ডায়াসপরাএকটি অতিব্যবহৃত ও স্বল্প তাত্ত্বিকায়িত শব্দ। সময়ের সাথে সাথে ডায়াসপরা শব্দটির এবেলার অর্থ ও তাত্ত্বিকতা ওবেলার সঙ্গে অপরিবর্তিত থাকছে না, পাল্টে যাচ্ছে। বিশ্বায়নের কালে অর্থ ও তাত্ত্বিকতার দিক থেকে ডায়াসপরা শব্দটি হয়ে উঠেছে বহুস্তর বিশিষ্ট ও জটিলতর। ডায়াসপরা শব্দটির বারোয়ারী ব্যবহার এরই মধ্যে তার সংজ্ঞাকে কুয়াশাচ্ছন্ন করে ফেলেছে। ডায়াসপরা শব্দটির অর্থ পুরোপুরি না জেনে, না বুঝে বা উপর স্তরের ভাবটুকু ভেবে নিয়ে অনেকেই ব্যবহার করে থাকে। যেভাবে ইমিগ্র্যান্ট ও মাইগ্র্যান্ট শব্দ দুটোকে সমার্থক ভেবে গুলিয়ে ফেলে। অভিবাসী শব্দের সঙ্গে ডায়াসপরা শব্দকে অদলবদল করে ব্যবহার করে। ইমিগ্র্যান্ট, এক্সপ্যাট্রিয়েট ও ডায়াসপরা শব্দ তিনটিকে সমার্থক ভেবে ব্যবহার করে— ইংরেজীতে যাকে বলে, সিনোনিমাসলি, ইন্টারচেন্জেবলি ইউজড। ডায়াসপরা শব্দটি কোন মনোসিম (monoseme) বা মনোলিথিক অর্থের শব্দ নয়। ডায়াসপরা শব্দটি পলিসিম (polyseme) শব্দ যার মধ্যে রয়েছে দার্শনিকতা, কৌটিল্য সংহিতা ও সমাজতাত্ত্বিকতার বহুস্তরের অর্থ। পলিসিম (polyseme) এবং পলিসিমি (polysemy) শব্দ দুটো শুনতে একই রকম শোনায়। কিন্তু অর্থের ক্ষেত্রে তারা আলাদা। দেখা গেছে ইংলিশ শব্দের মোট শব্দ সংখ্যার ৪০% শব্দ পলিসিম শব্দ। এ ক্ষেত্রে polyseme লিঙ্গুইস্টিক্স আর polysemy সিম্যানটিক্স প্রসঙ্গের শব্দ।
ডায়াসপরা হলো তারা যাদেরকে দেশ থেকে জোর করে বের করে দেয়া হয়। সেটা নানা কারণে হতে পারে যেমন aftermath of natural catastrophe, ধর্মের অনাচার, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার এথনিক ক্লিনজিং বা রাষ্ট্র কর্তৃক উৎখাত। এক্সপ্যাট্রিটয়েট লেখক একজন ইন্ডিভিজুয়াল যিনি নিজ সিদ্ধান্তে দেশ ছেড়ে যান। যেমন ফ্রন্সে স্বেচ্ছা-নির্বাসিত আলবেনিয়ার লেখক ইসমাইল কাদারে, সোমালিয়ার লেখক নুরুদ্দীন ফারাহ, তুরস্কের লেখক ওরহান পামুক। যেমন কানাডায় ভারতীয় লেখক রোহিন্তন মিস্ত্রী, শ্রীলঙ্কার লেখক মাইকেল অন্ডাতজে। বৃটেনে ত্রিনিদাদের লেখক ভিএস নাইপল, রুশ-পোলিশ-ইুক্রেনিয়ান লেখক যোশেফ কনরাড, নাগাসাকিতে জন্ম জাপানী লেখক কাজুয়ো ইশিগুরো। এখানে একটা জিনিস লক্ষ্য করা যায়, নাইপলের গ্রান্ড প্যারেন্টস ভারত থেকে প্লানটেশন শ্রমিকদের কাতারে ত্রিনিদাদে এসেছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনামলে। এরা ইহুদি এক্সোডাস বা ডায়াস্পরার মতো ছিল না, তবু তারা ছিল forced disparagement এর উন্মূল মানুষ। তারা ছিল ইন্ডিয়ান ডায়াসপরা। সেই ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্র থেকে ১৯৪৮ সালে Windrush জাহাজ বোঝাই করে ভারতীয়দের নিয়ে ফেলেছিল Tilbury Port, Essex, ইংল্যান্ডে শ্রমিক করে। ভারত থেকে ভারতীয়দের এনেছিল ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্রে প্রায় জোর করে। আবার তাদেরকেই নিয়ে ফেললো ইংল্যান্ডে কিন্তু জোরপূর্বক নয়। এই যে forced and willing displacement— এ দুটো তাত্ত্বিক দিক দিয়ে ডায়াসপরা নয়। ভারত থেকে যাদেরকে ক্যারিবীয় দ্বীপদেশে আনা শ্রমিকদের বলা হবে ডায়াসপরা। সেই একই শ্রমিকদল যাদেরকে ক্যারিবীয় দ্বীপদেশ থেকে নিয়ে ফেলা হলো ইংল্যান্ডে তাদেরকে ডায়াসপরা বলা যাবে না। কারণ, তাদেরকে ঘাড়ে ধরে ডিসপ্লেসড করা হয়নি।
ডায়াসপরা শব্দের সঙ্গে দুটো প্রিরিক্যুজিটস রয়েছে — একটি, ফোরস ডিজপ্লেসমেন্ট, অপরটি, গ্রুপ ডিসপ্লেসমেন্ট। বলা হয়ে থাকে Once displaced forever displaced. এই অর্থে, শেষোক্ত ভারতীয়রা আর ফিরে যায়নি ক্যারিবীয় দ্বীপদেশে — তাদের উৎসভূমিতে। কালক্রমে তাদেরকে বলা হলো ডায়াসপরা। এখানে দেখছি ডায়াসপরা অর্থের আরেক স্তর। Expatriate লেখক গ্রুপ ডিজপারসড নয়। তারা দলে দলে কাফেলা হয়ে দেশ ছেড়ে দেশান্তরী হয় না। তারা ব্যক্তিক ইচ্ছায় দেশ ছেড়ে যায়। নাইপল, কনরাড, ইশিগুরো — এই তিনজনই জন্মভূমি বা মাতৃভূমি উপড়ে আসা লেখক।পরবর্তীতে বৃটিশ লেখক। আইডাহো, আমেরিকার কবি এজরা পাউন্ড যিনি তার পরিনত বয়স কাটালেন লন্ডন, ফ্রান্স ও ইটালিতে। আধুনিক কবিতার জনক টিএস এলিয়ট সেন্ট ল্যুইস, মিজৌরা, আমেরিকার সন্তান। তিনি সারা জীবন কাটালেন লন্ডনে। জন্মের দলিল জর্মন নাগরিকতা ফিরিয়ে দিয়ে প্রায় স্টেটলেছ যাযাবর হয়ে ঘুরে বেড়ালেন Alps এর দেশে দেশে। ব্যক্তিগত যাতনাযাপনের বিরুদ্ধে renunciation of allegiance অর্থাৎ জন্মভূমির প্রতি আনুগত্য পরিত্যাগ। এদের কাউকেই ডায়াসপরা লেখক বলা হয় না। শুধু নাইপলকে বলা যাবে ডায়াসপরা লেখক। ডায়াসপরা লেখকের লেখালেখির পূর্বশর্ত হচ্ছেঃ বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি এবং আত্মপরিচয়ের সন্ধান (sense of alienation and quest for identity) — নাইপলের লেখায় তার তীব্র প্রকাশ আছে। নাইপলের ইন্ডিয়া ট্রিলজি তার প্রমান— (1) An Area of Darkness (2) India: A Wounded Civilization এবং (3) India: A Million Mutinies Now. এগুলোর মধ্যে ভারত-তিরস্কার থাকলেও পূর্বপুরুষের জন্য টান এবং আত্ম পরিচয়ের সন্ধান, অন্বেষার লেখা। সমালোচনা হলেও তা শেকড়ের সন্ধান। ওরহান পামুক তার তুর্কী identity নিয়ে চিন্তামগ্ন থাকেন স্বেচ্ছা-নির্বাসিত জীবনে। কাশ্মীরি কবি আগা শাহেদ আলীর কবিতা The Country Without a Post Office” (আগে নাম ছিল “Kashmir without a Post Office) কাব্যগ্রন্থের নামের মধ্যে প্রকাশিত diasporic alienation এর কথা। তিনি সমাহিত ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের একটি সেমেটারিতে। বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি বা sense of alienation থেকে মুক্তি মিলবে কি আত্তীকরণ (assimilation) এর চেস্টার মধ্যে? সেটা কি সম্ভব? হেগেল এর একটা প্রস্তাবনা আছে — entaisserung (surrender) and entfremdung (separation) — কোনটা মেনে নেবে ডায়াসপরা।
অনেকেই মেনে নেয় entaisserung অর্থাৎ surrender, যারা সত্যিকার অর্থে ডায়াসপরা তারা ফিরে যায়। তারা প্রতিদিন ফিরে যেতে চায়। ওপড়ানো শেকড় প্রোথিত হতে চায় অঙ্করোদ্গমের আজন্ম মৃত্তিকার নির্যাস। নাইপলের প্রায়-প্রতিকী ট্রাজিকমেডি magnum opus নভেল, A House For Mr. Biswas এর কথা মনে পড়ল। পরাজিত মানুষ মোহন বিশ্বাসের বাড়ি ছিল না। মোহন কেঁদে উঠে বলেছিল, I don’t look like anything at all – বলেছিল, আমার নিজের কোনো বাড়ি নেই, আমার কোনো কাঠামো নেই, আমি শূন্যতায় ঝরে পড়ে হয়ে যাবো বিলীন। বাড়ির মালিক হলে কি আত্তীকরণ হয়? যার সেই বোধ তৈরি হয় সে কি ডায়াসপরা না ইমিগ্র্যান্ট! স্থানচ্যুতির অনুভূতি, উন্মূল ভাবনা এবং ফেরার বাসনা (uprooting and re-rooting, feelings of displacement): প্রলম্বিত যাপন শেষে বুঝি এখানে আমাকে কেউ চেনে না। দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন আমার জীবন।
লেখক অমিত চৌধুরী কুড়ি বছর পর প্রচন্ড ক্ষোভে লন্ডন ছেড়ে ফিরে গিয়েছিলেন কোলকাতায়, দিল্লিতে। শ্বশুর বাড়ি কানাডা থেকে racial discrimination এর অপমানজনক জীবন ফেলে নিউ ইয়র্কে ফিরে আসেন ভারতী মুখার্জি। Collective memories— আফ্রিকান ডায়াসপরা লেখকদের oeuvre জুড়ে দেখা যায় শেকলে বাঁধা কালো ক্রীতদাসের স্মৃতি। Reflection of pain and agony— মূলধারায় ঢুকতে না পারার যাতনা। পদে পদে নেটিভদের দেয়া যাতনা। চিকিৎসা বিজ্ঞানে যাকে বলে rejection phenomenon এটা তেমনই। শরীরে একটা অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট করার পর শরীরের সবগুলো অর্গান বলতে থাকে তুমি একটা বিদেশি তোমাকে নেবো না। ইমপ্লানটেড অর্গান বলে, I have become an integral part of this system and I will not go anywhere. Xenophobia, re-rooting— টিএস এলিয়ট এর To the Indian Who died in Africa কবিতায় ফেরার কথা, জিনোফোবিয়ার ঈঙ্গিত ধ্বনিত — “A man’s destination is his own village, His own fire, and his wife’s cooking; To sit in front of his own door at sunset And see his grandson, and his neighbour’s grandson Playing in the dust together… Every country is home to one man And exile to another”— সাত লাইনের মধ্যে তিনবার ‘his own’ শব্দের উক্তি আছে। শেষ লাইনে ‘exile’ শব্দ বলে দেয় পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
Nostalgia — তসলিমা নাসরিনের লেখায় ছেড়ে আসা দেশের প্রতি আর্তি উচ্চারিত। দেশে ফেরার আর্তি ঝরেছে অঢেল। Nagging sense of guilt— জীবনের শেষদিনে কবি শহীদ কাদরী বলে উঠলেন, দেশ ছেড়ে আসা একটা হঠকারি সিদ্ধান্ত। ইত্যাদি ডায়াসপরা সাহিত্যের প্রধান এলিমেন্টস। ডায়াস্পরিক লেখালেখি ফিরে ফিরে যায় ফেলে আসা স্মৃতির শহরের দিকে। ফেরা না ফেরার দ্বিধা দ্বন্দ্বে ছিন্নভিন্ন হৃদয়। উপরে লিখিত প্রাক-শর্তগুলো এবং প্রধান বৈশিষ্ট গুলো ডায়াসপরা লেখায় থাকতে হবে। তবে সবগুলোই যুগপৎ থাকতে হবে তা নয়। এক্সক্লুসিভলি মিউচুয়াল হওয়ার ব্যাপারটা বিবেচ্য। এ বিষয়ে এখানে আর ড্রিল-ডাউন আলোচনায় না যাই। একটা আউটলাইন দিলাম এটা ভেবে যে, যারা হুটহাট ডায়াসপরা, ডায়াসপরা করেন, তারা এ নিয়ে পড়াশোনা করবেন, নিজেকে ডায়াসপরা সম্বন্ধে প্রাক-শিক্ষিত অবস্থা থেকে শিক্ষিত করতে সচেস্ট হবেন, শিক্ষিত করে তুলবেন। তখন ডায়াসপরা নিয়ে বাৎচিৎ করলে তা শ্রবণযোগ্য আর লিখলে তা পাঠযোগ্য হবে। আপাততঃ এটুকু থাক পরে বিস্তৃত পরিসরে তুলনামূলক আলোচনা করে ডায়াসপরার স্বচ্ছ একটা ধারণা দিতে চেস্টা করবো। ( ঊনবাঙাল নিউ ইয়র্ক এর ৪০তম সাহিত্য সভায় ‘ডায়াসপরা সাহিত্য’ আলোচনার কী-নোট স্পীকার সৈয়দ কামরুল এর এপিটোমাইজড বক্তৃতা )