নিউইয়র্ক     সোমবার, ১৪ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নবডঙ্কা

এইচ বি রিতা

প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২২ | ০১:০৪ অপরাহ্ণ | আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২২ | ০১:০৭ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
নবডঙ্কা

অবিচ্ছিন্ন আলোর মাঝে শূন্যতার ছোঁয়া-নসিমনকে ঘুরে ফিরে নিজের সাথেই বিলাপ করায়। ছোটবেলার চার প্রক্রিয়া সম্পর্কিত অঙ্কের হিসাবে পরিশেষে কিছু একটা ফলাফল তুলতে পারলেও, তা একটা সময়ে জীবনের দেনা-পাওনার হিসাবে অঙ্ক কষার মতই কোন নির্দিষ্ট ফলাফল তুলে না। ঘটনা, পরিস্থিতি অনুযায়ী সেই ফলাফল হয় ভিন্ন। এবং সেই ভিন্ন ফলাফলও কারো জন্য গ্রহণযোগ্য আবার কারো জন্য গ্রহণযোগ্য হয় না।

তাই বলে কী জীবন থেমে থাকে? থাকে না।

নসিমন ভাবে, জীবন যুদ্ধের এই যে লড়াই, তাতে বিজয়ের ঘন্টা যতবারই বেজেছে, ঠিক ততবারই তার মেরুদণ্ডের ছাব্বিশটি কশেরুকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে খবর কে রাখে? মানুষ কেবল শুনে ঘন্টার ধ্বনি।

নসিমনের আজ আরো একটা অপেক্ষার দিন। অপেক্ষার বেলা শেষ হবে না জেনেও, সেই দুপুর থেকে পরিপাটি সেজে বসে আছে, আজ যে তার জন্মদিন।

নসিমনের স্মৃতিতে ভেসে চলেছে ছোটবেলার সেই ছোট্ট ছোট্ট আনন্দময় দিনগুলোর কথা। জন্মদিন এলেই ছোট একটা কেইক আনা হতো বাসায়। ভালোবেসে মা ক’টা নগদ টাকা দিতেন। বন্ধুরা নিয়ে আসতো কলম, নোটবুক, গল্পের বই। নিন্মবিত্ত পরিবারে খুব ধুমধাম করে জন্মদিন পালন করার রেওয়াজ না থাকলেও, ভালোবাসা ও স্নেহের মমতা সবটুকুই ছিল। মনে পড়ে, জন্মদিনের দিন সকাল হতেই মা খুব যত্ন করে চুলে বিনুনি করে দিতেন, সাথে প্লাস্টিকের ফুলযুক্ত ক্লিপ। বড় খালা জামা কিনে নিয়ে আসতেন, সাথে কেইক। সেগুলোই হতো তার খুশির কারণ।

নসিমনের বয়স তখন সতেরো, সবে স্কুল পাস করে বেড়িয়েছে। চোখে তখন তার রঙিন স্বপ্ন আকাশে উড়ার। কিন্তু পাখা মেলে উড়ার আগেই তাকে বন্ধী করে দেয়া হলো খাঁচায়। সেই খাঁচায় সমস্ত কিছুর মালিক হয়ে গেল কোন এক অজানা মানুষ। দুরন্তপনা কৈশোরী মেয়েটির যখন বন্ধুদের সাথে রিকশায় চড়ে আইসক্রিম হাতে অহেতুক হেসে কুটিকুটি হবার কথা, তখন সে সংসারের হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে চাল-ডালের হিসাব করতে ব্যস্ত।

নসিমন ছিল তার দাদির প্রিয় নাতনি। বয়স ৮৫-এর কোঠায় হলেও পারিপার্শিক অবস্থা নিয়ে দাদি ছিলেন বড্ড সচেতন ও তীক্ষ্ন দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ। তাই প্রায়শই নসিমন যখন দাদির মাথায় চুলে নারকেল তেলে বিলি কেটে দিত, দাদি বিড়বিড় করে ‌‌অনেক ওজনদার কথা বলত। সেসব কথার কোনটাই নসিমন বুঝতো না। তবু মন দিয়ে শুনতো দাদির কথা।

দাদি বলতেন, নসিমন রে! সময়ের স্রোতে তাল মিলিয়ে পথ চলবি।তা না হলে কোন এক নির্দিস্ট স্থানে-কোণে আঁটকে যাবি।

নসিমন মুখ গুমরা করে বলত, কিসের তাল দাদি?

নাতনির প্রশ্নে দাদি যেন আরো কিছু বলার সুযোগ পেতেন!

এই ‘তাল’ সেই তাল নয় রে নসিমন যা দিয়ে মুখরোচর নানান স্বাদের খাদ্য তৈরি হয়। এই ‘তাল’ হলো সেই তাল, যা সঙ্গীত বা নৃত্যে একটি ছন্দের নিয়ামক এবং ছন্দের অংশাদির আপেক্ষিক লঘুত্ব বা গুরুত্বের নির্ধারক কে বুঝায়।

নসিমনের মাথায় কিছুই ঢুকতো না। তবু দাদি বলেই যেতেন,

শোন নসিমন! বড় হচ্ছিস। কয়দিন পর বিয়ে হবে শশুর বাড়ি যাবি। সেখানে সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। তবে মনে রাখবি, কারো কাছে কখনো মাথা নত করবি না। কেউ অন্যায়ে কষ্ট দিতে চাইলে আওয়াজ দিবি। নইলে মানুষ সবুজ দুর্বা ঘাসের মতোই তোকে মাড়িয়ে যাবে।

দাদি বলতেন, চলতি পথে কখনোই কারো প্রয়োজনে থেমে যাবি না। নিজ গতি ধরে রাখতে হবে। প্রয়োজনে চলতি পথের প্রতিবন্ধকতায় প্রতিপক্ষকে ধাক্কা মেরে নিজে সামনে এগোবি। থামবি না।

নসিমন-নামটাও ভালোবেসে দাদি-ই রেখেছিলেন। দাদির নামে নাতনির নাম-নসিমন।

আজ নসিমনের দাদির কথা খুব মনে পড়ে। সেদিনের ওজনদার কথার মূল্য দিতে না পারায় কষ্ট পায়।

হ্যাঁ, অনিচ্ছা সত্তেও অজানা মানুষটির হাত ধরে নতুন এক জগতে চলে এসেছিল নসিমন। বিয়ের ক’মাস আগে দাদি গত হয়েছিলেন, তাই বিযের দিন মা বলে দিলেন, শোন মেয়ে! স্বামীর কথা শুনতে হবে, শ্বশুর-শাশুড়ির কথা শুনতে হবে। ওরাই এখন তোমার আপনজন।

অপরিণত বয়সে বিয়ে হলেও নসিমন খুব বুঝতে পেরেছিল, শ্বশুর পক্ষই এখন তার সব কিছু। আর তাই গুছানো একটি সংসার গড়তে সকলের প্রতি মনোযোগী হয়ে উঠলো সে। সবার মন রেখে চলা, সেবাযত্ন করা হয়ে উঠলো তার নিত্যদিনের রুটিন।

বিয়ের প্রায় মাসখানেক পার হওয়ার পর-ই নসিমন অজানা মানুষটিকে ভালবাসতে শুরু করে। মানুষটি কখন বাড়ি ফিরবে, কি খাবে, কখন তাকে নিয়ে গল্প করবে, বাইরে ঘুরতে যাবে, শখের জিনিসটা কিনে দিতে চাইবে………ইত্যাদি নানান বিষয়গুলো নসিমনকে ভাবাতে শুরু করে। মানুষটা কাজে যাওয়ার পরই সে অস্থির হয়ে উঠে। তার মন খারাপ হয়। অপেক্ষায় থাকে কখন মানুষটা ঘরে ফিরবে। প্রায়ই আশায় থাকে, মানুষটা হয়তো হাতে করে তার জন্য চকোলেট নিয়ে আসবে।

সব আশা যদি মানুষের পূরণ হতো, তবে কী আর মানুষ বাঁচার জন্য লড়াই করতো? পানসে হয়ে যেতো বেঁচে থাকার কারণ।

গভীর রাতে মানুষটা কাজ শেষে বাড়ি ফিরে খালি হাতে। এসেই ক্লান্তি নিয়ে তড়িঘড়ি ঘুমাতে যায়। প্রায় রাতেই সে খেয়ে ফিরে বন্ধু-কলিগদের সাথে। এদিকে নসিমন তার সাথে বসে খাবার অপেক্ষায় থাকে রোজ।

এভাবেই দিনের পর দিন সোহাগ বঞ্চিত নসিমন রাতভর হাতের নখ খুঁটে চোখের কোলে কান্নার বালিহাঁস জমায়।
তারপর ভোর হতেই আবারো একটি দিন অপেক্ষায় থাকে সে, হয়তো আজ মানুষটা হাতে করে প্রিয় খাবারের প্যাকেটটা নিয়ে আসবে, কিংবা বাড়ি ফিরে জানতে চাইবে-সে খেয়েছে কিনা!

এমন কত ভাবনায় সময় পার হয়ে যায়, পার হলো গুনে গুনে তিনটি বছর। এভাবেই ভাবতে ভাবতে প্রায়ই সে ঘুমিয়ে পড়ে মানুষটির পাশের বালিশটিতে।

এসব কথা মা’কে বলা হয় না। বলবে তো কী বলবে? কী অভিযোগ করবে? মানুষটা ভালো চাকরি করে। নেশামুক্ত।

পরিবারে কোন অভাব রাখেনি। এসব আবেগী আহ্লাদের আবদার, ছোট ছোট বায়না, খুনসুটি, রোমন্থনে আলাপে রাত পারি দেয়া-এসব কী বলার মতো কিছু? নাকি অভিযোগের কারণ?

তাছাড়া, যে মা’কে কোনদিন মাথার কাপড় নামিয়ে চোখে চোখ রেখে বাবার সাথে কথা বলতে দেখেনি নসিমন, যে মা সংসার জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কাটিয়েছেন রান্নাঘরে, সে মা-ই বা কতটা বুঝবেন নসিমনের জীবনের ঘাটতি ঠিক কোথায়!

একে ঘাটতি বলাও কী ঠিক হবে? এই যে কত শত কোটি মানুষ তাদের জীবনের পুরেটাই পার করে দিচ্ছেন পাশের বালিশে শূন্যতা নিয়ে, তারা কী অভিযোগ করেছে কখনো? নিজের মা’কে দিয়ে ভাবলেই অবাক হয় নসিমন। এই মানুষটাকে কখনো স্বামীর সাথে হেসে কুটিকুটি হতে দেখেনি সে। একটি অনুগত ছাত্রীর মতো যেন পালন করেছে সব নির্দেশনা।

সেদিন রান্না শেষ করতে দেরী হওয়ায় উনুন থেকে ছিটকে পড়া মাছের ঝোলের গরম পাত্রটি-পুড়িয়ে কী দেয়নি মায়ের হাত? পাত্রটি যে নিজে নিজে ছিটকে পড়েনি, তা তো পাগলেও বুঝে। সে পোড়া ঘা থেকে সেরে উঠতে মা’কে মাসখানেক যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে। ঘরের কাজ তো আর থেমে থাকেনি, পোড়া ঘা নিয়েই থালা-বাসন ধুয়া থেকে কাপড় পর্যন্ত কাচতে হয়েছে।

দাদি দেখে গেছেন বংশ পরম্পরার এসব ধারাবাহিক পারিবারিক চিত্র। তাই যখন ছেলের ঘরে মেয়ে সন্তানের জন্ম হলো, দাদি ভীষণ খুশি হয়ে গেলেন। আদর করে নাম রাখলেন, নসিমন। দাদি বলতেন, ‘বংশের রক্ত প্রবাহিত হয় পুরুষ পরম্পরায়। সুতরাং বংশের রক্তের ধারক এবং বাহক হলো পুরুষ। আর তাই আমি চাইনা আমার একমাত্র ছেলের ঘরে আর কোন পুরুষের জন্ম হোক। একটা মেয়ে হয়েছে, এই বেশ!’

ছেলের বৌ’কে বলতেন, নসিমনের মা! আর বাচ্চার দরকার নাই তোমার। নসিমনের মা’ও তাই শুনলেন। একমাত্র মেয়ে নসিমনকে দিয়েই বংশ পরম্পরা থামিয়ে দিলেন।

রাত প্রায় ২টা। ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতে নসিমনের চোখে ঘুমের ঢল নেমে আসে। মানুষটা এখনো বাড়ি ফিরেনি।

বাইরে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বেশ কয়েকদিন ধরেই বিরাজ করছে হিমেল হওয়ার সাথে কন কন ঠাণ্ডা। দুপুরের পর থেকেই আকাশের গোমড়া মুখ-জানান দিচ্ছিল আজ বৃষ্টির দিন। অবশেষে মধ্যরাতে শুরু হলো মাঘের ঝুম বৃষ্টি।

জানালার পাশে দাঁড়াতেই দেখল, নিমাই কাকা ছাতা মাথায় ভিজে জবুথবু হয়ে ঘরে ঢুকছেন। নসিমন যে বাসায় থাকে, তার থেকে এক হাত দূরত্বে বাস করেন নিমাই ঘোষ। পাড়ার সবাই নিমাই কাকা বলেই ডাকেন। সেই নিমাই কাকার রয়েছে টিনের চালার একটি ঘর। একা মানুষ, ৭০ বছর বয়সেও ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করে টানছেন জীবনের ঘানি। কানাঘুষায় শুনেছে, নিমাই কাকার একমাত্র তরুণী মেয়েটা নাকি গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েছিল সেই বছর চারেক আগে। তার আগেই স্ত্রী গত হয়েছিল অসুখে। সেই থেকে নিমাই কাকা কম কথা বলেন। পাড়ার কারো সাথে দেখা হলে মাথা নামিয়ে পাশ কাটিয়ে যান। শুধুমাত্র কোন তরুণী মেয়েদের দেখতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। নসিমন কয়েকবার কথা বলতে চেয়েও বলতে পারেনি। আচ্ছা, কী হয়েছিল মেয়েটির?

নিমাই কাকার টিনের চালায় বৃষ্টি পড়ছে টুপুরটাপুর শব্দে। তবে আজ বৃষ্টির সঙ্গে বাতাস হচ্ছে বলে বৃষ্টির শব্দে ছন্দপতন হচ্ছে। যে বৃষ্টির শব্দ নসিমনকে আপ্লুত করতো, আজ সেই শব্দে কেমন উত্থান-পতন বেসুরা সুর। জানালার পাশে বারান্দার টবে রাখা গোলাপ দুটিও-বৃষ্টিতে নেচে নেচে দুলছে। বৃষ্টির ছন্দের তাল-লয় ছেড়ে নসিমন তাকিয়ে আছে গোলাপ দুটির দিকে।

ওদিকে-একটি গিরগিটি ছাদে গা ঘেঁষে আছে। নসিমনকে নজরে পড়তেই হুট করে রঙ বদলে ফেলল। সম্ভবত ঠান্ডার কারণে দেহে তাপ শোষণ করতে গিরগিটিটি কালো রঙা হয়ে গেছে। গরম হলে হয়তো হালকা রঙা হতো। সে হালকা রঙটা কেমন হতো?

রাত ৩টা। নসিমনের এখন ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু সে তাকিয়ে আছে ছাদে ঝুলন্ত গিরগিটির দিকে। গিরগিটি-টিও স্থির হয়ে দেখছে নসিমনকে।

এবার গিরগিটি তার রঙ বদলাতে শুরু করেছে। নসিমন তখনো তাকিয়ে আছে। নিউ ইয়র্ক ডিসেম্বর ২০২২

শেয়ার করুন