নাইজারে অভ্যুত্থানের পর থেকে একটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে অনেকের মনে – ফ্রান্স নাইজার থেকে ইউরেনিয়াম না পেলে কি ইউরোপে রাতে আর আলো জ্বলবে না? ইউরোপের জ্বালানি সরবরাহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা কী মনে করেন?
ফ্রান্স নিজেদের মোট বিদ্যুতের দুই তৃতীয়াংশ পেয়ে থাকে এমন নিউক্রিয়ার প্ল্যান্ট থেকে যেগুলো ইউরেনিয়াম ছাড়া অচল৷ সেই ইউরেনিয়ামের বড় একটা অংশ কয়েক দশক ধরে নাইজার থেকে পেয়ে আসছে ফ্রান্স ৷
গত ২৬ জুলাই নাইজারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর ইউরেনিয়াম খনিগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় জেনারেল আব্দোররাহমানে তিয়ানির সরকার ৷ ইউরেনিয়াম রপ্তানি বন্ধ ঘোষণার পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে আরো জানানো হয়, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ফরাসি কর্তৃপক্ষকে নাইজার ছাড়তে হবে৷ ফরাসি রাষ্ট্রদূত সিভলেঁ ইতে অবশ্য তারপরও রাজধানী নিয়ামে ছাড়েননি৷ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁও কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক করে ইউরেনিয়াম সরবরাহ অব্যাহত রাখার আশা ছাড়েননি ৷
কিন্তু নাইজারের পরিস্থিতি মাক্রোঁর অস্বস্তি বাড়াচ্ছে ৷ নাইজারের সাবেক জ্বালানি মন্ত্রী মাহামান লাওয়ান গায়ার দাবি, এই মুহূর্তে তার দেশের অনেক মানুষই ফ্রান্সের ওপর ভীষণ বিরক্ত, কারণ, ‘‘ নাইজারের প্রায় প্রতিটি মানুষ মনে করেন, (ফ্রান্সের সঙ্গে) আমাদের পার্টনারশিপটা খুবই অসম৷” ই-মেইলের মাধ্যমে ডয়চে ভেলেকে গায়া জানান, ২০১০ সালে নাইজার যে পরিমাণ ইউরেনিয়াম রপ্তানি করেছে তার মোট মূল্য ৩.৫ বিলিয়ন ইউরো (৩.৮ বিলিয়ন ডলার) তিন হাজার ৮০০ মিলিয়ন ডলার) হওয়ার কথা, অথচ পেয়েছে মাত্র ৪৫৯ মিলিয়ন ইউরো ৷
তাই তার মতে, ‘‘নাইজার যদি ফ্রান্সে আর ইউরেনিয়াম রপ্তানি না করার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে ফ্রান্সে হয়ত এর নাটকীয় প্রভাব পড়বে, কিন্তু নাইজারের অর্থনীতিতে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না ৷”
তিনি জানান, ফ্রান্সে ইউরেনিয়াম রপ্তানি বন্ধ হলে সাধারণ মানুষের মাঝে এর কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে না, কারণ, নাইজারের প্রায় ৯০% মানুষ এতকাল শুধু ইউরোপে বিদ্যুৎ সরবরাহে নিজের দেশের ভূমিকা দেখেছে, কিন্তু নিজেরা এখনো বিদ্যুৎ পায়নি ৷
গত কয়েক দশক ধরে ওরানো নামের একটি প্রতিষ্ঠান নাইজার থেকে প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়াম ফ্রান্সে পৌঁছে দিচ্ছে ৷
ইউরোপে কি আঁধার নামবে ?
ফ্রান্সের ৫৬টি নিউক্লিয়ার পাওয়ারপ্ল্যান্ট নাইজারের ইউরেনিয়ামের ওপর নির্ভরশীল৷ অন্যদিকে ইউরোপের বেশ কিছু দেশ ফ্রান্সের বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল ৷ নাইজারের নতুন সরকার কি এ ফ্রান্সে ইউরেনিয়াম রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেবে? নাইজারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলীয় নেতা হামা আমাদু তা মনে করেন না ৷ তার ধারণা, জেনারেল আব্দোররাহমানে তিয়ানির সরকার এখনো ফ্রান্সে ইউরেনিয়াম রপ্তানি বন্ধ করেনি এবং আগামীতেও করবে না ৷
ইউরাটোম সাপ্লাই এজেন্সির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছর নিজেদের মোট ইউরোনিয়ামের এক পঞ্চমাংশ নাইজার থেকে পেয়েছে ফ্রান্স ৷ তারপরও দেশটি সমস্যায় পড়েনি, কারণ, কাজাখস্তান এবং উজবেকিস্তান থেকেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ইউরেনিয়াম পেয়ে থাকে তারা ৷
লন্ডনভিত্তিক থিংকট্যাংক চ্যাথাম হাউসের অ্যালেক্স ভাইন্স জানান, গত বছর ফ্রান্সের তৃতীয় বৃহত্তম ইউরেনিয়াম সরবরাহকারী ছিল নাইজার ৷ ওয়ার্ল্ড নিউক্লিয়ার অ্যাসোসিয়েশন জানাচ্ছে, ২০২২ সালে সারা বিশ্বে বিক্রি হওয়া ইউরেনিয়ামের মাত্র ৫% ছিল নাইজারের ৷
প্রশ্ন হলো, যদি তাদের সাবেক কলোনি থেকে বছরের চাহিদার এক পঞ্চমাংশ ইউরেনিয়াম না পায় ফ্রান্স, যদি সেখান থেকে ওই ৫% না পায় বিশ্ব, তাহলে কি খুব বড় বিপর্যয় দেখা দেবে? বিদ্যুতের অভাবে ইউরোপে কি আঁধার নামবে?
সে আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে ইউরোপীয় কমিশনের মুখপাত্র আডালবার্ট ইয়ান্স বলেছেন, ‘‘মাঝারি ও স্বল্প মেয়াদে প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট ইউরেনিয়াম এখন বিশ্ব বাজারে রয়েছে ৷ তা দিয়ে ইউরোপের চাহিদাও মেটানো যাবে ৷” সূত্র : ডয়চে ভেলে