের কৌশলের বিষয় রয়েছে, সমস্যাটা ক্ষমতাসীনদের উপলব্ধি করার বিষয়। ক্ষমতাসীনদের মধ্যেও যাদের শুভবুদ্ধি আছে তাদের সময় এসেছে গোষ্ঠীস্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে জনস্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার সাহস দেখানোর। সুতরাং সমাধানটা টেবিলে বসে দেওয়া সম্ভব নয়। আমরা শুধু বলতে পারি, সমাধান হতেই হবে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকাকে আপনি কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ এশিয়া এবং ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চল ভূ-রাজনৈতিকভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গন সরব হওয়ার পেছনে ভূ-রাজনৈতিক একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। এ ছাড়া বেশ কিছু গণতান্ত্রিক দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন এসেছে। এই প্রবণতার বিরুদ্ধেও গণতান্ত্রিক দেশগুলো সরব হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহল তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলাদেশকে দেখছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের উদ্বেগের বিষয়গুলো নিয়ে বাংলাদেশের মানুষও চিন্তিত। এমনকি বাংলাদেশের মানুষের জন্য এটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেই অর্থে বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের কথাবার্তা ক্ষমতাসীনদের ওপরে চাপের উপলব্ধি নিয়ে আসবে এবং সেটা বাংলাদেশের মানুষের জন্য দরকার।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করে যে পরিস্থিতির তৈরি করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষই সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। সেটির পাশাপাশি বিশ্বও সোচ্চার হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিশ্ব জানে বাংলাদেশের যতটুকু অগ্রগতি ঘটেছে তা প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক পরিবেশের উপস্থিতির ফলেই ঘটেছে। তাই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এবং রাষ্ট্রের বাইরের ব্যক্তিরা যাতে নিয়ন্ত্রণমুক্ত পরিবেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন সেজন্য আন্তর্জাতিক মহল সোচ্চার হচ্ছে। আমি মনে করি, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হোক সেটা বিশ্ব চায় না। এজন্য তারা বাংলাদেশের ব্যাপারে সোচ্চার হচ্ছে। বিশ্ব চায় বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক ও প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি চর্চা করে এগিয়ে যাক। অর্থনীতি এবং সমাজ পরিবর্তনে সাধারণ মানুষ ও সামাজিক সংগঠনদের অধিকার যাতে অব্যাহত থাকে সেই মানসিকতাও কাজ করছে আন্তর্জাতিক মহলে।
বাংলাদেশের মানুষের চাহিদাকে সমর্থন করে যারা বাংলাদেশের ব্যাপারে কথা বলবে সেটা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষকে অস্বীকার করে কোনো ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর চাহিদাকে প্রাধান্য দেবে এবং তাদের সমর্থন করবে তারা কখনোই বাংলাদেশের বন্ধু হতে পারে না। কোনো রাষ্ট্র এতটা কাঁচা কাজ করবে বলে আমার মনে হয় না যে, তারা বাংলাদেশের মানুষের সার্বিক চাহিদাকে পদদলিত করে একটি গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়ে যাবে।
ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার একটি আমেজ আছে এটা ঠিক। কিন্তু সবকিছুর ওপর বাংলাদেশের মানুষের চাওয়াটাই বড়। বাংলাদেশের মানুষের চাহিদাই বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার অন্যতম নিয়ামক। কোনো ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাদের চাহিদা পূরণের জন্য কিছু করার চেষ্টা গ্রহণযোগ্য নয়। এটা একেবারে সাদা-কালো বিষয়ের মতো। অনেক সময় সাদা-কালো বিষয়টা নিয়ে কথা বলা জরুরি হয়ে পড়ে।
প্রশ্ন: ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যুতে ১৭৪ জন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব বিবৃতি দিয়েছেন। এ বিষয়টা সরকারের ওপর প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন কি?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: আইনের শাসনের ঊর্ধ্বে কেউ নন, এটা সবচেয়ে বড় অবস্থান। তবে হয়রানির উদ্দেশ্যে বিচারিক কার্যক্রম বা রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনা করাও নাগরিক অধিকারের পরিপন্থি। এই দুটি বিষয়ের মধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যুটি আলোচনা করা জরুরি।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণের প্রবর্তক, যা বিশ্বের অগণিত দরিদ্র মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে এবং রাখছে। ড. ইউনূসের জন্যই বাংলাদেশের সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম ব্যাপকভাবে উপস্থিত। কিন্তু তার এই ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প নিয়ে অব্যাহতভাবে আমরা এক ধরনের বিদ্বেষীমূলক প্রচার দেখতে পাই। আর এ কারণেই তার বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়াগুলো নানা ধরনের সন্দেহের জন্ম দেয়।
বাংলাদেশের বিচারিক কার্যক্রমে এসব বিষয় খুব একটা দেখা যায় না। এক জায়গায় আমরা অনেক বেশি নজর দিচ্ছি এবং একশটা জায়গায় কোনো নজর দিচ্ছি না। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষেত্রে শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের কথা আসছে, যেটা গার্মেন্টসের ক্ষেত্রে আসছে না। তাহলে এখানে আমরা কী সিদ্ধান্ত নেব?
বিচারিক কার্যক্রম সঠিকভাবে চললে কোনো প্রশ্ন উঠবে না বরং সেটি এগিয়ে যাবে। কিন্তু আমরা দেখতে পাই ড. ইউনূসকে হয়রানির উদ্দেশ্যে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যেমন—শ্রম আদালতে যখন ড. ইউনূস গেলেন সেদিন লিফটটা বন্ধ করে দেওয়া হলো। এগুলো থেকে আমরা কীসের প্রমাণ পাই?
‘আমরা কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নই’ আধুনিক সমাজের এই প্রত্যয়ের প্রতি আমরা সবাই শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু হয়রানির উদ্দেশ্যে বিচারিক কিংবা রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম বা রাষ্ট্রীয় প্রচার পরিচালনা করা নাগরিক অধিকারের পরিপন্থি। বিভিন্নভাবে ও বিভিন্ন পদক্ষেপে প্রফেসর ইউনূসের ক্ষেত্রে এই ধারণার জন্ম দিচ্ছে। প্রফেসর ইউনূস ব্যক্তি এবং তার কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের পরিচিতিতে অন্যতম ভূমিকা রেখেছেন।
প্রশ্ন: দেশের গণতন্ত্র শক্তিশালী করতে করণীয় কী?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে হলে তিনটি জায়গায় চিন্তা করা দরকার। প্রথমত, প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের মতো দেশে প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি নিশ্চিত হলে তা জবাবদিহির বিষয়টিকে নিশ্চিত করে।
দ্বিতীয়ত, প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি এবং জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার প্রতিষ্ঠানগুলোর বহুমাত্রিক সংস্কার প্রয়োজন। শুধু আইন থাকলে হবে না। ওই প্রতিষ্ঠানগুলো যারা চালান তাদের মানসিকতার পরিবর্তনও একটি বড় বিষয়। তাদের একটি প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তারা ক্ষমতা ব্যবহার না করে জি-হুজুর নীতি বেছে নিচ্ছেন। এটাকে বলা হয় স্বেচ্ছা নিষ্ক্রিয়তা। আমরা এই স্বেচ্ছা নিষ্ক্রিয়তার সমস্যার মধ্যে আছি। এটি নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে আমলাতন্ত্র সবার জন্যই প্রযোজ্য।
তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিবর্তন। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক পরিবর্তন জরুরি। এটা একদিনের বিষয় নয়। এটা ধারাবাহিক একটি প্রক্রিয়া। গোষ্ঠীতন্ত্রকে ভেঙে ফেলতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন সুচিন্তিত এবং সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ। আর গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করাই এর পূর্বশর্ত। বাংলাদেশকে যদি এগিয়ে নিতে হয় তবে বাংলাদেশের ভেতরের সব ট্যালেন্ট এবং সক্ষমতাগুলোকে একত্র করে এগিয়ে যেতে হবে। এই ট্যালেন্ট এবং সক্ষমতাগুলোকে স্পেস দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দরকার। সেটাই হবে দেশের জন্য সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশকে এভাবেই এগোতে হবে। ভেতরের সব সক্ষমতা এবং ট্যালেন্টগুলোকে লালন করতে হবে। ট্যালেন্টগুলোকে স্বীকৃতি দিতে হবে। শ্রুতলিখন: মুজাহিদুল ইসলাম, দৈনিক কালবেলা-র সৌজন্যে