নিউইয়র্ক     শনিবার, ১২ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২৭শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঢাকা শহরে অন্তহীন সমস্যা আসবে, বলেছিলেন রানি এলিজাবেথ

বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ০৬:১০ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ০৬:১০ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
ঢাকা শহরে অন্তহীন সমস্যা আসবে, বলেছিলেন রানি এলিজাবেথ

ব্রিটেনের সদ্য প্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ১৯৮৩ সালের সফরে বাংলাদেশে এসে ঢাকা শহর সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন তৎকালীন প্রশাসকদের। বলেছিলেন, ঢাকা মহানগরের এই নবতর প্রসার এক সময় অন্তহীন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ ডেকে আনবে।

তিনি ওই সময় যেসব বক্তব্য দিয়েছিলেন তার মধ্যে বাংলা ভাষার ব্যবহারও ছিল। সে বছর ১৪ থেকে ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশে ছিলেন তিনি। ওই সময়ে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার কয়েকটি প্রতিবেদন থেকে রানির সেই বক্তব্য খুঁজে পাওয়া গেছে।

১৭ নভেম্বর ইত্তেফাকে প্রকাশিত ‘আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি: রাণী এলিজাবেথ’ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ৪ দিনের সফরের শেষ দিন রানি ও প্রিন্স ফিলিপের সম্মানে ঢাকাবাসীর পক্ষ থেকে তৎকালীন মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন আয়োজিত নাগরিক সংবর্ধনায় দেওয়া ভাষণের শেষাংশে করপোরেশনের প্রশাসকের উদ্দেশ্যে রানি বাংলায় বলেন, ‘জনাব প্রশাসক, অনুগ্রহ করে ঢাকাবাসীকে জানিয়ে দিন যে তাদের প্রচেষ্টায় আমরা তাদের সাথে রয়েছি।’

ইত্তেফাকের প্রতিবেদনগুলো ওই সময় সাধু ভাষায় লেখা হতো। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রানি কথা বলেছিলেন চলতি ভাষায়। এতটুকু বাদে বাকি বক্তব্য ইংরেজিতেই ছিল।

রানি বলেন, ‘আমার ও আমার স্বামীর এই সফরে এদেশের জনগণের নতুন আশার আলো দেখতে পেয়েছি। যদিও আমাদের ২০ বছর আগের সফরের এই দিনগুলোতে এদেশের মানুষ অনেক সমস্যা ও সংকটের মধ্য দিয়ে সময় পার করেছে।’

‘বাংলাদেশের জনগণ যেভাবে সময় কাটিয়েছে, তাতে ভবিষ্যৎ অত্যন্ত অন্ধকার হতে পারে বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু আজ আমরা সব জায়গায় আশার আলো দেখতে পাচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘ঢাকা মহানগরীর এই নবতর প্রসার নতুন নতুন অন্তহীন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ ডেকে আনবে। নগরীর প্রশাসনে নিয়োজিতদের ওপর নতুন নতুন কাজ এসে পড়বে। বিশ্বের বিভিন্ন সুপরিচিত নগরে যেসব সমস্যা আছে, তা ঢাকায়ও আছে।’

রানি বলেন, ‘জনগণ যখন ভবিষ্যৎ নাগরিকের সংখ্যা কমানো এবং তাদের অর্থবহ জীবনের সুযোগ করে দেয়ার চেষ্টা করবেন, তখনই এসব সমস্যা মোকাবিলা করা সহজ হবে।’ রানি যেদিন (১৪ নভেম্বর) ঢাকায় পা রাখেন সেদিন ইত্তেফাকের প্রধান সংবাদের শিরোনাম ছিল এমন: খোশ আমদেদ এলিজাবেথ।

১৫ তারিখের শিরোনাম ছিল, ‘রাণী এলিজাবেথের প্রাণঢালা স্মরণীয় অভ্যর্থনা।’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি থেকে যাত্রা শুরু করে গতকাল (সোমবার) রাত ৯টায় দ্বিতীয় এলিজাবেথ ঢাকায় পৌঁছান।’

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, তাকে অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দরে হাজির হন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আহসান উদ্দিন চৌধুরী, বেগম চৌধুরী এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক লেফট্যানেন্ট জেনারেল এইচ এম এরশাদ ও বেগম রওশন এরশাদ।

বিমানবন্দরের কাজ শেষ করে ৯টা ১০ মিনিটে শুরু হয় মোটর শোভাযাত্রা। এই শোভাযাত্রায় ২৭টি গাড়ি এবং ৫টি মাইক্রোবাস ছিল। ১৬ নভেম্বরের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রেসিডেন্টের ভোজসভায় স্বাগত বক্তব্যে রানি শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার অগ্রগতি সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন।

প্রতিবেদনটিতে দাবি করা হয়, ব্যক্তির স্বাধীনতা ও মর্যাদার ভিত্তিতে উপযুক্ত শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অগ্রগতিতে তিনি সন্তুষ্ট হয়েছেন। তবে কিছু অভিন্নতার কথাও উল্লেখ করেছেন। রানি বলেন, ‘একটি সুষ্ঠু ও অবাধ বিচার ব্যবস্থাধীনে নিরপেক্ষ আইন দ্বারা সংরক্ষিত ব্যক্তির স্বাধীনতা ও মর্যাদায় আমরা বিশ্বাসী।’

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ৮ সেপ্টেম্বর মারা যাওয়ার পর তার বাংলাদেশ সফর নিয়ে নানা ধরনের সংবাদ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন গণমাধ্যম। এরমধ্যে বেশিরভাগ গণমাধ্যমে গাজীপুরের বৈরাগীর চালা নামের গ্রামটির প্রসঙ্গ এসেছে। রানি ওই গ্রামে যান ১৬ নভেম্বর। বৈরাগীর চালা গ্রামের বাসিন্দা প্রয়াত মিজানুর রহমান খানের নেতৃত্বে ঢাকা থেকে যাওয়া কর্মকর্তারা রানি এলিজাবেথকে সেখানে স্বাগত জানান।

মিজানুর রহমান প্রায় ১৯ বছর আগে মারা গেছেন। তার ছেলে শাখাওয়াত হোসেন সেই সময়ে ১৭ বছরের কিশোর। এখন ৫৫ বছরে পা রাখা শাখাওয়াত দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, তার দাদি মোছা. হাকিমুন্নেসা গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে একটি রূপার তৈরি চাবি রানির হাতে তুলে দেন। তবে ইত্তেফাকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘অশীতিপর বৃদ্ধা হাকিমুন্নেসা প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যমণ্ডিত রূপার তৈরী একজোড়া হাতের বাজু রাণীকে উপহার দেন।’

শফিকুল কবিরের ‘মাটির কাছাকাছি’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে হাকিমুন্নেসার বক্তব্যও ছিল। তিনি বলেন, ‘৮০ বছরের জীবনে কোনোদিন রাজা-মন্ত্রী দেখি নাই। মরণের আগে লণ্ডনের রাণীরে দেইখ্যা পরাণ জুড়াইল।’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে গ্রামটিতে রানির ১৫ থেকে ২০ মিনিট থাকার কথা ছিল। কিন্তু কড়া রোদে ছায়াশীতল গ্রামে ৪০ মিনিটের মতো অতিবাহিত করেন তিনি।

বৈরাগীর চালা গ্রামকে বিদায় জানানোর আগে রানি সবাইকে অবাক করে প্রটোকল ভেঙে একটি মুদি দোকানে ঢুকে পড়েন। ইত্তেফাকের প্রতিবেদনের ভাষায়, ‘৫৭ বৎসর বয়সের রাণী এলিজাবেথ বৈরাগীর চালায় আসিয়া ১৭ বৎসরের প্রাণ-চঞ্চল তরুণীর মত মুদীখানায় ঝুলানো সেলেপিনের কাগজে মোড়ানো ১০ পয়সার তেঁতুলের আচার হাতে নাড়িয়া-চাড়িয়া অনাবিল মাধুর্যের হাসিতে-হাসিতে বৈরাগীর চালাকে বিদায় জানাইলেন।’ সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ১৪-১৭ নভেম্বর ১৯৮৩
পরিচয়/সোহেল

শেয়ার করুন